17/05/2024 : 2:04 PM
জীবন শৈলীধর্ম -আধ্যাত্মিকতা

যার আছে হাতে কড়ি সে যাবে শিবের বাড়ি – জানেন কি শিবের বাড়ি কোথায়?

জিরো পয়েন্ট বিশেষ প্রতিবেদন, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩:


অজয় কুমার দে


উত্তর রাঢ়ের একটি প্রচলিত ছড়ায় জনরুচি ও সামর্থ্য অনুযায়ী ভ্রমণকারীদের উদ্দেশ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এই ভাবে:
যার আছে হাতে কড়ি সে যাবে শিবের বাড়ি
যার আছে লম্বা কোঁচা সে যাবে চৌরিগাছা
যার আছে কন্ঠিমালা সে যাবে বৈরাগীতলা।

চৌরীগাছা ও বৈরাগীতলা উভয়ই রাঢ়ের দুটি পরিচিত স্থান। চৌরীগাছার অধিবাসীদের শৌখিনতা ও বৈরাগীতলার বৈষ্ণবগণের ভক্তিপরায়ণতা এই ছড়ার মধ্যে সুস্পষ্ট ভাবে প্রকাশিত। কিন্তু এই দুই স্থানের সাথে শিবের বাড়ির নাম কেন?

সবাই জানে শিবের বাড়ি কৈলাস পর্বতে। তবে রাঢ়ের চৌরীগাছা ও বৈরাগীতলার সাথে এই নাম কেন? তবে কি রাঢ়ের জনমানসে শিবের অন্য কোন বাসস্থান আছে? উত্তর হলো হ্যাঁ। এই শিবের বাড়ি কৈলাস নয়; বাজারসৌ সংলগ্ন শক্তিপুরের প্রসিদ্ধ শৈবতীর্থ কপিলেশ্বর।
আজও বাজারসৌ শক্তিপুরকে ঘিরে আছে এক প্রাচীন খাত যা গঙ্গার সাথে যুক্ত। খাতটির গতিপথ দেখে মনে হয় প্রাচীন বজ্রাসন ধর্মরাজিকাকে ঘিরে এই পরিখা নির্মিত হয়েছিল নগর সুরক্ষার কারণে। পরিখার পাশ দিয়ে যে সরণী চলে গেছে তা প্রাচীন অথচ চিরকালীন। যে অশ্মাচ্ছাদিত পথ তাম্রলিপ্ত থেকে কর্ণসুবর্ণ হয়ে আর্যাবর্তের মধ্য দিয়ে বিস্তৃত ছিল ; এই পথ সেই উত্তরাপথেরই অন্তর্গত।

এই পথেই বজ্রাসন ও রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার দর্শনে এসেছিলেন চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং। বজ্রাসন নামটি থেকে মনে হয় সম্ভবত ধ্যানী বুদ্ধের ভূমিস্পর্শ মূর্তি এখানে ছিল। বজ্রাসন সন্নিহিত শক্তিপুরে লক্ষ্মণসেনের তাম্রশাসন পাওয়া গেছে। গৌড়াধিপতির প্রদেশপাল এখানে থেকে কঙ্কগ্রামভুক্তির প্রান্তদেশ রক্ষা করতেন।

সেই ইতিহাসগন্ধী শক্তিপুরে বাঙালির প্রথম প্রতিভা, বেদবর্ণিত আদিবিদ্বান , বেদাতীত সাঙ্খ্যের প্রবক্তা কপিল মুনির নামাঙ্কিত গঙ্গাতটস্থ কপিলেশ্বর। রাঢ়ের আপামর জনগণ এই শৈবক্ষেত্রকে বলে শিবের বাড়ি। সমগ্র রাঢ়দেশই শিবভূমি। কিন্তু এই অঞ্চলের অগণিত শৈবতীর্থের মধ্যে আজও কপিলেশ্বরের খ্যাতি সর্বাধিক। স্মরণাতীত কাল থেকে শুরু করে কিছুদিন আগে পর্যন্ত রাঢ়ের গ্রামগুলির এক অলিখিত নিয়ম ছিল। শিবচতুর্দশীর রাতে বিধিমতো শিবার্চনা করে গ্রামের মহিলারা গোশকটারূঢ় হয়ে এবং অবশ্যই অত্যুৎসাহী শিশুবাহিনী পরিবেষ্টিত হয়ে যাত্রা করতেন শিবের বাড়িতে।

পূর্ব আকাশে ভুলকু অর্থাৎ শুকতারার উদয়ের সাথে যাত্রা করে সকালে শিবের বাড়ি পৌঁছিয়ে কপিলেশ্বরের পূজা করে তবেই উপবাস ভঙ্গ করতেন। শিবরাত্রি উপলক্ষে শিবের বাড়ির মেলা হয়ে উঠত শুধু এই গ্রামবাসীদেরই নয়; দূরদূরান্ত থেকে আগত শৈবসাধকদের সমাগমধন্য।


কিন্তু কেন এই প্রথা? কেন কপিলেশ্বরের এই বিশিষ্টতা? ইতিহাস এবং জনশ্রুতি থেকে জানা যায় এই কপিলেশ্বরের মন্দির নির্মাণ করেছিলেন স্বয়ং গৌড়েশ্বর পরমশৈব পরমভট্টারক শ্রীমন্মহারাজ শশাঙ্কদেব। তবে কপিলেশ্বরের লিঙ্গমূর্তি সম্ভবত আরো প্রাচীন। কারণ এই শিবলিঙ্গকে অনাদিলিঙ্গ বলা হয়। বেলেপাথরের সুবিশাল কপিলেশ্বরের শিবলিঙ্গ হয়তো শশাঙ্কের আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। শশাঙ্ক হয়তো মন্দির নির্মাণ ও সংস্কার করেছিলেন।

কিংবদন্তি শোনা যায় শশাঙ্ক তাঁর গৌড়সাম্রাজ্যে প্রতি পাঁচ ক্রোশ অর্থাৎ প্রায় ১৬ কিমি অন্তর শিব প্রতিষ্ঠা করেন। আর এই কার্যক্রম শুরু হয়েছিল কপিলেশ্বর থেকে। মুকুটেশ্বর ডাহুকেশ্বর কলেশ্বর শিশুয়েশ্বর এই শৈবতীর্থসমূহ আজও সেই স্মৃতি বহন করছে। হয়তো শশাঙ্কের প্রথম শৈবকীর্তি হওয়ার ফলেই এই কপিলেশ্বরের ধাম লোকমানসে শিবের বাড়ি। হয়তো প্রাচীন গৌড়বঙ্গে শৈবসাধকগণ কপিলেশ্বর থেকে যাত্রা শুরু করে পাঁচ ক্রোশ অন্তর কোন শৈবতীর্থে বিশ্রাম নিতে নিতে পরিক্রমা করতেন বৃহৎ বঙ্গের শক্তিকেন্দ্রগুলি।

জাগিয়ে তুলতেন বঙ্গের জাতীয় চেতনাকে লোকায়ত শৈবধর্মের সরল অথচ তত্বদর্শী আঙ্গিকে। পরিক্রমা শেষে আবার হয়তো ফিরতেন এই কপিলেশ্বরে। তাঁদের চেতনায় এই বৃহৎ বঙ্গ যদি মহেশ্বরের বিচরণভূমি হয় তবে সেই ভূমিতে বৃষভধ্বজের প্রথম ও শেষ বিশ্রামগৃহ এই কপিলেশ্বর। তাই বঙ্গভূমিতে শিবের বাড়ি হলো কপিলেশ্বর।


কপিলেশ্বরের প্রাচীন মন্দির চল্লিশ বছর আগে গঙ্গার গতিপরিবর্তনের ফলে ধ্বংস হয়ে গেছে। সেই স্থানে এখন এক গঙ্গার জলপুষ্ট পুষ্করিণী নিজের গর্ভে সযত্নে লুকিয়ে রেখেছে শশাঙ্কদেবের করস্পর্শোজ্জ্বল কপিলেশ্বর মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর। নবনির্মিত মন্দিরে কপিলেশ্বরের বিগ্রহের সাথে স্থান পেয়েছে প্রাচীন মন্দিরটি থেকে উদ্ধার করা যন্ত্রমণ্ডল, কোন অধুনালুপ্ত বিগ্রহের পাদপীঠ ও একটি প্রস্তরস্তম্ভ। ঐ যন্ত্র থেকেই বোঝা যায় গুপ্তোত্তর যুগে পৌরাণিক শৈবধর্মের সাথে বঙ্গের আদি তন্ত্রের সমন্বয়; যা রচনা করেছিল যামল আগম নিগম প্রমুখের পটভূমিকা। একই সঙ্গে তীর্থক ও ব্রাহ্মণ্যপ্রধান শৈবধর্মের লোকায়ত ভাবমূর্তি আরো প্রকট হয়ে উঠছিল এই সময়।

বেদাতীত দর্শনের বৈরাগ্যময় পথে এ যেন পারমার্থিক আনন্দময়ের ঐহিকের মাটিতে পদার্পণের সূচনা। এই সেই ক্রান্তিকাল যখন একদিকে শশাঙ্কের মৃত্যুর ফলশ্রুতিতে বৃহৎ বঙ্গ ও উত্তরাপথে রাজনৈতিক ইন্দ্রপতনের মাধ্যমে ঘটতে লেগেছে মাৎস্যন্যায়ের বিভীষিকাময় উপস্থাপনা; অন্যদিকে তন্ত্রের হাত ধরে শৈব বৌদ্ধ প্রমুখ ধর্মের জনচিত্তপরায়ণ জীবনমুখী দর্শন নির্মাণ করছে ভবিষ্যতের পাল সাম্রাজ্যের শক্তিকেন্দ্র।

সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে শৈবধর্মের মতো চরম জনপ্রিয় ধর্মের অন্যতম মুখ্য কেন্দ্রস্থল রূপে শিবের বাড়ি রূপে কপিলেশ্বর মন্দির কতটা তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল তা হয়তো খুব কষ্টকল্পিত নয়। হয়তো বঙ্গবাসীর প্রাণের ভোলানাথের নামে উৎসর্গীকৃত এই তীর্থেই মাৎস্যন্যায়ভীত গৌড়বাসী সামগ্রিক একতার ভবিষ্যত বীজ বপন করত শিবরাত্রি উপলক্ষে বাৎসরিক সমাগমে। তারই ধূসর চিহ্ন রূপে ঐ প্রথা আর শিবের বাড়ির তকমা আজও ঘিরে থাকে কপিলেশ্বরের মন্দিরকে।

Related posts

কল্পতরু উৎসবঃ ‘‌তোমাদের চৈতন্য হোক’

E Zero Point

রান্নাঘরঃ ম‍্যাংগো হানি কুলফি

E Zero Point

আধ্যাত্বিক চেতনাবোধ ঘুরে দাঁড়ানোর একমাত্র পথ ভারতবাসীর

E Zero Point

মতামত দিন