রূপাঞ্জন রায়ঃ মগরা বান্ধব সম্মিলনী ক্লাবের উদ্যোগে ও মগড়া ব্যবসায়ীবৃন্দ ও স্থানীয়বাসীদের সহযোগিতায় গতকাল ৩ রা জুন সুন্দরবন অঞ্চলের প্রত্যন্ত ব্লক কুলতলিতে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যাওয়া হয়। আমফান ঝড়ে বিধ্বস্ত মাতলা নদীর তীরবর্তী কৈখালী, নিমতলা, কাছারি বাজার ও আরো অনেক কয়েকটি গ্রামের ৫০০ র বেশি পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয় খাদ্য সামগ্রী, বাচ্চাদের দুধ, মহিলাদের কথা ভেবে স্যানিটারি ন্যাপকিন, ত্রিপল, ওষুধ, জামাকাপড়, বাচ্চাদের খাতা পেন্সিল প্রভৃতি সামগ্রী । কুলতলী থানার অফিসার ইনচার্জ এই কর্মকাণ্ডকে সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে নিজে উপস্থিত থেকে সাহায্য করেন । হুগলি জেলার মগরার একমাত্র শতবর্ষ অতিক্রান্ত ক্লাব বান্ধব সম্মিলনীর সদস্যগন, পন করেছিল যে ভাবেই হোক পৌঁছে যাবে আমফান ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত সুন্দরবনের মানুষগুলোর কাছে। সংবাদ মাধ্যমে বা সামাজিক মাধ্যমেতে ভেসে ওঠা দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের করুন আর্তি তাদের হৃদয়কে বারবার ব্যাথিত করেছিলো। প্রথমে ঠিক হয়েছিলো ক্লাবের সীমিত সামর্থ্য নিয়ে কয়েকজন বাইকে চলে যাব। তারপর একটু একটু করে সংগৃহীত হতে লাগল মগরাবাসীর হৃদয় উজাড় করা ভালবাসা। তারাও যে সমব্যাথী। সঙ্কটের কল্পনাতে ম্রিয়মাণ হলে যে আর চলবে না। এ যে মানব সভ্যতার অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের সন্ধিক্ষণ। এই সঙ্কটকালে তারাও বাড়িয়ে দিলো সহযোগিতার হাত। মাত্র চার দিনে ৫০০ জনেরও বেশি মানুষকে সেবা করার মত ত্রাণ সামগ্রী সংগ্রহ হয়ে গেল। একটি বড় পিকআপ ভ্যানেরও প্রয়োজনীয়তা মিটিয়ে দিলেন মগরারই এক সহৃদয় ব্যবসায়ী। চতুর্দিক থেকে বহু মানুষের সহযোগিতার বার্তা এসে পৌঁছতে লাগলো। দিনরাত পরিশ্রম করে ক্লাবের সদস্যরা সেইসমস্ত ত্রানসামগ্রী বিতরন উপযোগী করে গাড়িতে বোঝাই করে ফেললেন প্রবল উদ্দীপনায়। এরপর শুধু ছিল সেখানে পৌঁছনোর অপেক্ষা।
বান্ধব সম্মিলনী কয়েকজন সদস্যর প্রচেষ্টায় একটি ট্রাভেলার গাড়ির বন্দোবস্ত করে শুরু হলো তাদের যাত্রা। একদম কাক ভোরে। বহুক্ষন সময় সময় অতিবাহিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গন্তব্য যেন আর ধরা দিচ্ছিল না। সকলে ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলো ও পথে যেতে যেতে দেখা গেল ঝড়ের ভয়াবহ চিত্র। এতদিন পরেও এখনো অমলিন। অবশেষে এসে পৌঁছালাম দক্ষিন ২৪ব পরগনার কুলতলি থানাতে। এ যেন এক পান্ডব বর্জিত এলাকা। চারিপাশে ধু ধু মাঠ আর দূরে জঙ্গল। আশেপাশে কোনো মনুষ্য বসতির চিহ্ন মাত্র নেই।
কুলতলি থানার এক অফিসার প্রবীর বাবু সমস্ত বিষয়টির খুব সন্দর ব্যবস্থাপনায় করলেন। থানা থেকে কয়েকজন সিভিক ভলেন্টিয়ারকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের তালিকা তৈরী করা হল।
বান্ধব সম্মিলনীর সভাপতি ধ্রুব পদ কুন্ডু জানান যে, ক্ষতিগ্রস্ত চারটি এলাকায় কৈখালী, গোপালগঞ্জ, কাছারিবাজার ও নিমতলা মানুষের দুর্দশা অবর্ননীয়। “করোনা মহামারি”, “সামাজিক দুরত্ব” এখানে গল্পকথা। এখানে মানুষের যেন একটাই মন্ত্র বাঁচতে গেলে আয় বেঁধে বেঁধে থাকি। বিদ্যুত ব্যবস্থা পুরোপুরি বিপর্যস্ত। কবে যে বহাল হবে তা ঈশ্বরই জানেন! এখনো ইলেকট্রিক পোল, ট্রান্সফর্মার ভেঙে পড়ে আছে। লোকজন ঝুঁকে পড়া বিদ্যুতর তারে জামাকাপড় মেলে রোদে দিয়েছে দেখলাম। তাদের জীবিকার একমাত্র মাধ্যম জমিটুকুও লবনাক্ত জলে অনুর্বরা হয়েছে। পানীয় জলের আকাল। মাথার উপর ছাদটাও অনেকের নেই। তবুও এরা আশ্চর্যজনক ভাবে শান্ত। শহুরে বাবুদের দু দিন বিদ্যুত না থাকার বিক্ষোভকে যেন এদের মুখের অমলিন হাসি পরিহাস করছে। অদৃষ্টের কাছে আর নতুন করে এদের আর কিছু চাওয়ার নেই। এরা বারেবারে ঘামরক্ত দিয়ে গড়ে তোলে, আবারও সব ভেঙে যায়। এ যেন অদৃষ্টের আনমনে পুতুল খেলা। কৈখালীর সেই অঞ্চলে আমরা গেলাম যেখানে বাঁধ ভেঙে সমুদ্রের জল ঢোকার ভয়াবহ দৃশ্য ঝড়ের পর সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল। মাতলা নদী এখন শান্ত। এখানে বাঁধ মেরামতির কাজ চলছে। পাশেই নদী তীরে নিমপীঠ রামকৃষ্ণ আশ্রমের একটি শাখা রয়েছে। মহারাজের সাথে কথা হলো। তিনি আমাদের আশীর্বাদ করলেন। এই আশ্রমও দেখলাম ক্ষতিগ্রস্ত।
বান্ধব সম্মিলনীর সম্পাদক দেবরাজ চক্রবতী জানান যে, ত্রানসামগ্রী হিসাবে চিড়ে, গুড়, মুড়ি, বাতাসা, ছাতু মোমবাতি, সাবান, চকলেট, ওআরএস, মহিলাদের স্যানিটারি ন্যাপকিন, কিছু ঔষধ, ত্রিপল, জামাকাপড় ওখানকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের হাতে তুলে দিলাম। আরো কিছু মানুষকে সাহায্য করতে পারলে ভালো হতো। এখানে চাহিদার থেকে যোগান সামন্যই। আপনারা যদি এভাবেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন তাহলে আমরা আবারও এই ধরনের প্রচেষ্টা চালাতে পারি।
সারাদিনের তপ্ত রৌদ্রকিরন বান্ধব সম্মিলনী সদস্যদের শরীরকে পোড়াতে পারলেও তাদের উদ্যমকে দমাতে পারে নি।