02/05/2024 : 1:56 PM
বিনোদন

শততম জন্মদিনে ভানু বন্দোপাধ্যায়ের জীবনের পাতা থেকে

সুব্রত দে

সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায় যিনি আমাদের কাছে ভানু বন্দোপাধ্যায় নামে পরিচিত বাংলা তথা ভারতের সিনেমা জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং হাস্য-কৌতুকের রাজা বলে পরিচিত।আজকের দিনে ২৬শে আগস্ট১৯২০ সালে ঢাকা বিক্রমপুরে তাঁর জন্ম। মা সুনীতি দেবী, বাবা জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নবাবী স্টেটের উঁচু পদে চাকরি করতেন।বাবা-মা নাম রাখলেন সাম্যময়,যদিও গণস্মৃতিতে সেই নামের চিহ্নমাত্র নেই।

মুন্সিগঞ্জের সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুল হয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইএ পাশ করেন।স্নাতকস্তরে ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।সেখানে তখন কার্যত চাঁদের হাট।বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর প্রিয় ছাত্র ছিলেন ভানু।কবি জসীমউদ্দিন ও মোহিতলাল মজুমদার,রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতো শিক্ষকদের স্নেহ তাঁর কাছে ছিল আজীবনের সম্পদ।কলেজে পড়তে পড়তে স্বদেশী করেছেন প্রাণের তোয়াক্কা না করে দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।পাচার করেছেন রিভলবার ও..!!
দীর্ঘদিন কলেজে অনুপস্থিত.. জসিমউদ্দিন তাকে ডেকে বলেছেন আর পরীক্ষা দিতে দেবেন না..।উল্টে জসিমউদ্দিন সাহেব কে মজা করে বলেছেন “আমাকে পরীক্ষায় বসতে না দিলে রেডিওতে আর আপনার কবিতা পড়ব না”…তখন ঢাকা রেডিওতে ঘোষক ছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।হা হা করে হেসে ফেলেছিলেন জসীমউদ্দিন।ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সত্যেনদা বলে ডাকার অধিকার ছিল একমাত্র তাঁরই।সত্যেনবাবুর বাড়িতেই ভানুর কৌতুক-কথনের সূচনা।তাঁর জন্মদিনে দেখা করতে আসতেন বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরা।সেই সমাবেশে কমিক বলার জন্য ডাক পড়ত সাম্যময়ের।ভানুর প্রতি সত্যেনবাবুর স্নেহ অটুট ছিল শেষ দিন পর্যন্ত।ভানু যখন বিখ্যাত চিত্রতারকা,তখনও তাঁকে ডেকে পাঠাতেন প্রবীণ মাস্টারমশাই।বলতেন, ‘মাথা যে শুকিয়ে কাঠ হয়েে গেল আমার, একটু রস ঢেলে দিয়ে যা…, পরবর্তী কালে বহু বার সত্যেনবাবুর কথা বলেছেন ভানু।

ঠিক যে ভাবে বার বার বলেছেন তাঁর দীনেশদা,শহীদ দীনেশ গুপ্তের কথা।মাত্র ১২ বছর বয়সে জড়িয়ে পড়েছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে।গোপনে বিপ্লবী বই,প্রচারপত্র এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছে দেওয়া,রিভালবাড় পাচার- কী করেননি ভানু! প্রথমে ঘনিষ্ঠতা ছিল বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্সের সঙ্গে।সেই পর্বে তাঁর আদর্শ ছিলেন দীনেশ গুপ্ত।প্রথম বিপ্লবী রাজনীতির পাঠ নিয়েছিলেন তাঁর কাছেই।ভানুকে নিজের সাইকেলের পিছনে বসিয়ে দীনেশ শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে চড়কি পাক দিতেন।বিদেশি সিনেমা দেখাতেন,বুঝিয়ে দিতেন সিনেমার বিভিন্ন দৃশ্য।শোনাতেন রবীন্দ্রনাথের গান।ভানুও তাঁর দীনেশদার জন্য ঢাকার টাঙাওয়ালা কুট্টিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে আনতেন পুলিশের গতিবিধির খবরাখবর।দীনেশ গুপ্তের সূত্রেই কিশোর ভানুর আলাপ হয়েছিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অন্যতম নায়ক অনন্ত সিংহ এবং অলিন্দ যুদ্ধের আর এক যোদ্ধা বিনয় বসুর সঙ্গে।এমন করেই গানে-গল্পে পোড় খেয়ে উঠল ভানুর স্বদেশী চেতনা।তার পর বিনয় আর বাদলের সঙ্গে মিলে রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ করলেন দীনেশ।হয়ে উঠলেন অলিন্দ যুদ্ধের মরণজয়ী নায়ক।ব্রিটিশের হাতে মৃত সেই অসমসাহসী যুবকের স্মৃতি চিরকাল বেঁচে রইল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বুকে। যতদিন বেঁচে ছিলেন,প্রতি বছর ভানু উপস্থিত হতেন দীনেশের শহীদ স্তম্ভের কাছে। শ্রদ্ধা নিবেদন করে চুপ করে বসে থাকতেন কিছুক্ষণ।দীনেশ গুপ্তের মৃত্যুর পর ভানুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে অনুশীলন সমিতির।উল্লেখ্য, ঢাকার অনুশীলন সমিতি ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী।তাদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে ১৯৪১ সাল নাগাদ পুলিশের নজরে পড়লেন ভানু। গ্রেফতারি এড়াতে ঢাকা ছাড়তে হল তাঁকে।গাড়ির পিছনের সিটের নীচে শুয়ে চলে এলেন কলকাতায়।তত দিনে অনুশীলন সমিতির বিপ্লবীদের একাংশ মার্কসবাদী হয়ে উঠেছেন। তৈরি হয়েছে বামপন্থী দল আরএসপি।ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় সেই নতুন দলের উৎসাহী সদস্য।ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ নিল আরএসপি।পুলিশের খাতায় নাম থাকায় ভানুকে সাবধানে থাকতে বললেন নেতৃত্ব।কিন্তু দীনেশ গুপ্তের শিষ্যকে রুখবে কে।নিষেধ অমান্য করে অংশ নিলেন আন্দোলনে। ভাগ্যক্রমে গ্রেফতার হতে হল না।

কলকাতায় আসার পর শুরু হল ভানুর নতুন জীবন। আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানিতে চাকরি নিলেন। থাকতে শুরু করলেন বালিগঞ্জের অশ্বিনী দত্ত রোডে,বোনের বাড়িতে। কিছুদিনের মধ্যেই বসবাস শুরু হল চারু অ্যাভিনিউতে। ততদিনে ভানু জড়িয়ে পড়েছেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সঙ্গে।লাল-হলুদ জার্সি মাঠে নামলে ভানু গ্যালারিতে থাকবেনই।ইস্টবেঙ্গলের সদস্যপদ তো নিয়েছিলেন বটেই,ম্যাচের আগে শচীন দেববর্মনের মতো বিশিষ্ট ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের আপ্যায়ণের ব্যবস্থা, সদস্যদের কার্ড চেক করে গ্যালারিতে ঢোকানো- সব কিছু করেছেন ভানু।

পাঁচের দশকের শেষ পর্যন্ত ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল ভানুর।সেই সময়ে লাল-হলুদের প্রবাদপ্রতীম পঞ্চপাণ্ডব ছিলেন তাঁর বন্ধু।তৎকালীন তারকা পাখি সেন, রাখাল মজুমদার, ছোনে মজুমদারদের সঙ্গে হৃদ্যতা ছছিল তাঁর।বসুশ্রীতে চলচ্চিত্র জগতের আড্ডাতেও ভানুর সূত্রে উপস্থিত হতেন ইস্টবেঙ্গলের খেলোয়াড়েরা।

কলকাতায় অভিনয়শিল্পী হিসাবে ভানুর আত্মপ্রকাশ ১৯৪৬ সালে, চন্দ্রগুপ্ত নাটকে চাণক্যের ভূমিকায়।ওই বছরই বিয়ে করলেন বেতার শিল্পী নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বিয়ের পরেই প্রথম সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ এল। ১৯৪৯ সালে ‘মন্ত্রমুগ্ধ’, ১৯৫১ সালে ‘বরযাত্রী’, ১৯৫২ সালে ‘পাশের বাড়ি’ জনপ্রিয় হয়। ১৯৫৩ ‘মহারাজ নন্দকুমার’,’লাখ টাকা’ তবে ওই সময় মুক্তি পাওয়া ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায় ভানুকে।এর পর থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি।পর পর সাফল্য পান ওরা থাকে ও ধারে ,ভানুপেল লটারী,গল্প হলেওসত্যি।হিন্দি সিনেমাতে ‘বান্দিস’,’এক গাঁও কি কাহানী’ তে অভিনয় করেন কিন্তু অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বলার জন্য এই লেখা নয়।আমরা খুঁজছি মানুষ ভানুকে,যাঁর সত্তা চিরকাল প্রাণিত হয়েছে কৈশোরের আদর্শবাদের প্রভাবে।
বিয়ের পরেই সদ্য বিয়ে হওয়া নতুন বউকে নিয়ে ট্রামে চড়ে বেড়াতে গিয়ে মস্তান পিটিয়েছেন.. এদিকে ভয়ে জড়সড় স্ত্রী..

বাংলার সব মাসিমার কাছে মালপো খেয়েছেন সানন্দে.. “মাসিমা মালপোয়া খামু”.. দৃশ্যের শুটের পরে বাইশ খান মালপোয়া খেয়েছেন..।
পথের পাঁচালি দেখে আনন্দের চোটে কাউন্টারে বসে টিকিট বিক্রি করছেন.. অবাক হয়ে মজা করে বলেছেন “ব্যাঙ যে মইরা গেলে চিত হইয়া থাকে সত্যজিৎ রায় শহরের লোক হইয়া জানল কি কইরা..!”
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় কে কেডসের জুতো কিনে দিয়েছেন.. প্রচন্ড দুরবস্থা তখন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় এর.. ডেকে কাজ দিয়েছেন.. মঞ্চে টেনে এনেছেন.. আগলে রেখেছে বোড়ো দাদার মোতো।উত্তমকুমার এর সংসার খরচের টাকার অঙ্ক টা জানতে পেরে চোখ কপালে তুলে বলেছেন ” এত টাকা..! কস কী..? সোনা খাস নাকি..??”
উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেনের রেকর্ডের চেয়েও তার হাসির নাটক এর রেকর্ড এর বিক্রি বেশী ছিল।
শরীরে না দিলেও স্রেফ দর্শকের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে একের পর এক নাটকের শো করে গেছেন তাঁর আরাধ্য দেবতা ছিলেন চার্লি চ্যাপলিন।
অভিনয় জীবনের মধ্য গগনে থাকার সময়ই তিনি সক্রিয় হয়েছেন শিল্পী কলাকুশলীদের সংগঠনে।কখনও মেনে নিতে চাননি প্রযোজকদের আধিপত্য। ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে যখন ধর্মঘট চলছে,তখন ভানু এগিয়ে আসেন সংহতিতে।সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপী গাইন, বাঘা বাইন’সিনেমার রিলিজের সময় জটিলতা তৈরি হলে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছেন পরিচালকের পাশে।বিভিন্ন সময় একটানা আন্দোলন করেছেন অভিনেতৃ সংঘ এবং শিল্পী সংসদের ব্যানারে।একটা সময়ে টানা ৫ বছর তাঁকে ব্ল্যাক লিস্ট করা হয়।খ্যাতির শীর্ষে থেকেও কাজ পেতেন না তিনি।কিন্তু তা-ও আপোসের রাস্তায় হাঁটেননি দীনেশ গুপ্তর শিষ্য।ছায়াছবি ছেড়ে মন দেন জলসা,বোর্ড থিয়েটার,কৌতুকের অনুষ্ঠানে।তত দিনে শরীরও ভেঙে পড়তে শুরু করেছে।তা নিয়েই ঘুরে বেড়িয়েছেন এক জেলা থেকে অন্য জেলায়।কিন্তু হার মানেননি কিছুতেই।
ভানু বন্দ্যোোপাধ্যায়য়ের গভীর প্রত্যয় ছিল সমাজতন্ত্রে।গর্ব করে বলতেন,”বাবা আমার নাম রেখেছেন সাম্যময়।আমি একজন সাম্যবাদী।সাম্যের স্বপ্ন আমার নামের সঙ্গে লগ্ন হয়ে আছে।” সম্ভবত সেই জন্যই ঢাকার বাঙাল সাম্যময় কেবল এক জন অভিনেতা নন,বরং এক পূর্ণ,একরেখা মানুষ,যিনি চির কাল দাঁড়়িয়ে থেকেছেন আদর্শের জমিতে।নিজেকে নিয়ে মজা করে বলতেন,’ছিলাম বাঁড়ুজ্জ্যে, হয়ে গেলাম ভাঁড়ুজ্জ্যে’।তবে বাঙালি জানে,ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ভাঁড়ামি করেননি কোনও দিন।তাঁর কমিকে ঝলসে উঠেছে মেধার দীপ্তি,সমকালের সংকটের টুকরো ছবি।যদিও কমেডিয়ান ছাড়াও আরও অনেক কিছুই হতে পারতেন তিনি।হতে পারতেন স্বদেশী যুগের বিপ্লবী,বামপন্থী দলের হোলটাইমার, পুলিশের হাতে ধরা পড়লে অনেকগুলো বছর থাকতে হতে পারত কারাগারেও।কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঢাকা বিক্রমপুরের সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে উঠলেন তর্কযোগ্য ভাবে বাঙালির সর্ব কালের শ্রেষ্ঠ কৌতুক অভিনেতা।অথচ অন্য সম্ভাবনাগুলির সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ হয়নি কখনও।তাই খ্যাতির তুঙ্গে পৌঁছেও তাঁকে কার্যত এক ঘরে করে দিয়েছিল ইন্ডাস্ট্রি।কারণ তিনি অবস্থান বদলাননি,হাত ছাড়েননি আদর্শবাদী যাপনের।পাচ বছর কাজ পাননি সেই সময়ে অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেতা,গ্রামে গ্রামে ঘুরে যাত্রা করে পেট চালিয়েছেন।কিন্তু মাথা নত করেননি।করবেন কী করে! তাঁর জীবনের আদর্শ যে শহীদ দীনেশ গুপ্ত!বিনয়-বাদল-দীনেশের সেই দীনেশ,যাঁর সাইকেলের পিছনে বসে ভানুর অনেকগুলো বছর কেটেছে।

Related posts

ছোট পোশাকে ব্যায়াম করায় অভিনেত্রীকে হেনস্তা

E Zero Point

দুর্গাপুরে ‘ সুর ও সপ্তক ’ আয়োজিত শাস্ত্রীয় সংগীতের উৎসব

E Zero Point

অনলাইনে নজরুল জয়ন্তীঃ সম্প্রীতির নজরুল – তৃতীয় পর্ব

E Zero Point

মতামত দিন