29/03/2024 : 2:04 AM
আমার বাংলাকালনাদক্ষিণ বঙ্গপূর্ব বর্ধমান

করোনা আবহে এবার কদর কমেছে ভাদু গানের

জিরো পয়েন্ট নিউজ – রীতা ভট্টাচাৰ্য, কালনা, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০:


করোনা আবহে এবার কদর কমেছে ভাদু গানের। গৃহস্থ বাড়িতে মিলছে না মনমত পরিশ্রমিক। এক বছর আগেও চিত্রটা ছিল আলাদা। পূর্বস্থলীতে এক বাড়িতে ভাদুগান পরিবেশন চলা কালিন পাশের বাড়ি থেকে আমন্ত্রণ আসতো। কিছু কিছু বাড়িতে ভাদু শিল্পীদের মাথায় ফুল দেবার পাশাপাশি কপালে চন্দনের ফোটা লেপে দিতেন। কোন কোন গৃহস্থকে শিল্পীর মুখে মিষ্টি তুলে দিতেও দেখা গিয়েছে। এরপর ভাদুমণির গান পরিবেশন শুরু হয়। গৃহস্থরা খুশি হয়ে চাল, আলুর পাশাপাশি ১০ টাকা থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক দিতেন। কিন্তু এবার যেন ভাদুগানের কদর কমেছে। পারিশ্রমিক ১ টাকা থেকে ৫ টাকার বেশী মিলছে না, বলে অভিযোগ। চাল, আলুর পরিমানও অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। ফলে, করোনা আবহের জন্য অধিকাংশ ভাদু শিল্পীরা এবার আসরে নামতে দেখা যায়নি।

ভাদ্র মাস হলে গৃহস্থ বাড়ির উঠানে হাজির হন ভাদু গানের লোক শিল্পীরা। ভাদুমণির একটি মূর্তি তাদের সঙ্গে থাকে। মুলত রাঢ়বঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকায় এদের গান শোনা যায়। ভাদু শিল্পীদের দাবি, ভাদুমণিকে নিয়ে নানা লোককাহেনী প্রচলিত আছে। পঞ্চকোটের রাজা নীলমণি সিংহের তৃতীয় কন্যা ছিলেন ভাদুমণি। হাসি খুসি প্রকৃতির এই মেয়েটিকে সকলেই ভালোবাসতেন। তার বিবাহ স্থির হবার পর ভাবী স্বামীর অকালমৃত্যু হয়। যার ফলে ভাদুমণি মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছিল। তার সেই কাহেনী মানভূম অঞ্চলে সর্বাধিক প্রচারিত। সেই লোককাহেনী গানের মাধ্যমে পরিবেশন করেন ভাদু শিল্পীরা।

একদা নাদনঘাট, পূর্বস্থলী, মন্তেশ্বর প্রভৃতি অঞ্চলের ১৫ টি দল ভাদু গান শোনাতে বের হতেন। প্রতিটি দলে ৮ থেকে ১০ জন পর্যন্ত শিল্পী থাকে। কেউ বাজান হারমোনিয়াম, কেউ নাল, তো কেউ বাজান খঞ্জনি। ভাদুমণির প্রাচীন লোকগীতি গাইতে শুরু করেন আরেক শিল্পী। একটি মেয়ে গানের তালে তালে নাচেন। কিন্তু এবছর এলাকায় সেই সংখ্যাটা শুধুমাত্র ২টা দলে এসে ঠেকেছে।

পূর্বস্থলী থানার হালদিনপাড়ার চাষি সুশান্ত বাগদি পাঁচ পুরুষ ধরে ভাদু গানের সঙ্গে যুক্ত। দলে তিনি ঢোলক বাজান। আগে মেয়েকে নিয়ে যেতেন ভাদু গান পরিবেশনে। কিন্তু বিয়ের পর মেয়ে আর নাচতে যেতে আগ্রহ দেখান নি। ফলে নাতি অরুন দেবনাথ (১১) মেয়ের সাজে নৃত্য পরিবেশন করে। ভাদ্র মাসের শেষ দু সপ্তাহের জন্য তার দল আগাম প্রস্তুতি নিতেন। সন্ধ্যা হলে ৭ জনের দলের রেওয়াজ হত। মন্তেশ্বর লহনার বিপদ মণ্ডল তাদের দলে হারমোনিয়াম বাজিয়ে ভাদুমণির গান পরিবেশন করেন। হালদিপাড়া ছাড়াও মুকশিমপাড়া, জামালপুর, দাস্তিপাড়া, সাতপোতা, মধুপুর, ছাতনি প্রভৃতি গ্রামে ভাদুগান শোনাতে যান। ভালো পরিশ্রমিকও পেতেন। কোন কোন দিন ভাগে ৩০০ টাকাও পেয়েছেন। সেছাড়া আছে চাল, আলুর ভাগ। কিন্তু এবার যেন বাজার মন্দা। মাথা পিছু ১৫০ টাকা পারিশ্রমিক জোটাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে।

সুশান্তবাবু বলেন, সারা বছর চাষ আবাদ নিয়ে থাকি। ভাদুগান পরিবেশনটা আমাদের বংশগত নেশা। ভাদ্রমাস এলেই ভাদু গানের পরিবেশনের জন্যে আমাদের মন পড়ে থাকে। মাসের শেষ দু সপ্তাহ বাড়িতে বাড়িতে যাই। কিন্তু এবার যেন ভাদু গানের প্রতি গৃহস্থের ঝোক কমেছে। আগে যেমন সকলে কাছে এসে গান শুনতো। এবার দূরে দাঁড়িয়ে গান শুনছেন। পারিশ্রমিকও তালানি এসে দাড়িয়েছে। দু টাকা পাঁচ টাকার বেশী কেউ দিচ্ছেন না। আগে অনেক বাড়ি থেকে ১ কেজি পর্যন্ত চাল পেয়েছি। এবার ১০০ গ্রাম চালও কোন বাড়ি থেকে জুটছেনা। মনে হয়, করোনা আবহের জন্য এই দুরাবস্থা। এবার অনান্য এলাকার দলগুলোও বার হয়নি। তবে পারিশ্রমিক যতই কমই পাইনা কেন, ভাদুমণির গান আমরা ছাড়বো না।

ওই দলের আরেক সদস্য চাঁদু বাগ বলেন, করোনা হলেও গৃহস্থরা ভাদুগানের প্রতি আগ্রহ হারান নি। কেউ খালি হাতে ফেরাচ্ছেন না। হয়তো সামগ্রিক পরিস্থিতে তারা পারিশ্রমিক কম দিচ্ছেন। মনে সারাদেশ করোনা মুক্ত হলে আবারো ভাদুগানের কদর বাড়বে। সেই সঙ্গে আমাদের পারিশ্রমিকও স্বাভাবিক হবে।

Related posts

তাঁত শিল্পীর মেয়ে তৃষার স্বপ্ন ডাক্তার হওয়া

E Zero Point

তারাপীঠ থানার উদ্যোগে ট্রাফিক সচেতনতা র‍্যালি ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’

E Zero Point

‘সকলের জন্য’ সংবাদ পত্রের বার্ষিক সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা

E Zero Point

মতামত দিন