19/03/2024 : 4:41 PM
ছোট গল্পছোটদের জগৎসাহিত্য

ছোটদের গল্পঃ দুই বোন

পূর্বাশা মণ্ডল

সন্ধ্যাবেলাতেই মীনা আর টিনার একচোট ঝগড়া হয়ে গেল। মীনা চিৎকার করে টিনাকে বলছিল – বোন, তুই কিন্তু আমার ড্রইং সেটটাতে হাত দিবি না। ওটা আমি পাড়ার ড্রইং কমপিটিশনে ফাস্টপ্রাইজ হিসেবে পেয়েছিলাম। তুই কেন নিয়েছিস ? টিনাও বিন্দুমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে বলল – কি করব, আমার ড্রইং সেটের নীল রংটা ঘষে ঘষে শেষ হয়ে গেছে! ওদিকে কালকে স্কুলের ড্রইং ক্লাসের জন্য একটা সিনারী আঁকা প্রাকটিস করতে হবে। মেঘের জন্য নীল রংটা চাই যে!

-তা বলে আমার নতুন সেটটাই নিতে হবে! আমাকে বলে নিয়েছিস ? দে আমার কালার সেট!

-না দেবো না! হিংসুটে একটা!

-তবে রে! আমি হিংসুটে!কাল স্কুলে বন্ধুর জন্মদিনে গিফ্ট হিসেবে পাওয়া ক্যাডবেরীটা তো আমায় দেখিয়ে দেখিয়ে একা একাই খেলি! সেটা হিংসুটেগিরি ছিল না! এখন আমাকে বলছিস্! ভালোয় ভালোয় আমার জিনিস ফেরত দে বলছি!

-না দেবো না!

ব্যাস, শুরু হয়ে গেল দুই বোনের ঝটাপটি। ওদের মা দেবিকা পুজো সেরে ধুনুচি হাতে নিয়ে ঠাকুঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। বিড়বিড় করে ঠাকুরের নাম নিতে নিতে সারা ঘরে ধুনোর গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে তিনি মেয়েদের ঘরে এলেন। স্তব-স্তুতি সাময়িকভাবে বন্ধ রেখে  বিরক্ত মুখে তিনি বললেন – বাপরে বাপ! সাত সন্ধ্যেবেলাতেই  হুলো বিড়ালের মতো দুটোতে মিলে লেজ ফুলিয়ে ঝগড়া শুরু করেছে! হ্যাঁরে, তোদের জ্বালায় কি শান্তিমনে ঠাকুরের নাম নিতে পারব না! তা হয়েছেটা কি?

সব শুনে গম্ভীর হয়ে তিনি মন্তব্য করলেন – তা টিনার যদি শুধু নীল পেন্সিলটা লাগে, তো ওকে দিলেই তো হয়! কাজ হয়ে গেলেই তো তোর জিনিস আবার ফেরত পাবি। তার জন্য এতো চিল্লাচ্ছিস কেন রে টিনা?

টিনা হাউমাউ করে বলে – কিন্তু মা, ওটা তো আমার গিফ্ট পাওয়া জিনিস! আমি নিজেই প্যাকেট খুলে ব্যবহার করি নি, আর ও কিনা আমাকে না বলে …

মা মাঝপথেই বড় মেয়েকে ধমকে বলে ওঠেন – ও কি কথা ! কালার পেন্সিল তো ব্যবহারের জন্যই উপহার দেওয়া হয়! আর ছোটবোন একটু নিয়েছে তো কি হয়েছে! তুই না বড় দিদি! কোথায় বোনকে ভালোবেসে হাতে হাতে তাকে সাহায্য করবি, তা নয়! …

টিনা চোখের কোণ দিয়ে দেখল মায়ের কথায় মীনার মুখে হাসি ফুটেছেফুটেছে।দিদির দিকে এমন বিজ্ঞের মতো তাকাচ্ছে ভাবখানা যেন, দেখেছিস – মা কিন্তু আমার দলে! অভিমানে টিনার চোখে জল চলে আসে। মা চিরকালই এমন! সবসময় মিনার হয়ে কথা বলে! তুই বড়, বোন ছোট, ওকে কাঁদাস না, দিদি হলে অনেক কিছু ছাড়তে হয় – কেন রে বাবা! দিদি হয়েছি বলে কি বোনের সব দুষ্টুমি মুখ বুজে সহ্য করতে হবে! মার শুধু মিনার দিকেই টান, আমাকে একটুও ভালোবাসে না। – কথাটা মনে হতেই টিনার চোখে জল এসে গেল। সে চোখের জল সামলে মাকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত ঠাকুমার ঘরে দৌড় দিল।

সেই থেকে দুই বোনের আড়ি, কথাবার্তা বন্ধ। তা বলে একসঙ্গে ইস্কুল  যাওয়া আসা তো বন্ধ হয়ে যায় না! টিনা ওদের পাড়ার মোড়ের সরকারী স্কুলটায় অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে আর একই স্কুলে মীনা ষষ্ঠ শ্রেণীতে। ওদের পাশের বাড়ীর ঝুমকিও মীনার সঙ্গে এক ক্লাসে পড়ে, তিনজন একইসঙ্গে বাড়ী ফেরে।স্কুলের গল্প করতে করতে কথায় কথায় ঝুমকি বলল – জানো টিনাদি, আজকে ড্রইং ক্লাসে স্যার সিনারীর ওপর একটা  পরীক্ষা নিয়েছিল। মীনা দশে মাত্র তিন পেয়েছে।আমি ওকে তাই বলছিলাম, তোর দিদি যেখানে ফাস্ট হয়ে প্রাইজ আনে সেখানে তুই কিনা ফেল! হি হি হি …

অপমানে মীনার মুখটা এতটুকু হয়ে গেছিল। সেদিকে তাকিয়ে টিনার মনটা হুহু করে উঠল। সব অভিমান ভুলে বোনের প্রতি মমতায় তার বুকটা ভরে গেল। গম্ভীর হয়ে সে ঝুমকিকে বলল – ও কি কথা ঝুমকি! আমি ভালো আঁকি বলে বোনকেও ড্রইংয়ে দশে দশ পেতে হবে! এটা একটা কথা হল! ওর মতো এতো সুন্দর নাচতে কি কেউ পারে! আমি ছাড়, আমাদের স্কুলের কোন মেয়েই ওর মতো নাচতে পারবে না। তাহলে? যার যেদিকে ন্যাক! হাওয়া গরম দেখে ঝুমকি চুপ করে গেল।মীনা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে দিদির দিকে তাকাল। এইজন্য সে দিদিকে এতো ভালবাসে।কি সুন্দর তার মনের দুঃখের কথাটা  বুঝতে পারল!

সেদিন সন্ধ্যাবেলা দুইবোন বসার ঘরে পড়তে বসেছে। স্কুলের ব্যাগটা খুলে বইপত্র বের করতে গিয়ে টিনা দেখল জ্যামিতি বাক্সের ভেতর একটা ছোট্ট টফি রাখা আছে, সঙ্গে একটা চিরকুট। তাতে লেখা – একজন অন্য কারোর এঁটো দাঁতে কাটতে ঘেন্না পায় বলে আগের দিন ক্যাডবেরীটার ভাগ পায় নি।আজ  আর এক বন্ধুর জন্মদিনে দুটো টফি পেয়েছি। একটা আমার জন্য আর একটা তার জন্য। এবার সে যদি এটা খায় তো আমি ধন্য হই!

ইতি – মীনা

কোনরকমে হাসি চেপে আলগোছে বোনের দিকে তাকিয়ে টিনা দেখল মীনা সামনের ফাঁকা দেওয়ালটার দিকে তাকিয়ে আছে, যদিও মুখে দুষ্টু হাসি।টিনা মুচকি হেসে টফিটার খোসা খুলে চকোলেটটা মুখে দিল। মীনাও এবার নিজের ব্যাগ  থেকে তার টফিটা খুলে মুখেদিল।এরপর দুজন একইসঙ্গে হেসে উঠতে গিয়েও সামলে নিল। না, এখন এতো ভাব করা যাবে না।মা এখন ওদের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুপুরের শুকনো কাপড়গুলো গোচাচ্ছে। হঠাৎ করে ওদের ভাব হয়ে গেছে দেখলে আবার ঠাট্টা করে ঠাকুমাকে বলবে – দেখুন মা, আপনার নাতনীদের কীর্তি! এই ঝগড়া করে গলা ফাটাচ্ছে আবার এই ভাব করে গলা জড়াজড়ি করে বসে আছে! সত্যি, মেয়েগুলোর মতিগতি বোঝা ভার!

দরকার নেই বাবা ওসব ঝামেলায়! তার চেয়ে আজকের দিনটা ওদের কথা বন্ধ থাক, কাল থেকে না হয় আগের মতো ভাব করা যাবে।

দুই বোন চোখে চোখে ইশারায় কথাগুলো বলে টফি চুষতে চুষতে পড়ায় মন দিল। এখন তাদের মন একেবারে শরতের ঝকঝকে নীল আকাশের মতো কলুষতামুক্ত। ♥

 

 

Related posts

দৈনিক কবিতাঃ স্বপন-প্রহর

E Zero Point

দৈনিক কবিতাঃ অনুসরণ

E Zero Point

দৈনিক কবিতাঃ প্রকৃত বন্ধু

E Zero Point

মতামত দিন