28/04/2024 : 1:45 AM
আমার দেশ

“অস্পৃশ্য” স্পর্শে রচিত ভারতীয় সংবিধানঃ আম্বেদকরের জন্মদিনে ভারতবাসীর দায়িত্ব

জিরো পয়েন্ট বিশেষ প্রতিবেদন, ১৪ এপ্রিল ২০২৩:


মহঃ ইব্রাহিম


বাবাসাহেব রামজি আম্বেদকরের নাম শুনলে তাঁর যে ছবি আমাদের মনে ভেসে ওঠে তা হল একজন সৌম্যদর্শন পুরুষ ভারতের সংবিধান গ্রন্থখানি বুকে ধরে রক্ষা করে আছেন। আম্বেদকরকে ভারতের সংবিধান রচনার প্রধান স্থপতি বলে তাঁকে সংবিধানের জনক বলা হয়। সংবিধান রচনার ড্রাফটিং কমিটির তিনি চেয়ারম্যান ছিলেন। কমিটির বাকি ছ জন সদস্যদের মধ্যে একজন মারা যান, একজনকে ভারতের কাজে বাইরে যেত হত, দুজন অসুস্থতার কারণে দিল্লির বাইরে যান। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর উপরে দায়িত্ব অনেক বেশি পড়ে।

তিনি দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাঁর উৎকৃষ্ট মেধার সর্বোত্তম প্রয়োগ করে ভারতের যে সংবিধান রচনা করেন তা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক সংবিধান। পৃথিবীর যেকোনও দেশের এমনকি সমগ্র ইউরোপের নিরিখেও এত ভিন্নতা বা বৈচিত্র্য নেই যা আছে এক ভারতবর্ষে। ভারতের ব্যাপকতা, বহু নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী,বিভিন্ন সংস্কৃতি, বিচিত্র পোশাক, নানা ভাষা, বহু ধর্ম, অসংখ্য বর্ণ, সমস্ত কিছু বিবেচনায় রেখে সংবিধান তৈরি করতে হয়।

আম্বেদকর মহারাষ্ট্রের মাহারা সম্প্রদায়ের মধ্যে জন্ম গ্রহণ করেন । এই মাহারা সম্প্রদায়ের মানুষদের দলিত এবং অস্পৃশ্য হিসাবে সমাজে দেখা হত। আম্বেদকর লিখছেন, “আমাকে স্কুলে ছাত্রদের সাথে বসতে দেওয়া হত না। ঘরের এক কোণে একটি চটের আসনে বসতাম। স্কুলের কর্মচারি সকলের আসন পরিষ্কার করলেও আমার আসন ছুঁতো না।তাই এই আসনটি আমি বাড়ি থেকে নিয়ে যেতাম এবং আবার নিয়ে আসতাম।” তিনি স্কুলের জলের কল ছুঁয়ে জল পান করতে পারতেন না। পিওন কল খুলে দিলে তবে জল পান করতেন। যেদিন পিওন আসত না সেদিন পিপাসার্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরতে হত তাঁকে। একবার স্কুলের বাইরে সাধারণের পানীয় জলের কলে জল পান করার অপরাধে তাঁকে প্রহার করা হয়।

দারিদ্র্য, ঘৃণা এবং অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম করে তিনি বিশ্বের একজন প্রথম সারির উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন।তিনি ছিলেন MA, MSc., PhD, DSc, DLitt, Bar-at-Law. তিনি প্রথম ভারতীয় যিনি বিদেশে অর্থনীতিতে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। অমর্ত্য সেন তাঁকে তাঁর অর্থনীতির গুরু বলে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু দেশ বিদেশের এত ডিগ্রি তাঁর ‘অস্পৃশ্য’ জাতির পরিচয় মুছে দিতে পারেনি।সারা জীবন স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে সাথে আমাদের সমাজের এই অস্পৃশ্যতা কলঙ্ক দূর করার জন্য সংগ্রাম করে গেলেন।

১৯৩০সালে লণ্ডনে গোল টেবিল বৈঠকে ভারতের পক্ষে আম্বেদকর প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন।ইংরেজদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন যে তাঁরা ভারতবাসীদের ক্রীতদাস করে রেখেছেন। পরে তিনি জাতীয় কংগ্রেসের বর্ণ বৈষম্যে বিশ্বাসী সদস্যদের সদস্যপদ বাতিলের শর্ত আরোপের পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু তা হয়নি ।মহাত্মা গান্ধী আম্বেদকরের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন যে,তিনি একজন অতুলনীয় দেশপ্রেমিক যিনি মাতৃভূমির জন্য সংগ্রাম করে চলেছেন। এর উত্তরে আম্বেদকর আক্ষেপ করে বলেন, “গান্ধীজি, আমার কোনও মাতৃভূমি নেই। একজন অস্পৃশ্য ব্যক্তি মাতৃভূমির জন্য গর্ব করতে পারে না। কেমন করে এই দেশকে আমার দেশ, এই ধর্মকে আমার ধর্ম বলব যেখানে আমাদেরকে কুকুর বিড়ালের মতো দেখা হয়, তৃষ্ণা নিবারণের জন্য জল দেওয়া হয় না” ?

আম্বেদকর দেশকে নিঃশর্ত ভালবেসে উজার করে দিয়েছেন তাঁর সর্বস্ব। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখের কথা প্রাধান্য পায়নি। কেবল একবার তাঁর বন্ধুকে লিখেছিলেন, “নিজের হাতে আমি আমার তিন পুত্র এবং এক কন্যাকে এক এক করে বিভিন্ন সময়ে শ্মশানে নিয়ে গেছি। আমার এ গভীর যন্ত্রণা প্রকাশের ভাষা নেই।” ভারতীয় হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায় ঘৃণা এবং বর্ণ বৈষম্য প্রোথিত আছে সমাজের গভীরে বলে তিনি মনে করেন। তাই তিনি অস্পৃশ্যতা দূর করার জন্য বারবার বিভিন্ন সংগঠন তৈরি করেন। কিন্তু অপ্রত্যাশিত বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়।

পরিশেষে তিনি ১৯৫৬ সালে ১৪ অক্টোবর নাগপুরে পঞ্চাশ হাজার দলিত মানুষদের নিয়ে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। এর দু মাস পর তাঁর বিশাল গ্রন্থ “বুদ্ধ এবং তাঁর ধর্ম” রচনা শেষ করে এই মহান চিন্তক ১৯৫৬ সালে ৬ ডিসেম্বর রাত্রে পরলোক গমন করেন। ভারতের সংবিধানের প্রতি তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় এই যে, “এই সংবিধান অত্যন্ত কার্যকরী, যতখানি নমনীয় ততখানি অনমনীয় যা ভারতের অখণ্ডতা এবং জাতীয় সংহতিকে শান্তি অথবা যুদ্ধ, সব সময় সুদৃঢ় করে রাখবে। যদি সংবিধান অনুযায়ী দেশ পরিচালনায় কোনও ত্রুটি হয় তবে বুঝতে হবে, ত্রুটি সংবিধানে নেই, ত্রুটি আছে প্রয়োগকারীদের মানসিকতায়।” বাল্যকালে যিনি ছিলেন “অস্পৃশ্য” তাঁরই স্পর্শে রচিত হয় পবিত্র ভারতীয় সংবিধান।

Related posts

করোনার নতুন মন্ত্র : “যাহা বিমার ওহা উপচার”

E Zero Point

তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর বৃত্তি কর্মসূচির জন্য আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রক স্কচ স্বর্ণ পুরস্কার পেল

E Zero Point

একবিংশ শতাব্দীর জন্য এই সংস্কার নতুন কর্মসংস্কৃতি গড়ে তুলবেঃ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ

E Zero Point

মতামত দিন