18/04/2024 : 1:37 AM
আমার দেশবিজ্ঞান-প্রযুক্তি

নোবেলজয়ী পদার্থবিদ স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমনের জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

দিগন্তিকা বোস


১৮৮৮ সালের আজকের দিনে ভারতরত্ন নোবেলজয়ী পদার্থবিদ স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমনের জন্ম। তাঁর বাবা প্রথমে থিরুওয়ানাইকোভিলের একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন পরে তিনি গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানে অধ্যাপক হন। স্যার সি ভি রামন সেন্ট আলয়সিয়াস অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান হাইস্কুলে পারতেন । এগারো বছর বয়সে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ১৩ বছর বয়সে বৃত্তির সহ এফ.এ পরীক্ষার পাশ করেন ।
১৯০২ সালে স্যার রামন মাদ্রাজে প্রেসিডেন্সি কলেজে, যোগ দেন । ১৯০৪ সালে তিনি মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাচেলর ডিগ্রি পরীক্ষায় প্রথম স্থান সহ উত্তীর্ণ হন এবং পদার্থবিদ্যায় স্বর্ণপদক পান।

১৯০৭ সালে ডিস্টিংসান নিয়ে তিনি মাস্টার ডিগ্ৰি অর্জন করেন। এর পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের প্রথম অধ্যাপক পদে নিযুক্ত
এই বরেণ্য পদার্থবিদ্ আমাদের প্রানের শহর কলকাতাতেই ১৯২৮ সালের ২৮ শে ফেব্রুয়ারি ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব কাল্টিভেশন অব সায়েন্সে বসেই তিনি আলোক বিচ্ছুরণের গতিপ্রকৃতি বিষয়ক গবেষণায় করেছিলেন আলোকের বিচ্ছুরণ সম্পকৃত রমন এফেক্ট। যা ১৯৩০ সালে তাঁকে এনে দিয়েছিল সমগ্ৰ বিশ্বের বিজ্ঞান গবেষণার সর্বোচ্চ স্বীকৃতি – নোবেল পুরস্কার।১৯২৮ – ২৭ শে ফেব্রুয়ারী।

ভারতীয় এক বিজ্ঞানী ঠিক করলেন বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে আলোর বিক্ষেপণে পরিবর্তিত বর্ণালী পর্যবেক্ষণ করবেন। এসোসিয়েশানের ল্যাবোরেটরিতে সারাদিন ধরে চল্ল যন্ত্রপাতি ব্যবস্থা করা। এদিকে সূর্য ডুবে গেল। তাই আলোর অভাবে সেদিন আর কিছু হলো না। পরদিন সূর্য ওঠার পর পরই শুরু হলো পর্যবেক্ষণ। দেখা গেলো নির্দিষ্ট বর্ণের আলোর বর্ণালীর পাশে আরেকটি ভিন্ন বর্ণের আলোক রেখা “রমন রেখা”। আবিষ্কৃত হলো ‘রমন ইফেক্ট’! সংযুক্ত করা হলো একটা মার্কারি আর্ক যেখান থেকে পাওয়া গেল এক বর্ণের উজ্জ্বল সাদা আলোক রেখা। এই আলোতে নীল বর্ণের তরঙ্গদৈর্ঘের চেয়ে লম্বা অন্যসব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোক রেখা ঢাকা পড়ে যাবার কথা। ঢাকা পড়ে গেলো ঠিকই, কেবল নীল-সবুজ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সীমানায় দুটো নতুন রেখা ছাড়া। এই নতুন রেখা সৃষ্টি হয়েছে যে বিক্ষেপণের প্রভাবে তার নাম দেয়া হলো ‘রমন ইফেক্ট’।


পরদিন ১৯২৮ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সারা পৃথিবী জেনে গেলো ‘রমন ইফেক্ট’ আবিষ্কৃত হয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলো ‘নিউ থিওরি অব রেডিয়েশান’। নেচার জার্নালে পাঠানো হলো ‘রমন ইফেক্ট’ সংক্রান্ত নোট। কিন্তু তা প্রকাশযোগ্য নয় বলে পেপার প্রত্যাখ্যাত হলো। কিন্তু নেচার জার্নালের এডিটরের নজরে আসার পর এটার গুরুত্ব বুঝে প্রকাশিত হলো ‘রমন ইফেক্ট’ । পরবর্তি দুই বছরের মধ্যে ১৯৩০ সালেই ‘রমন ইফেক্ট’ আবিষ্কারের জন্য নোবেল-পুরষ্কার পেলেন স্যার সি ভি রমন।
নোবেল পুরষ্কার পাবার পর খ্যাতি ও সাফল্যের শীর্ষে উঠে গেলেন স্যার সি ভি রমন। মহেন্দ্রলাল সরকারের স্বপ্ন সার্থক হলো রমনের হাতে। অনেক ছাত্র-ই রমনের তত্ত্বাবধানে গবেষণা করার জন্য উৎসাহী হয়ে উঠলো। ১৯৩২ সালের শেষের দিকে ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের পরিচালক পদ গ্রহণের জন্য ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের কাউন্সিল তাঁকে অনুরোধ করলেন।


১৯৩৩ সালে ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের পরিচালক পদে যোগ দিলেন রমন। হিটলারের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আইনস্টাইন সহ আরো অনেক পদার্থবিজ্ঞানী ইউরোপ ত্যাগ করে চলে যাচ্ছিলেন এ সময়। রমন ভাবলেন এঁদের কাউকে যদি ভারতে নিয়ে আসা যায় ভারতে বসেই ইউরোপীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করা সম্ভব।
কাজ শুরু করে দিলেন রমন। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অন্যতম জনক ম্যাক্স বর্নের জন্য ইনস্টিটিউটে পদার্থবিজ্ঞানের বিশেষ প্রফেসর পদ সৃষ্টি করলেন। রমনের তালিকায় আরো অনেকের নাম ছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে বেশিদূর আগাতে পারলেন না তিনি – প্রশাসনিক জটিলতায়। ফলে এখানেও সমস্যা হলো। পরিচালক পদ থেকে সরে আসতে হলো তাঁকে। তবে ইনস্টিটিউটে তাঁর প্রফেসর পদ বহাল রইলেন।


১৯৩৪ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন ইন্ডিয়ান একাডেমি অব সায়েন্স এবং সারা ভারতের প্রতিভাবান বিজ্ঞানীদের একাডেমির ফেলোশিপ দেয়ার ব্যবস্থা করলেন। পরবর্তী বিশ বছরের মধ্যে ইন্ডিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সের প্রসিডিংস পৃথিবীর সেরা জার্নালের তালিকাভুক্ত হয়। ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ইনস্টিটিউটের প্রফেসর হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। এই সময় তিনি বহু বিচিত্র বিষয়ে গবেষণা করেছেন। কঠিন পদার্থের থার্মো-অপটিক, ফটো-ইলাস্টিক, ম্যাগনেটো-অপটিক বিহেভিয়ার, সেকেন্ড অর্ডার রমন ইফেক্ট, ইনফ্রারেড স্পেক্ট্রোস্কপি ইত্যাদি বিষয়ে । তাঁর ছাত্র কৃষ্ণান সেমিকন্ডাক্টর ফিজিক্সে নতুন তত্ত্ব আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তাঁকে কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে হয়। কৃস্টাল ম্যাগনেটিজমের ওপর তাঁর সংগৃহীত সব তথ্য নষ্ট হয়ে যায়। ১৯৪৮ সালে তিনি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট থেকে অবসর গ্রহণ করেন। স্বাধীন ভারত সরকার তাঁকে দেশের প্রথম জাতীয় অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেন। এসময় তিনি একটা রিসার্চ ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন। বিভিন্ন জনের সাহায্য প্রতিষ্ঠানটি শুরু করা গেলেও অর্থাঅভাব থেকেই গেল। এর পর একজন প্রাক্তন ছাত্রের সহযোগিতায় দুটো রাসায়নিক কারখানা খুলে সেগুলোর লভ্যাংশ থেকে ইনস্টিটিউট চালানোর ব্যবস্থা করলেন। ষাট বছর বয়সে রামন রিসার্চ ইনস্টিটিউট স্থাপন করে পরবর্তী বাইশ বছরে তাঁর এই প্রতিষ্ঠান থেকেই প্রায় দু’শ গবেষণা-পত্র প্রকাশ করেছেন রমন।


১৯৫৪ সালে রমনকে ভারত রত্ন উপাধি দেয়া হয়। জীবনের শেষ কয়েকটি বছরে তিনি সব ধরণের সংগঠনের সাথে যোগাযোগ ছিন্ন করে পুরোপুরি স্বাধীন হয়ে যেতে চেয়েছিলেন। ১৯৬৮ সালে রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ ফিরিয়ে দেন। রয়েল সোসাইটির ইতিহাসে এটা ছিল একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা। ১৯৭০ সালের ২১শে নভেম্বর রমনের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর অনেকদিন আগেই তিনি বলেছিলেন মৃত্যুর পর যেন কোন রকমের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা করা না হয় তাঁর জন্য। তিনি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নিলেও, সারাজীবন মাথায় একটা টুপি বা পাগড়ির আচ্ছাদন দিয়ে রাখলেও ধর্ম নিয়ে কখনো মাথা ঘামাননি। তাঁর মাথার পাগড়ি সম্পর্কে একবার প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “এটা না থাকলে কি সেদিন রাদারফোর্ড আমাকে চিনতে পারতেন? এটা আমার পরিচয়”। তাঁর ইচ্ছানুসারে তাঁর ইনস্টিটিউটের বাগানে তাঁকে সমাহিত করা হয় এবং কোন ধরণের সমাধি-ফলক বা সমাধি-সৌধ এর বদলে সেখানে একটা গাছ লাগিয়ে দেয়া হয়।
রামন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বাগানে এই গাছের নিচে রমনকে সমাহিত করা হয়।
১৮৮৮ সালের ৭ ই নভেম্বর আজকের দিনে জন্ম হয় ভারতের প্রথম নোবেলজয়ী এই বিজ্ঞানীর।
তাঁকে শ্রদ্ধার সহিত স্মরন করছি।
(লেখাটির বেশিরভাগ অংশ মুক্তমনা.কম – উইকিপিডিয়া থেকে সাহায্য নেওয়া হয়েছে।)

Related posts

মিউকরমাইকোসিস থেকে নিরাপদে থাকুন, ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের নিয়মিত রক্তের শর্করা পর্যবেক্ষণ করে সজাগ থাকুন

E Zero Point

আজ সীমান্তে ভারত-চিন বৈঠক, এলএসি-তে বাড়ছে উড়ান গতিবিধি

E Zero Point

সীমান্তে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোগত ব্যবস্থা

E Zero Point

মতামত দিন