26/04/2024 : 11:38 PM
জীবন শৈলীধর্ম -আধ্যাত্মিকতা

কালীপুজো ও বলিদানঃ পশুপ্রেমীরা জেনে রাখুন- বলিদান শাস্ত্রসম্মত

জিরো পয়েন্ট নিউজ,  বিশেষ প্রতিবেদন, ৩ নভেম্বর ২০২১:


সুমন মিশ্র


 নানাবিধেশ্চৈ বলিভিঃ পূজাজাগরণদিভিঃ ।।
অষ্টম্যামুপুবাসেন নবম্যাং বলিদানতঃ ।
অর্চয়েন্মাং মহাভক্ত্যা যোগিনীশ্চাপি কোটিশঃ ।।
অষ্টমীনবমীসন্ধিকালোহয়ং বৎসরত্মকঃ ।
ত্রত্রৈব নবমীভাগঃ কালঃ কল্পাত্মকো মম ।।
( বৃহদ্ধর্মপুরাণ – পূর্ব খন্ড – দ্বাবিংশোধ্যায় )
অর্থাৎ- চণ্ডীদেবী বললেন- সপ্তমীতে গৃহে আসিয়া পূজা করিবে। তৎপর দুদিন নানাবিধ বলি , পূজা , জাগরণাদি দ্বারা আমার পূজা করিবে। বিশেষত মহা অষ্টমীতে উপবাস অবলম্বন পূর্বক এবং নবমী তে বিশেষ বলিদান দ্বারা ভক্তি সহকারে আমার পূজা করিবে
ভগবান শিবের বিষয়ক পুরাণ লিঙ্গপুরাণেও মাংসাদি দ্বারা পরমেশ্বরীর যজ্ঞের বিধান আছে-
“খরস্য চ উষ্টয় চ যথাক্রমম্‌ ”
( লিঙ্গপুরাণ… উত্তরভাগ … দ্বিপঞ্চাশ অধ্যায় – ১১)
অর্থাৎ- পরমেশ্বরীর যজ্ঞে পশুর মাংস আহুতি দিলে বিপদ থেকে তারন অর্থাৎ নিস্কৃতি পাওয়া যায় ।
কালিকাপুরাণে আছে-
বলিদানং ততঃ পশ্চাৎ কুর্য্যাদ্দেব্যাঃ প্রমোদকম্‌ ।
মোদকৈর্গজবক্ত্‌ঞ্চ হবিষা তোষয়েদ্রবিম্‌ ।।
তৌর্যত্রিকৈশ্চ নিয়মৈঃ শঙ্করং তোষয়েদ্ধরিম্‌ ।
চণ্ডিকাং বলিদানেন তোষয়েৎ সাধকঃ সদা ।।
( কালিকাপুরাণ… পঞ্চপঞ্চাশোধ্যায়… ১-২ )
অর্থাৎ- দেবীকে প্রয়োজন মত বলি দান করবে। শাস্ত্রে আছে মোদক দিয়ে গণেশকে , ঘৃত দ্বারা হরিকে , নিয়মিত গীত বাদ্য দ্বারা ভগবান শঙ্করকে আর বলি দিয়ে চণ্ডিকাকে তুষ্ট করিবে।
বলি কোন হিংসা নয়। উক্ত পুরাণেই আছে-
যজ্ঞার্থে পশবঃ সৃষ্ট্বা স্বয়মেব স্বয়ম্ভুবা ।
অতস্ত্বাং ঘাতয়ামাদ্য তস্মাদ্‌ যজ্ঞে বধোহবধ্‌ ।।
( কালিকাপুরাণ… পঞ্চপঞ্চাশোধ্যায়…. ১০ )
অর্থাৎ- ব্রহ্মা , স্বয়ং যজ্ঞের নিমিত্ত সকল প্রকার বলির সৃষ্টি করিয়াছেন , এই নিমিত্ত আমি তোমাকে বধ করি, এই জন্য যজ্ঞে পশুবধ হিংসার মধ্যে গণ্য হয় না।
এরপর দেখা যাক মার্কণ্ড পুরাণে স্বয়ং দেবী দুর্গা নিজ মুখে কি বলেছেন-
বলিপ্রদানে পূজায়ামগ্নিকার্য্যে মহোৎসবে ।
সর্ব্বং মমৈতচ্চরিতমুচ্চার্য্যং শাব্যমেব চ ।।
জানতাজানতা বাপি বলিপূজাং তথা কৃতাম্‌ ।
প্রীতিচ্ছিষ্যাম্যহং প্রীত্যা বহ্নিহোমং তথা কৃতম্‌ ।।
( মার্কণ্ড পুরাণ… দ্বিনবতিতম অধ্যায়…৯-১০ )
অর্থাৎ- স্বয়ং ভগবতী নিজ মুখে বলছেন, বলিপ্রদানে – পূজাকালে- যজ্ঞ কর্মে এমন মহা উৎসবে আমার এই সকল চরিত উচ্চারণ ও শ্রবন করা উচিৎ । জ্ঞানে বা অজ্ঞানে হোক বলি দিয়ে আমার পূজা , যজ্ঞ করলে সেই বলি ও যজ্ঞ আমি গ্রহণ করি ।
যজ্ঞে মাংস নিবেদন ও ভক্ষণ এর কথা কূর্ম পুরাণেও বেদব্যাস উল্লেখ করেছেন। যথা-
মৎস্যেম্বেতে সমুদ্দিষ্টা ভক্ষণীয়া মুনীশ্বরাঃ ।
প্রোক্ষিতং ভক্ষয়ে দযাং মাংসঞ্চ দ্বিজকাম্যয়া ।।
( কূর্মপুরাণ… উপরিভাগ…সপ্তদশ অধ্যায়… ৪০)
অর্থাৎ- মাছ, মাংস খাওয়া যায় কিন্তু যজ্ঞের অবশেষ রূপে – ব্রাহ্মণের আদেশে মাংস খেলে পাপ নেই।
দেখুন যজ্ঞ বলতে আমরা কেবল আগুনে মন্ত্র বলে ঘি আহুতি দেওয়াই বুঝি। “পঞ্চযজ্ঞ” একটাও যজ্ঞ। পরিবার – অতিথি- পোষ্য জন্তু পক্ষী দের আহার দেওয়াও পঞ্চযজ্ঞ। তাহলে সংসার প্রতিপালনের জন্য সেই সংসার যজ্ঞ নির্বাহ করার জন্য আপনি যদি পরিবারে মাছ মাংস কিনে এনে খাওয়ান তাহলে কোন পাপ হবে না।
আমন্ত্রিতন্ত্রঃ যঃ শ্রাদ্ধে দৈবে বা মাংসসমুৎসৃজেৎ ।
যাবন্তি পশুরোমাণি ট্যাবতো নরকান্‌ ব্রজেৎ ।।
( কূর্মপুরাণ… উপরিভাগ…সপ্তদশ অধ্যায়… ৪১)
অর্থাৎ- যে ব্যাক্তি শ্রাদ্ধে নিমন্ত্রিত বা দৈবকর্মে নিযুক্ত হয়ে মাংস না খায়- সে ঐ পশুর শরীরে যত লোম আছে তত বছর নরক ভোগ করে।
লক্ষ্য করুন মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ বেদব্যাস ঋষি সঙ্কীর্ণমনা ছিলেন না। পুরাণে আমাদের মাংস খাবার অধিকার দিয়ে গেছেন। এখন বেদব্যাসের ওপরে যারা নিজ মত স্থাপন করতে চান- তাদের আর কি বলা যায় !
নয়দিন ব্যাপী মহাদেবীর আরাধনা, এ নিছক কোন সামান্য পূজা নয়। নবরাত্র এক অসীম ফলদায়ী ব্রতানুষ্ঠান, যা পালনে অপবর্গ ও মোক্ষ- দুইই অনায়াসে করতলগত হয়। শ্রীশ্রীদেবীভাগবত পুরাণে এই নবরাত্রির অমোঘ ফললাভ প্রসঙ্গে দেবর্ষি নারদকে প্রশ্ন করেছিলেন স্বয়ং ভগবান শ্রীরামচন্দ্র। তদুত্তরে নারদমুনি বলছেন-
“উপায়ং কথয়ামিদ্য তস্য নাশায় রাঘব।
ব্রতং কুরুষ্ব শ্রদ্ধাবানাশ্বিনে মাসি সাম্প্রতম।।
নবরাত্রোপবাঞ্চ ভগবত্যাঃ প্রপূজনম্।
সর্বসিদ্ধিকরং রাম জপহোমবিধানতঃ।।
মৌধ্যশ্চ পশুভির্দেব্যা বলিং দত্বা বিশংসিতেঃ।
দশাংশংহরণং কৃত্বা সুশক্তস্বংভবিষ্যসি।।”
( দেবীভাগবত পুরাণ… ৩য় স্কন্ধ… ত্রিংশোহধ্যায় )
—হে রাঘব, এক্ষণে রাবণের বিনাশার্থ এক উপায় বলছি, শ্রবণ করুন। আপনি সম্প্রতি এই আশ্বিন মাসে শ্রদ্ধান্বিত হয়ে সর্বসিদ্ধিকর নবরাত্র ব্রত অনুষ্ঠান করুন। ঐ ব্রতে নয় রাত্রি উপবাসী থেকে যথাবিধানে জপ-হোমাদি দারা জগদম্বার অর্চনা করতে হবে। ভগবতীর প্রীত্যার্থে প্রশান্ত ও পবিত্র হয়ে পশুসমূহ বলি প্রদান করে একশো জপের দশাংস হোম করলে আপনি রাবণ বিনাশে অবশ্যই সক্ষম হবেন।
স্বয়ং নারদ মুনি বলি দিয়ে দেবীর পূজা করতে বলেছেন। বলি নিয়ে অনেক রেফারেন্স বিভিন্ন পুরাণে আছে। সেগুলো লেখতে গেলে বিশাল একটা বই হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং নিশ্চিন্তে “ভেতরে ভগবানকে আহুতি” দিচ্ছেন- ভেবে সরকার দ্বারা স্বীকৃত পশু মাংস ভক্ষণ করুন। “যারা নিজেরাই পাপী- তারাই চারপাশে পাপ দেখে”- দেখুন না কত ক্রিমিনাল আজকাল সাধু সেজেছে জাস্ট আইন থেকে বাঁচার জন্য। কিন্তু ভিতরের প্রবৃত্তি কি আর গেছে ? যাবেও না ।
ভারতে বিভিন্ন জায়গার জলবায়ু এক না। জলবায়ু অনুসারে খাবার তালিকাও অন্য। এক জায়গার খাবার অন্য জায়গায় খেলে পেটের রোগ অসুখের কারণ হতে পারে। যেমন বাংলা- আসাম- উড়িষ্যা নাতিশীতোষ্ণ। এখানে চাষাবাদ হয় ধান। আবার শীতের দিনে আলু সহ নানা সবজি চাষ হয়। কাজ করতে শক্তির প্রয়োজন। তাই মাছ- মাংস- ডিম আহার। আবার উত্তরপ্রদেশ হরিয়ানা রাজস্থান গুজরাটে প্রচণ্ড গরম। এখানে মাছ- মাংস খেলে হজমের গোলমাল অসুখ হতে পারে। এখানে উদ্ভিজ খাবারের প্রয়োজন বেশী। রাজস্থানে মরুভূমিতে অনেক দূর দূর হেটে জল আনতে হয়। এতে অনেক ক্যালারি খরচা হয়। এইজন্য এখানে ঘি- মাখন- জিলাপী খাবার চল বেশী। দক্ষিণ ভারতে সমুদ্রের হাওয়া থেকে বাঁচতে নারকেল তেলে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। সেখানে রান্নাতে নারকেল প্রয়োগ করা হয়। সামুদ্রিক মাছ খাওয়া হয় । প্রাচীনকালে শাস্ত্রকারেরা এই জিনিস গুলো বুঝতেন। তবে ডেইলী প্রানীজ খাবারে হজমের সমস্যা হয়। তাই পুরাণে কিছু বিধি নিষেধও আছে। এর মানে এই না যে প্রানীজ খাবার খেলেই চিত্রগুপ্ত আপনার নাম টা খাতায় লেখবেন। নিশ্চিন্তে প্রানীজ খাবার সরকার দ্বারা স্বীকৃত পশু- পক্ষী খান। মহাবেদান্তিক স্বামী বিবেকানন্দ অবধি আমিষ খাবারে মানা করেননি ।
আচ্ছা যারা বলে জীবহত্যা পাপ। তারা কি ইঁদুর আরশোলা মারেন না ? মাথার উকুন দূর করতে শ্যাম্পু করেন না ? ঘরে মাকড়শার ঝুল ঝারেন না ? গায়ের ময়লা দূর করতে জীবানুনাশক সাবান দেন না ? মশা মারার ধূপ জ্বালান না ? বৈষ্ণবের নয়নের মণি “ভাগবতে” এগুলো করতেও মানা আছে- দেখবেন শ্লোক ???
যস্ত্বিহ বৈ ভূতানামীশ্বরোপকল্পিতবৃত্তীনামবিবিক্তপরব্যথানাং
স্বয়ং পুরুষোপকল্পিতবৃত্তির্বিবিক্তপরব্যথো ব্যথামাচরতি
স পরত্রান্ধকূপে তদভিদ্রোহেণ নিপততি তত্র হাসৌ
তৈর্জন্তুভিঃপশুমৃগপক্ষিসরীসৃপৈর্মশকযূকামৎকুণমক্ষিকাদিভির্যে
কে চাভিদ্রুগ্ধাস্তৈ সর্বতোহভিদ্রুহ্যমাণস্তমসিবিহিতনিদ্রানির্বৃতিরলব্ধাবস্থানঃ
পরিক্রামতি যথা কুশরীরে জীবঃ ।।
( শ্রীমদ্ভাগবতপুরান… পঞ্চম স্কন্ধ… ষড়বিংশ অধ্যায়… শ্লোক – ১৭ )
অর্থাৎ- যে ব্যাক্তি পৃথিবীতে মৎকুনাদি ( ছারপোকা ) প্রাণীকে হিংসা করে তাদের ঐ হিংসাহেতু অন্ধকূপ নামক নরকে পতিত হতে হয়; কারণ স্বয়ং ভগবানই তাদের রক্তপান বৃত্তিই দান করেছেন এবং সেইজন্য তারা অন্যকে কষ্ট দেয় সেকথা অনুভব করতে পারে না ; কিন্তু ভগবান মানুষের কর্মে বিধি নিষেধ করেছেন এবং মানুষ অন্যের কষ্ট উপলব্ধি করতে পারে। পৃথিবীতে সে পশু, মৃগ, পক্ষী, সর্পাদি , উগরপ্রাণী, মশক, উকুন, ছারপোকা ও মক্ষিকা আদি জীব- যাদের প্রতি হিংসা করত- তারা সেখানে চতুর্দিক থেকে তাকে হিংসা করতে থাকে। সেইজন্য তার নিদ্রা ও শান্তি নষ্ট হয় এবং সে স্থির থাকতে পারে না; যেরূপ অসুস্থ ব্যাক্তি আকুল হয়ে পড়ে সেইরকম সেও ঘোর অন্ধকারে আকুল হয়ে ঘুরে বেড়ায় ।
কি বলবেন এবার ? আগে সাবান, শ্যাম্পু ,মশা মারার তেল ঘর থেকে ফেলে দিন, তারপর মাংসাহারের বিপক্ষে কথা বলতে আসবেন । আর একটি শ্লোক দেখাই ভাগবত থেকে
তমৃত্বিজঃ শত্রুবধাভিসন্ধিতং
বিচক্ষ্য দুস্প্রেক্ষ্যমসহ্যরংহসম্ ।
নিবারয়ামাসুরহো মহামতে
ন যুজ্যতেহত্রান্যবধঃ প্রচোদিতাৎ ।।
( শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণ… চতুর্থ স্কন্ধ … উনবিংশ অধ্যায়… শ্লোক- ২৭ )
অর্থাৎ- ঋত্বিকগণ , মহারাজা পৃথুকে বলছেন “ মহারাজ! আপনি অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তি, ( সুতরাং এ কথা আপনার অজ্ঞাত নয়) যজ্ঞে দীক্ষিত হওয়ার পর কেবলমাত্র শাস্ত্রবিহিত যজ্ঞ- পশু ভিন্ন অপর কাওকে বধ করা উচিৎ নয় ।
অন্তিমে সেই সাত্ত্বিক পুরাণ ভাগবত থেকেই একটি কথা দিয়ে সমাপন করব-
“অজগর যাকে গ্রাস করেছে সে যেমন অন্যকে রক্ষা করতে পারে না, তেমনি কাল, কর্ম ও ত্রিগুণের অধীন পাঞ্চভৌতিক এই দেহের পক্ষে অন্য কাউকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। ভগবানই সকলের উপযুক্ত জীবিকা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। হাতযুক্ত মানুষ হাত নেই এমন প্রাণীদের খায়, পা যুক্ত পশুরা পা নেই এমন খাদ্য অর্থাৎ ঘাস-লতাপাতা খায়। এভাবে বড় প্রাণীরা ছোট প্রাণীদের হত্যা করে। জীবই জীবের জীবিকা – এই নিয়ম। এ জগৎ ভগবানই। তিনিই সর্বজীবের আত্মা, অথচ অদ্বিতীয়, ঐভাবে স্বপ্রকাশ। তিনিই অন্তরস্থ, তিনিই বহিঃস্থ। এক ঈশ্বরকে মায়া প্রভাবে দেব,মানুষ প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন রূপে উপস্থিত দেখ।”
( শ্রীমদ্ভাগবত: প্রথম স্কন্ধ, ১৩ অধ্যায়, ৪৫-৪৭)

চিত্র স্থান শ্রী শ্রী ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির উদয়পুর ত্রিপুরা

Related posts

রান্নাঘরঃ চিকেন স্ট্যু

E Zero Point

কেমন যাবে শুক্রবার, জেনে নিন আজকের রাশিফলে

E Zero Point

মানবতা – একটি মানবিক গুণ

E Zero Point

মতামত দিন