24/03/2023 : 12:35 PM
আমার বাংলা

টুসু উৎসব তার কৌলিণ্য বজায় রেখেছে প্রতিনিয়ত লড়তে থাকা মানুষের অন্তরে

জিরো পয়েন্ট নিউজ – কল্যাণ দত্ত, বর্ধমান, ১৪ জানুয়ারি ২০২২:


বাঙালির ‘বারো মাসে তের পার্বণ’ এর খুব কম অংশ জুড়ে রয়েছে ‘টুসু’ পূজা বা টুসু’উৎসব! মূলত রাঢ় অঞ্চল, বিশেষ করে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, বীরভূম প্রভৃতি নির্দিষ্ট কয়েকটি জেলার মানুষদের মধ্যে এই টুসু’পুজার প্রচলন লক্ষ করা যায়৷ বর্ধমান এর বেশ কিছু কৃষিপ্রধান এলাকায় টুসু উৎসব প্রচলিত আছে। তথাকথিত শিক্ষিত এবং স্বঘোষিত সভ্যসমাজের কাছে এই উৎসব এখনও ব্রাত্য৷ তবুও বর্তমান কালে টুসু’উৎসব টিম টিম করে টিকে আছে বা বলা ভাল যে টুসু তার কৌলীণ‍্য বজায় রেখেছে গ্রামীন কিছু খেটে খাওয়া এবং জীবন সংগ্রামে প্রতিনিয়ত লড়তে থাকা মানুষের অন্তরে৷


টুসু সে অর্থে কোন নির্দিষ্ট দেবদেবী নয়৷ তাই এ পূজার নির্দিষ্ট কোন মন্ত্র নেই, নেই কোন নির্দিষ্ট বিধি বিধান, আচার অনুষ্ঠান৷ এটি একটি অব্রাহ্মনিক, অপৌরানিক উৎসব৷ কোন পাঁজিপুঁথিতে এই পুজো সম্পর্কে বিশদে কিছু পাওয়া যায়না৷ বিভিন্ন লোকগাথা এবং লোকশ্রুতি থেকে যেটুকু পাওয়া যায় সেখানে টুসু কে শস্যের দেবী হিসেবে কোথাও কোথাও বর্ননা করা হয়েছে৷


পৌষ সংক্রান্তি বা মকরের ভোরবেলায় মেয়েরা দলবদ্ধভাবে গান গাইতে গাইতে টুসু দেবীকে বাঁশ বা কাঠের তৈরী রঙিন কাগজে সজ্জিত চৌডল বা চতুর্দোলায় বসিয়ে নদী বা পুকুরে নিয়ে যান। সেখানে প্রত্যেক টুসু দল একে অপরের টুসুর প্রতি বক্রোক্তি করে গান গাইতে দেবী বিসর্জন করে থাকেন। টুসু বিসর্জনের পরে মেয়েরা নদী বা পুকুরে স্নান করে নতুন বস্ত্র পরেন।


জীবনের সাথে প্রতিদিন লড়াই করতে থাকা মানুষগুলোর জীবনে টুসু পরব এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তবে বর্তমান সময়ের মাঝে একটু যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছে টুসু পরব। বেঁচে থাকুক টুসু পরব। টুসু গানে পৌষের কনকনে সন্ধ্যাগুলো জমে উঠুক।
টুসু উৎসবের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ টুসু সংগীত। এই সংগীতের মূল বিষয়বস্তু লৌকিক ও দেহগত প্রেম। টুসু গান গায়িকার কল্পনা, দুঃখ, আনন্দ ও সামাজিক অভিজ্ঞতাকে ব্যক্ত করে। কুমারী মেয়ে ও বিবাহিত নারীরা তাদের সাংসারিক সুখ দুঃখকে এই সঙ্গীতের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন।


ধানের ক্ষেত থেকে এক গোছা নতুন আমন ধান মাথায় করে এনে খামারে পিঁড়িতে রেখে দেওয়া হয়। অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের কুমারী মেয়েরা একটি পাত্রে চালের গুঁড়ো লাগিয়ে তাতে তুষ রাখেন। তারপর তুষের ওপর ধান, গোবরের মন্ড, দূর্বা ঘাস, আল চাল, আকন্দ, বাসক ফুল, গাঁদা ফুলের মালা প্রভৃতি রেখে পাত্রটির গায়ে হলুদ রঙের টিপ লাগিয়ে পাত্রটিকে পিড়ির ওপর রেখে স্থাপন করা হয়। পাত্রের এই পুরো ব্যবস্থা প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে টুসু দেবী হিসেবে পূজিতা হন। পৌষ মাসের প্রতি সন্ধ্যাবেলায় কুমারী মেয়েরা দলবদ্ধ হয়ে টুসু দেবীর নিকট তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক অভিজ্ঞতা সুর করে নিবেদন করেন ও দেবীর উদ্দেশ্যে চিঁড়ে, গুড়, বাতাসা, মুড়ি, ছোলা ইত্যাদি ভোগ নিবেদন করেন।


টুসু উৎসব পালনের সময় পৌষ মাসের শেষ চারদিন চাঁউড়ি, বাঁউড়ি, মকর এবং আখান নামে পরিচিত। চাঁউড়ির দিনে গৃহস্থ বাড়ির মেয়েরা উঠোন গোবরমাটি দিয়ে নিকিয়ে পরিষ্কার করে চালের গুঁড়ো তৈরী করা হয়। বাঁউড়ির দিন অর্ধচন্দ্রাকৃতি, ত্রিকোণাকৃতি ও চতুষ্কোণাকৃতির পিঠে তৈরী করে তাতে চাঁছি, তিল, নারকেল বা মিষ্টি পুর দিয়ে ভর্তি করা হয়। স্থানীয় ভাবে এই পিঠে গড়গড়্যা পিঠে বা বাঁকা পিঠে বা পুর পিঠা নামে পরিচিত। বাঁউড়ির রাত দশটা থেকে টুসুর জাগরণ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মেয়েরা জাগরণের ঘর পরিষ্কার করে ফুল, মালা ও আলো দিয়ে সাজায়। এই রাতে কিশোরী কুমারী মেয়েরা ছাড়াও গৃহবধূ ও বয়স্কা মহিলারাও টুসু গানে অংশগ্রহণ করেন।

Related posts

ওষুধের দোকান থেকে মোবাইল চুরি মেমারিতে

E Zero Point

মালদা জেলার ৮ টি কেন্দ্রে করোনা ভ্যাকসিন

E Zero Point

গণপুর গ্রামের প্রাণপুরুষ নরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের ১১১ তম জন্মদিন পালন

E Zero Point

মতামত দিন