29/03/2024 : 4:07 PM
আমার দেশরাজনৈতিক

ভাবনাঃ যুদ্ধ মানে শুধু অর্থক্ষয় নয়, মানুষের অমূল্য জীবনহানির নিশ্চিত পরিণতি

প্রসূণ মৈত্র


লাদাখ সীমান্তে চীনের সাথে বেড়ে ওঠা উত্তপ্ত পরিস্থিতির কারণে, আজ যারা “যুদ্ধ চাই, যুদ্ধ চাই” বলে উত্তেজক বিবৃতি দিচ্ছেন তাদের মধ্যে কতজনের যুদ্ধকালীন বা যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা আছে সেটা নিয়ে আমি যথেষ্ট সন্দিহান। চীনের মত একটা দেশের সাথে সরাসরি যুদ্ধে যাওয়া মানে যে মোবাইলে পাবজি বা ফ্রি-ফায়ার গেম অথবা হলিউড সিনেমার মত নয়, এই উপলব্ধি যাদের আছে, তারা কখনই, কেবলমাত্র রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যে বা নিজেদের জাতীয়তাবাদী প্রমাণের জন্যে, যুদ্ধের ধুঁয়া তুলতে পারেন না।

যেকোন পরিস্থিতিতেই যুদ্ধ হল অন্তিম বিকল্প আর সেই বিকল্প গ্রহণের আগে অন্যান্য পথ অবশ্যই দেখে নেওয়া উচিত আর বর্তমানে মোদী সরকার সেটাই করছেন। যুদ্ধ মানে শুধু অর্থক্ষয় নয়, একইসাথে বহু মানুষের অমূল্য জীবনহানির নিশ্চিত পরিণতি। ভেবে দেখুন, পাণ্ডবদের সাথে দুর্যোধন ক্রমাগত অন্যায় করে যাওয়ার পরেও, দুই পক্ষের প্রত্যক্ষ সংঘাত এড়ানোর জন্যে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ শান্তিদূতের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। অথচ যুদ্ধ যে হবেই এটা তিনি জানতেন আর সেই জন্যেই কৌরবদের প্রতিপক্ষ দ্রুপদের সাথে পাণ্ডবদের বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ করেছিলেন।

যে শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধ নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর কুরুক্ষেত্রের প্রাঙ্গণে অর্জুনকে যুদ্ধ করার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, যে শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধ চলাকালীন ভীষ্মকে বধ করার জন্যে, নিজের শপথ ভেঙে, অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন, সেই শ্রীকৃষ্ণই কিন্তু যুদ্ধ ঠেকাতে শান্তিদূত হয়ে নিজে এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁর এই ভূমিকায় ক্ষুব্ধ হয়ে ভীম এবং দ্রৌপদী যখন তাঁকে নিজ নিজ শপথের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন তখন সেই শ্রীকৃষ্ণই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাদের বলে দিয়েছিলেন যে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যে ক্ষয়ক্ষতি হবে তার সাপেক্ষে ভীম ও দ্রৌপদীর প্রতিজ্ঞা মূল্যহীন। তাঁর পরিস্কার বক্তব্য ছিল যে যুদ্ধ এড়ালে যদি তাদের ব্যক্তিগত প্রতিজ্ঞাভঙ্গ হয়, তাহলে বুঝতে হবে যে খুবই কম মূল্য দেওয়া হয়েছে।

আজকে যদি সত্যিই যুদ্ধ শুরু হয় তাহলে তার প্রভাব কেবলমাত্র সীমান্তে সীমাবদ্ধ থাকবেনা, সারা দেশে সেটার প্রভাব পড়তে বাধ্য। আজ যারা যুদ্ধের দাবীতে সোচ্চার হচ্ছেন, তারা যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে বাজারে বিভিন্ন সামগ্রীর প্রাপ্তির সম্ভাবনা ও তাদের দাম নিয়ে সচেতন তো? গত ১৭ দিন ধরে ক্রমাগত পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে মিম বানাবেন, মোদীর চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করবেন আবার দাবী করবেন যে যুদ্ধ হোক? ভেবে দেখুন, কর্ণের বধের আগের রাতে, কুন্তী যখন তার শিবিরে গিয়ে তার এবং অর্জুন – উভয়েরই প্রাণরক্ষার প্রতিশ্রুতি চেয়েছিলেন তখন কর্ণ তাঁকে প্রতিপ্রশ্ন করেছিলেন যে, ইতিহাস যদি কখনও তাঁকে জিজ্ঞাসা করে যে গান্ধারী তো যুদ্ধে নিজের পুত্রদের বলি দিয়েছেন, কিন্তু তিনি কি দিয়েছেন? ইতিহাসের সেই প্রশ্নের সামনে, তিনি নিজের জন্মদাত্রীকে অসহায় অবস্থায় দেখতে পারবেন না, তাই একজনের বলিদান আবশ্যিক। আজকে আমরা, যুদ্ধের দাবীদাররা, সেই বলিদান দেওয়ার জন্যে প্রস্তুত আছি তো?

সন্তোষ বাবু বা রাজেশ ওরাংদের মৃতদেহ বহন করতে আমরা প্রস্তুত আছি তো? যেসব ক্ষেত্রে স্বদেশী বিকল্প আছে, আমরা অর্থের চিন্তা না করে, সেই বিকল্প বেছে নিতে আমরা প্রস্তুত আছি তো? যুদ্ধের খরচ তোলার জন্যে, বাড়তি করের বোঝা বহন করতে আমরা প্রস্তুত আছি তো? যুদ্ধ চলাকালীন, সেনাবাহিনীর নিষ্ঠা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললে, তার মুখ ভেঙে দিতে আমরা প্রস্তুত আছি তো? প্রশাসনের নেওয়া যেকোন সিদ্ধান্ত বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে আমরা প্রস্তুত আছি তো?

উপরের সবক’টা প্রশ্নের উত্তরই যদি সদর্থক হয়, তখনই আমাদের যুদ্ধের দাবী শোভা পায়, তার আগে নয়। আর এই কথাগুলির উত্তর কি হতে পারে, সেটা নরেন্দ্র মোদী খুব ভাল করেই জানেন। আর জানেন বলেই তিনি প্রত্যক্ষ সংঘাতকে শেষ বিকল্প হিসাবেই রেখেছেন। আর এই কারণেই তিনি বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্ণায়ক ভূমিকা গ্রহণকারী অর্থনীতি ও কূটনীতি দিয়ে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছেন। প্রধানমন্ত্রীর উপর ভরসা আছে যে তিনি দেশের সার্বভৌমত্ব ও সেনার স্বাভিমান রক্ষা করতে সম্পূর্ণভাবে সক্ষম।

Related posts

বন্দেভারত এক্সপ্রেসট্রেনর ‘ট্রায়াল রান’

E Zero Point

মমতা বিনানির বাজেট বিশ্লেষণঃ এবারের বাজেট “মেক ইন ইন্ডিয়া” নয় বরং “মেক ফর দ্য ওয়ার্ল্ড”

E Zero Point

রাষ্ট্রপতির জীবন রক্ষা পদকে সম্মানিত আরপিএফের তিন জওয়ান

E Zero Point

মতামত দিন