সেখ আব্দুল মান্নান
পুরনো অভ্যাস মতই বারান্দার জাফরির ফাঁক দিয়ে ব্রজকিশোরের দৃষ্টি পৌঁছে গেল গন বাবুর বাগানে। কি না ছিল বাগানে ! আম, জাম, পেয়ারা, পেঁপে, বাতাবি লেবু সহ নানা ফুলের গাছ। সব মিলিয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ ফল-ফুলের বাগান। জনারণ্য কোলকাতায় এমন একটা বাগানকে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের সঙ্গেও তুলনা করা যায়। এক ইঞ্চিফাঁকা জায়গা দেখলেই যেখানে প্রমোটাররা ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেখানে এই বাগানকে অক্টোপাসের আক্রমণ থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য গন বাবুকে মনে মনে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন ব্রজকিশোর। চাকরি থেকে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত ব্রজকিশোর সকালে ঘুম থেকে উঠে একবার ওই বাগানের দিকে তাকালেই মনটা ভালো হয়ে যায়। ঘন সবুজের ভিড়ে জবা আর হলুদ কোল্কে ফুলগুলো ওর দিকে চেয়ে যেন খিলখিল করে হাসে । মাঝে মাঝে বাগানের সবুজের ভেতর থেকে কোকিলের কুহু কুহু তান ভেসে এলেই আনমনা হয়ে যেতো ব্রজকিশোর। যদিও কোকিলগুলো গুলিয়ে ফেলত ঋতুর পার্থক্য। গনগনে গরমের সকালেও কখনো কখনো ডেকে উঠত ওরা। বিশ্বায়নের বিষে হয়তো প্রকৃতিও প্রভাবিত করতে অক্ষম ওদের ছোট্ট হৃদয়।
অবসরের পর একটা নিরিবিলি ফ্ল্যাটের জন্য শহর কলকাতার সন্নিহিত এলাকাগুলো তন্নতন্ন করে শেষে মুকুন্দপুরের নয়াবাদে সৃজনী রেসিডেন্সির ছোট্ট ফ্ল্যাটটি বেশ মনের মত ব্রজকিশোরের। ফ্ল্যাটের চারদিকেই বেশ ফাঁকা ফাঁকা। নিরিবিলির সাথে সাথে অনতিদূরেই অমন একটা সবুজ বাগান থাকবে এটা স্বপ্নেও কল্পনা করেননি। করোনার কামড়ে সারা শহর যখন নিস্তব্ধ তখন গন বাবুর বাগানে সকাল সন্ধ্যে পাখিদের কিচির মিচির ভুলিয়ে দিয়েছে ওর নিঃসঙ্গতা।
আমফানের বিধ্বংসী ঝঞ্ঝা তেমন কিছু ক্ষতি করতে পারেনি বাগানের। ঝড়ের দাপটে পেঁপে গাছগুলো ভেঙে পড়লেও বাকিরা ডানাভেজা কাকের মত দাঁড়িয়ে ছিল মাথা তুলে। পাখিগুলো বোধহয় আত্মরক্ষা করেছিল গন বাবুর দালান ঘেঁষা গাছেদের ভিড়ে। নইলে পরেরদিন সকালে তারা কোথা থেকে এসে যথারীতি শুরু করেছিল কিচির মিচির !
ব্রজকিশোরের মনটা সেদিন থেকেই ভীষণ খারাপ। সাত সকালে হঠাৎ করে গন বাবু কজন লেবার ডেকে এনে কুড়ুল কাটারির কোপে কাটতে লাগলেন বাগানের গাছগুলো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অস্থির মনে ভাবতে লাগলেন ব্রজকিশোর ‘ গন বাবু কেন গাছগুলো কেটে ফেলছেন ? ঝড়ঝাপটার হাত থেকে তো গাছগুলো রক্ষা পেয়েছে ! কি এমন দরকার পড়ল যে গাছগুলো কেটে ফেলতে হবে ? তবে কি সত্যিই রাক্ষুসে প্রমোটারদের কুনজর পড়ছে ওই জায়গাটা ? নাকি অন্য কোন কারণ ?’
কথাগুলো স্বগত্যক্তি করেই ব্রজকিশোর ভাবলে একবার যেয়েই না হয় অনুরোধ জানাবে ‘গন বাবু প্লিজ আপনি নিরীহ গাছগুলো কাটবেন না। আপনি জানানে না আপনার এই সুন্দর বাগানটা আমাকে কতখানি তৃপ্তি দেয়। ছোট ছোট পাখিগুলো তো তাদের সুখের সংসার পেতেছে এই বাগানে। তবুও আপনি…!’
নিমেষেই মনে হোল ব্রজকিশোরের ‘গন বাবু কেন শুনবেন ওর কথা ? উনি ভালো বুঝেছেন বলেই হয়ত গাছগুলো কেটে পরিস্কার করছেন। উনিও তো রক্ত মাংসের মানুষ। উনারও তো ফিলিংস আছে। শুধু শুধু ভদ্রলোককে কিছু বলে বিব্রত না করাই ভালো।’
প্রশ্নোত্তরের দ্বন্দ্বে বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে ব্রজকিশোর দেখেছিলেন বাগানের সবকটা গাছ কাটা হয়ে গেছে। শুধু আম আর পেয়ারা গাছের দুটো গুঁড়ি মাথাকাটা ভূতের মত দাঁড়িয়ে রয়েছে সোজা। যেন রিক্ত নিঃস্ব হয়ে স্রষ্টার কাছে ফরিয়াদ জানাচ্ছে তারা। কেন হোল এই পরিনতি তাদের ? তারা তো কোন অপরাধ করেনি ?
ব্রজকিশোর হঠাৎ লক্ষ্য করলেন একটা শালিক মাথাকাটা আমের গুঁড়িতে বসে যেন বিষণ্ণ মনে চেয়ে রয়েছে ওর পানে। কিন্তু শালিকটা আজ একা কেন ? ওর সঙ্গী কোথায় ? কতদিন তো দেখেছি ওরা দুজনে মিলে উড়ে এসে বসেছে নিচের পাঁচিলে। জাফরির ফাঁক দিয়ে কখনো মুড়ি, কখনো পাউরুটি ছিঁড়ে নিচে ফেলে দিলেই ওরা ছুটে এসে খুঁটে খেয়েছে। আজ ও একা। তবে কি আমফান ওকে সাথীহারা করেছে ! নাকি অন্যকোন সঙ্গী খুঁজে চলে গেছে অন্যত্র ! সেই বিরহের কথা জানাতেই ও চেয়ে আছে করুণ চোখে ? কিন্তু ওইটুকু পাখির কি ওইসব ভাববার ক্ষমতা আছে ? ওর ছোট্ট বুকে তিল কলিজায় এতবড় দুঃখের কি ঠাঁই হয় ? যদি না হবে তাহলে ওরা দুজনে এতদিন কিকরে একসাথে ছিল ? ওদের চোখ, মু্খ, চেহেরা, চাহনি, সবই তো আমার চেনা। কোনদিন তো ওরা একা একা আসেনি ! তবে আজ ও কেন একা ?
আমগাছের নিঃস্ব গুঁড়িতে বসা শালিকটার দিকে অপলকে চেয়ে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ব্রজকিশোরের এক সময় মনে হোল শালিকটা ওর দিকে মলিন চেয়ে ওর-ই একাকিত্বকে মনে করিয়ে দিচ্ছে না তো ? লকডাউন শিথিল হয়ে বাস চলাচল শুরু হতেই আজ ভোরে গৌরী চলে গেছে বাপের বাড়ি। তার রুগ্ন মাকে দেখতে ! এবার ওকেও কদিন বইতে হবে একাকিত্বের ভার ! সত্যিই তো কাজের মেয়ে রান্নাবান্না করে দিলেও সারাক্ষণ মোটেই ভালো লাগবে না একা একা। পৃথিবীতে সবাই একা আসে একা যায়। মাঝের সময়টা যে মিলিত হয়, মিলতেই হয়। এটাই শাশ্বত নিয়ম। নইলে কেমন করে সৃষ্টি হবে নতুনের ! নতুনের নিরিখেই তো জীব জগত একে অন্যের স্বর্গীয় প্রেমের বন্ধনে বাঁধা। তাই ক্ষণিকের জন্যে হলেও একে অপরের বিরহ বড় দুঃসহ। ঈশ্বর তো পরম করুনাময়। তাহলে কেন শালিকটাকে সাথীহারা হতে হোল ? গৌরী না হয় কদিন পর ফিরে এলেই কেটে যাবে ওর একাকিত্ব। কিন্তু শালিকটা কি আর ফিরে পাবে তার সঙ্গীকে ?
ব্রজকিশোরের হঠাৎ মনে হোল আরে না না শালিকটা শুধু শুধু ওর একাকিত্ব নিয়ে মাথা ঘামাতে যাবে কেন? ও নিশ্চয়ই গন বাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে বলতে চাইছে যে গন বাবু যদি তাঁর বাগানের গাছপালা কেটে সাফ করে না দিতেন তাহলে ওকে স্ত্রীপুত্রদের হারাতে হতো না। সবাই মিলে একজায়গাতে যেমন ছিল তেমনই থাকতে পারতো।
অভিযোগটা একেবারে যুক্তিযুক্ত। গন বাবুর ওই সুন্দর বাগানটা ছিল বলেই না শালিকটা সুন্দর সংসার পাততে পেরেছিল। আজ বাগান সেই নাই, তাই শালিকের জীবনটাও ছন্নছাড়া।
এবার ব্রজকিশোরের ভেতরের ব্রজকিশোর বললে – না হে বেচারা শালিককে শিখণ্ডী করে এতক্ষণ তুমি যা ভাবলে তার পাশে এই যুক্তিটা বসিয়ে দেখ দিকি কেমন হয় !
‘কোন যুক্তি ?’
মনে করো শালিকটা আমের গুঁড়িতে বসে আছে বিন্দাস। আর তুমি বারান্দার জাফরির ভেতর খাঁচাবন্দী ! তুমি ওখানে বসে বসে শুধু আকাশ কুসুম কল্পনা করতেই পারো, তার বেশি নয়। কিন্তু মন চাইলে শালিক যেখানে খুশি চলে যেতে পারে উড়ে, তুমি পারবে না।
‘ হ্যাঁ, তা হয়তো ঠিকই!’
ব্রজকিশোরের মনে পড়ে গেল ‘খাঁচার পাখি আর বনের পাখি’ নিয়ে কবিগুরুর সেই বিখ্যাত গান। “খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে, বনের পাখি ছিল বনে।/একদা কী করিয়া মিলন হল দোঁহে, কি ছিল বিধাতার মনে।/বনের পাকি বলে, খাঁচার পাখি ভাই, বনেতে যাই দোঁহে মিলে।/খাঁচার পাখি বলে বনের পাখি আয়, খাচায় থাকি নিরিবিলে …”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললন ব্রজকিশোর। একাকী শালিকের উদ্দেশে মনে মনে গেয়ে উঠলেন অতুল প্রসাদের গানের কলি ‘আমিও একাকী তুমিও একাকী আজি এ বাদল রাতে/নিদ নাহি আঁখি পাতে।’
চকিতে ওই গানের কলি কেন যে উচ্চারিত হোল ওর মুখে, বুঝতে পারলেন না ব্রজকিশোর।
তবে কি শালিক আর ওর নিজের একাকিত্ব মিলেমিশেই অবসন্ন হৃদয়ের প্রকাশ !