25/04/2024 : 1:54 AM
অন্যান্য

করোনা ভাইরাসের প্রকোপে বন্ধ বাংলার বিলুপ্ত প্রায় শিবের গাজন – বোলান গান | অজয় কুমার দে

অজয় কুমার দে, মুর্শিদাবাদ :


‘আমরা দু’টি ভাই , শিবের গাজন গাই …’শৈশবে এমন ছড়া আওড়ায়নি এমন বাঙালির দেখা পাওয়া ভার৷ প্রায় প্রত্যেকের মুখে মুখে ফেরে এই ছড়া ৷ কিন্তু এই ছড়া যে নিছক ছড়া নয় , আদতে গাজনের গান তা হয়ত জানেন না অনেকেই ৷ গাজনের গান নয় , বরং বলা ভালো বোলান গান ৷ বিশ্বায়নের যুগে বোলান গান ক্রমেই বিলুপ্তির পথে ৷ বঙ্গীয় শব্দকোষ ঘাঁটলে দেখা যায়, ‘বোলান’ শব্দের অর্থ সম্ভাষণ বা প্রবচন। মতান্তরে ‘বুলা’ বা ভ্রমণ থেকেও বোলান গানের উৎপত্তি হতে পারে বলে মনে করেন একদল লোক গবেষক। বাংলায় তুর্কি আক্রমণের পর থেকে শিবের গাজন উপলক্ষে বোলান গান গাওয়া শুরু হয়। বোলান গানের মূলত ৪টি প্রকার— দাঁড় বোলান, পালা বোলান, সখী বোলান ও শ্মশান বোলান। এক সময় বীরভূম, নদিয়া, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদের বিস্তীর্ণ এলাকায় বোলান গান প্রচলিত ছিল। বিশিষ্ট লোক সংস্কৃতি গবেষক ওয়াকিল আহমেদ তাঁর ‘বাংলার লোকস্কৃতি’ বইতে লিখেছেন, ‘‘বোলান গান বাঁধা হয় পালার আকারে। এতে লঘু, গুরু উভয় বিষয়েরই স্থান আছে। গুরু বিষয় খণ্ডগীতি, আর লঘু বিষয় রঙপাঁচালি নামে পরিচিত।’’ এখানে একটি দল যখন গায়, অন্য দল ধুয়া দেয়। এ ভাবেই এগিয়ে চলে বোলান। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাদু, আলকাপ প্রভৃতি লোকশিল্পের মতোই বোলানের ঐতিহ্যও ফিকে হয়ে এসেছে। সাধারণত কোনও হিন্দি বা বাংলা গানের সুর নকল করে এই গানগুলি বাঁধা হয় ৷ ’ শ্মশান বোলানেরও বহুল প্রচলন দেখা যায় গ্রামাঞ্চলে ৷ শিব শ্মশানবাসী ৷ তাই তাঁর ভক্তরাও শ্মশান জীবনকে তুলে ধরেন বোলানের মধ্যে দিয়ে৷ রাক্ষস বা কঙ্কালের বেশে চলে নাচ -গান৷ কেউ কেউ শিবও সাজেন ৷ মরার খুলি থেকে তলোয়ার নিয়ে চলে উদ্দাম নৃত্য ৷ শ্মশান বোলানে দেখানো হয় , শকুন কী ভাবে শ্মশানে শবদেহ ছিঁড়ে খায়৷ কখনও মরা খুলি নিয়ে বন্যপশুদের টানাটানিও প্রদর্শিত হয়৷ তবে অনেক রীতি মেনে বোলান পালন করতে হয় ৷ তাই বর্তমানে কমছে শ্মশান বোলানের দলের সংখ্যা৷ ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে বোলান গান ৷ মুর্শিদাবাদের বোলান বীর শ্রী প্রাণ বল্লভের দে মহাশয়ের বংশপুত্র ও বর্তমান খ্যাতিনামা বোলানশিল্পী শ্রী লক্ষণ চন্দ্র দে জানান, ‘আগে যে ভাবে বোলান গান হতো , এখন তাতে ভাটা পড়েছে ৷ আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার এই প্রাচীন রীতি ৷ আধুনিকতা হয়ত অদূর ভবিষ্যতে মুছে দেবে বোলানকে ৷ ’

তবে বিলুপ্তপ্রায় এই গান এ বছর সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ হয়েগেছে বিশ্ব ত্রাস সৃষ্ট্রিকারী করোনা ভাইরাসের প্রকোপে । শিবকে নিয়ে গান বেঁধে নানা সাজে তা পরিবেশন করাই হল বোলান৷ চৈত্র মাসের শেষে , গাজনের সময় দিন তিনেক বোলান গানের আসর বসে গ্রামাঞ্চলে ৷ সামাজিক দুরত্ব রাখতে প্রায় সব গ্রাম অঞ্চলে সে ভাবে শিব পূজা হচ্ছে না ফলে বন্ধ হয়ে গেছে বোলান গানও । প্রখ্যাত বোলান শিল্পী নানী চোরা মন্ডল মহাশয় জানান “সারা বছর অপেক্ষায় থাকি বছরের শেষ পাঁচটি দিনের জন্য। আমরা বছরের শেষ পাঁচটি দিন অর্থাৎ চৈত্র মাসের পঁচিশ তারিখ থেকে পয়লা বৈশাখ অবধি বোলান গান করি গ্রামে ঘুরে ঘুরে , যেমন খুব আনন্দ প্রায় তেমনি সমাজে বিশেষ বার্তা তুলে দিয় গানের মাধ্যমে। সব মাটি করে দিলো করোনা ভাইরাস। আশার মুখে ছাই তুলে দিলো এই মারাত্মক ভাইরাস। সকলের কাছে আবেদন এই পাঁচদিন হতাশা হবেন না। আমরা আবারো পরের বছর বোলান করবো তবে এই বছরটিতে সকলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ঘরে থেকে ভাইরাস রোধে সামিল হন। “ একরাশ দুঃখ প্রকাশ করে অন্যএক বোলান শিল্পী জানান “বোলান এমনিতেই প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে কালের কালিমায় তবে এ বছর সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে কোরোনার প্রকোপে। তবে সবাই ভালো থাকুন , সুস্থ থাকুন , আসছে বছর আবার হবে । “

Related posts

সম্প্রীতির বার্তায় রাণীগঞ্জে ইফতার সামগ্রী প্রদান

E Zero Point

জেনে নিন, কেন বন্ধ হয়েছিলো Facebook-Whatsapp-Instagram?

E Zero Point

সামাজিক দূরত্বের বিধি মেনে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী বিতরণ মেমারি কলেজ পাড়ায়

E Zero Point

মতামত দিন