16/04/2024 : 10:01 AM
আমার বাংলাজীবন শৈলীধর্ম -আধ্যাত্মিকতা

স্বামীজী স্মরণেঃ বিবেক জাগ্রত হোক আনন্দময় হোক পৃথিবী

রজত ঘোষ


বালিন্দর, কালনা, পূর্ব বর্ধমান


“Sisters and brothers of America,

It fills my heart with joy unspeakable to rise in response to the warm and cordial welcome which you have given us…I am proud to belong to a religion which has taught the world both tolerance and universal acceptance. We believe not only in universal toleration, but we accept all religions as true. I am proud to belong to a nation which has sheltered the persecuted and the refugees of all religions and all nations of the earth…”দিনটা ১১ ই সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩ সন।

শিকাগোর বিশ্ব মহা ধর্ম সম্মেলনে ভারতমাতার এক মহান সন্তান শুনিয়েছিলেন সনাতন ভারতীয় হিন্দু সভ্যতার এক নতুন ধারা যা ভারত, ভারতবাসী ও ভারতীয়ত্ত্ব সম্পর্কে জগৎবাসীর চোঁখের পর্দা উন্মোচিত করেছিল। তাঁর এই শিকাগো বক্তৃতার পরে তাঁর সম্বন্ধে “নিউইয়র্ক ক্রিটিক” পত্রিকায় লিখিত হয়েছিল- “তাঁর শিক্ষা, বাগ্মিতা এবং মনোমুগ্ধকর ব্যক্তিত্ব আমাদের সামনে হিন্দু সভ্যতার এক নতুন ধারা উন্মুক্ত করেছে। তাঁর প্রতিভাদীপ্ত মুখমন্ডল, গম্ভীর ও সুললিত কণ্ঠস্বর স্বতই মানুষকে তাঁর দিকে আকৃষ্ট করে এবং ঐ বিধিদত্ত সম্পাদ্সহায়ে এদেশের বহু ক্লাব ও গির্জায় প্রচারের ফলে আজ আমরা তাঁর মতবাদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। কোনো প্রকার নোট প্রস্তুত করে তিনি বক্তৃতা করেন না। কিন্তু নিজ বক্তব্য বিষয়গুলি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে অপূর্ব কৌশল ও ঐকান্তিকতা সহকারে তিনি মীমাংসায় উপনীত হন এবং অন্তরের গভীর প্রোরণা তাঁর বাগ্মিতাকে অপূর্বভাবে সার্থক করে তোলে” (“আমি বিবেকানন্দ বলছি” ,শংকর ,সপ্তম সংস্করন, পাতা-১৪৯) । আপনি ঠিকই ধরেছেন, তিনিই সেই মহান চিরদার্শনিক বিশ্বজয়ী স্বামী বিবেকানন্দ যিনি স্বামীজী নামে আমাদের হৃদয়ে আছেন।

১২ ই জানুয়ারি ১৮৬৩ সালে মকর সংক্রান্তির পূর্ণলগ্নে কলকাতায় ৩, গৌরমোহান মুখার্জি স্ট্রিট এর নিজ বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর পিতা বিশ্বনাথ দত্ত ছিলেন কলকাতা হাই কোর্টের এটর্নি ছিলেন। মা ভূবনেশ্বরী দেবী, একজন গৃহবধূ । বিবেকানন্দের ছোটবেলার নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত। সবাই তাঁকে বিলে বা নরেন বলেই ডাকতো। ছোট্ট বিলের দাদু দুর্গাচরণ দত্ত একজন সংস্কৃত ও পার্সি ভাষার পন্ডিত ছিলেন।

আধ্যাত্মিক, সনাতন, ধর্মীয়, যুক্তিবাদী, প্রগতিবাদী সাংসারিক পরিমণ্ডল ছোট্ট বিলের উপর প্রচুর প্রভাব ফেলেছিল। ছোট থেকেই বেজায় দুরন্ত ছিলেন বিলে। তাঁর মা বলতেন শিব কোনো পুণ্যাত্মাকে না পাঠিয়ে এই ভূতটাকে তাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ছোটবেলায় বিলে খুব দুরন্তপনা করলে তাঁর মা “শিব! শিব!” বলে মাথায় এক বালতি জল ঢেলে তাঁকে শান্ত করতেন।

ছোট্ট বিলে ছোটবেলায় যেমন দূরন্ত ছিলেন তেমনই পড়াশোনায় মেধাবী ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রখর বুদ্ধিমান ও সাহসী । তিনি এক অদ্ভুত প্রতিভার অধিকারী ছিলেন, যাকে তিনি একবার দেখতেন তাঁকে কোনোদিনও তিনি ভুলতেন না এবং যেটা একবার পড়তেন সেই বিষয়ও তাঁর সারাজীবন মনে থাকতো। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে জ্যামিতির চার খন্ড বই আয়ত্ত করতে পারতেন তিনি। ছোট বেলা থেকেই নরেন ধ্যান করতেন। বিভিন্ন মূর্তি ,ছবির সামনে তিনি ধ্যানে বসে পড়তেন। তাঁর মধ্যে এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। প্রতি প্যারাগ্রাফের প্রথম ও শেষ লাইনে পড়ে তিনি সমগ্র প্যারাগ্রাফের ভাব তিনি ধরতে পারতেন। এমনিই বিস্ময় বালক ছিলেন ছোট্ট বিলে।

তাঁর পড়াশোনা শুরু হয় ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে। পরবর্তী কালে ১৮৭৯ তিনি ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে | আর সেইবছরই কঠোর অধ্যায়ন করে কলেজের সব পরীক্ষায় তিনি পাশ করেন। এরপর তিনি ভর্তি হন স্কটিশ চার্চ কলেজে। ১৮৮৪ সালে তিনি স্নাতক হন। প্রথাগত পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি প্রচুর বই পড়তেন। ইতিহাস,ধর্ম,দর্শন, কলা,সমাজবিজ্ঞান ও সাহিত্য সম্পর্কীয় বিভিন্ন বই অধ্যায়ন করেন । এছাড়াও তিনি বেদ,উপনিষদ,রামায়ণ ও মহাভারত প্রভৃতি বিষয়ে পান্ডিত্য অর্জন করেন।

দর্শন শাস্ত্রে তাঁর প্রচুর আগ্রহ ছিল। একটি প্রশ্ন তাঁর মনে সর্বদা ঘুরে ফিরে আসত, ঈশ্বর কি? ঈশ্বর কি কেউ দেখেছেন। ছোটবেলায় তিনি ঈশ্বর বিশ্বাসী ছিলেন না। নাস্তিক নরেন যখন কোনো ঈশ্বর সম্বন্ধীয় কোনো বক্তৃতা শুনতেন তখন তিনি একটা প্রশ্ন করতেন-“মহাশয় আপনি কি ঈশ্বর দর্শন করিয়াছেন?” তাঁর এই প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারেননি।
তিনি ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিও আকৃষ্ট হন তাঁর প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে। কঠোর ব্রহ্মচর্য , তপস্যা ও ধ্যান মগ্ন থেকেও কিন্তু তিনি পাননি তাঁর আখাঙ্কিত উত্তর। এমন সময় রামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ জীবনে তাঁর ব্যাপক পরিবর্তন আনে।

সালটা ১৮৮০ ,নভেম্বর মাসে সুরেন্দ্র মিত্রের বাড়িতে এসেছেন স্বয়ং শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব। ঠাকুরের গান শোনার ইচ্ছা হলে প্রতিবেশী বিবেকানন্দের ডাক পড়লো। গান শুনে মুগ্ধ ঠাকুর বললেন, “একবার আসিস দক্ষিণেশ্বরে”।

পিতার হঠাৎ মৃত্যু নরেন্দ্রনাথের জীবনে বিপর্যয় নামিয়ে আনলো। প্রবল আর্থিক অনটন, শারিকি বিবাদ ও সংসার চালানোর তাগিদে শুরু করলেন শিক্ষকতা। কিন্তু বেশি দিন তিনি পারলেন না। আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতি টান তাঁর প্রবল; সংসারের মায়া জালে তিনি আবদ্ধ হবেন কেন!

প্রথমে অবিশ্বাসী নরেন শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব কে একেবারে উন্মাদ ভেবেছিলেন। তাঁর কাছে ঠাকুর ছিলেন মনোম্যানিয়াক। তাও তাঁর মনে হতো , “উন্মাদ হলেও ইনি মহাত্যাগী ও মহাপবিত্র এবং শুধু ওই জন্যই মানবহৃদয়ের শ্রদ্ধা, পূজা ও সম্মান পাবার যথার্থ অধিকারী।”

সাংসারিক জীবনে বিপর্যস্ত নরেন ছুটে গেলেন শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব এর কাছে। রামকৃষ্ণ বললেন-মায়ের কাছে গিয়ে যা চাওয়ার চেয়ে নে। তিন তিন বার কালী ঘরে গিয়েও কিছুই চাইতে পারলেন না। সব ভুলে তিনি চাইলেন-বিবেক, জ্ঞান ভক্তি। এইভাবেই ‘উদ্ধত তরুণ দার্শনিক নরেন্দ্রনাথ’ ‘তরুণ সাধক’ রূপে অবতীর্ণ হলেন। শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব মারা যান ১৮৮৬ সালের ১৫ ই আগস্ট রবিবার। মৃত্যুর আগের দিনগুলিতে তাঁর ছায়াসঙ্গী ছিলেন নরেন। তাঁর হাতেই শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব সপে দিলেন মানব উদ্ধারের মহান ব্রত। অবশেষে রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর স্বামীজি সহ তাঁর ১২ জন শিষ্য কোলকাতার নিকটবর্তী বরাহনগর অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করলেন রামকৃষ্ণ মঠ এবং সেখানে তাঁরা গুরুর কাছ থেকে শেখা সমস্ত আধ্যাত্মিক সাধনাগুলোর অনুশীলন করতে থাকেন |

অজানাকে জানা ও অচেনাকে চেনার উদ্যাম বাসনা ছিল বিবেকানন্দের মধ্যে। সালটা ১৮৮৮। পরিব্রাজক রূপে তিনি মঠ ত্যাগ করলেন। শুরু করলেন ভারত ভ্রমণ, পদব্রজে। বারানসী, আগড়া, বৃন্দাবন, আলওয়ার,নৈনিতাল, আলমোড়া, শ্রীনগর, দেরাদুন, ঋষিকেশ, হরিদ্বার এবং শেষপর্যন্ত হিমালয়েও যান তিনি। কন্যাকুমারী তে তিনি তিন দিন ধ্যান মগ্ন ছিলেন। তাঁর এই ভারত ভ্রমণ ভারতবাসীর প্রকৃত বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা তৈরি করেছিল। তিনি লিখলেন- “হে ভারত, ভুলিও না- নীচজাতি, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর তোমার রক্ত, তোমার ভাই। হে বীর সাহস অবলম্বন কর, সদর্পে বল- আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই। বল- মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মন ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই। সদর্পে ডাকিয়া বল, ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রান, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, ভারতের সমাজ আমার শিশুশয্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বার্ধক্যের বারানসী। বল ভাই- ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ। ভারতের কল্যান, আমার কল্যান।” তাঁর কাছে সব ভারতবাসী একে অপরের ভাইবোন।
আধ্যাত্মিকতা ও ধর্ম এর নামে তিনি জাতির মধ্যে বিভেদে বিশ্বাসী ছিলেন না।

মাদ্রাজের স্বামীজীর শিষ্যরা স্থির করলেন স্বামীজী কে শিকাগোর বিশ্ব ধর্মমহাসম্মেলনে পাঠানো হবে। স্বামীজী স্বপ্ন দেখলেন স্বয়ং ঠাকুর রামকৃষ্ণ তাঁকে বলছেন- ওরে নরেন যা, পশ্চিমে যা। মনে কোনো সংশয় রইলো না। অবশেষে এলো সেই যাত্ৰার দিন-১৮৯৩ এর ৩১ শে মে।

শিকাগোর ধর্মসভায় বিবেকানন্দের বাণী বিশ্ববাসীর কাছে ভারতবর্ষের ধারণা বদলে দিয়েছিলেন। ভারতবর্ষের ইতিহাস, বৈচিত্র্য ও বাহুত্যবাদ ,ধর্মভাবনা, সহনশীলতা, বিশ্বভ্রাতৃত্ব বোধ
সারা বিশ্ববাসীর আলোচনার বিষয় বস্তু হয়ে ওঠে। “হেরাল্ড” পত্রিকায় লেখা হয়, ‘ধর্মমহাসভায় বিবেকানন্দই অবিসংবাদিরূপে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। তাঁর বক্তৃতা শুনে আমরা বুঝতে পারছি যে, এই শিক্ষিত জাতির মধ্যে ধর্মপ্রচারক প্রেরণ করা কত নির্বুদ্ধিতার কাজ’। স্বামীজীর মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ভারতে চলে এলে আইরিশ মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল যিনি পরবর্তী কালে ভগিনী নিবেদিতা নামে পরিচিত হন।

স্বামী বিবেকানন্দের কলম থেকে একের পর এক লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। তাঁর লেখা বিশেষ বিশেষ গ্রন্থগুলি হলো- সংগীতকল্পতরু” (১৮৮৭),”কর্মযোগ” (১৮৯৬) ,”রাজযোগ” (১৮৯৬ ), ” Vedanta Philosophy: An Address Before the Graduate Philosophical Society” (১৮৯৬), “Lectures from Colombo to Almorah” (১৮৯৭), ” বর্তমান ভারত” (১৮৯৯), “My Master” (১৯০১), “বেদান্ত ফিলোসফি: লেকচার্স অন জ্ঞানযোগ”(১৯০২) ইত্যাদি।

১লা মে ১৮৯৭ সালে বিবেকানন্দ অবশেষে কলকাতায় এলেন এবং প্রতিষ্ঠা করলেন রামকৃষ্ণ মিশন। যে ভারতবর্ষ তিনি দেখেছিলেন তার নব রূপায়ণই ছিল রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য। নতুন ভারত নির্মান ও মানুষের সেবার জন্য আধুনিক স্কুল,কলেজ এবং হাসপাতাল তৈরি সহ দরিদ্র ভারতবাসীকে নিঃশর্ত সেবায় ছিল এর প্রধান কাজ। ১৮৯৮ এ প্রতিষ্ঠা করেন বেলুড় মঠ।

অবশেষে ৪ঠা জুলাই ১৯০২ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে দেহত্যাগ করলেন স্বামীজী। ধ্যান মগ্ন অবস্থায় তিনি পার্থিব জগৎ ছেড়ে চলে যান অনন্তলোকের উদ্দেশ্যে।

স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন একজন যুগপুরুষ। বর্তমান এ অসহনীয় এক মহামারী বিধস্ত ভঙ্গুর উত্তর আধুনিক ভারতবর্ষ তথা সমগ্র বিশ্বের মানবসমাজের বিবেক, বুদ্ধি, জ্ঞান, চেতনা,মায়া,মমতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, সহনশীলতা,সার্বজনীনতা, প্রেম, ভালোবাসা কে জাগ্রত করতে একজন বিবেকানন্দ কে খুব দরকার বলে মনে হচ্ছে যিনি চিৎকার করে বলতে পারবেন- ” ব্রহ্ম হতে কীট-পরমাণু, সর্বভূতে সেই প্রেমময়,/
মন প্রাণ শরীর অর্পণ কর সখে, এ সবার পায়।/বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?/জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।”

Related posts

সবকিছু স্বাভাবিক হচ্ছে কিন্তু এখনও লক খোলেনি লাইব্রেরীর

E Zero Point

নতুন জেলা সভাপতিকে নিয়ে সভা তৃণমূল কংগ্রেসের

E Zero Point

বৃক্ষরোপন কর্মসূচী হুগলীতে

E Zero Point

মতামত দিন