26/04/2024 : 2:31 AM
আমার বাংলা

ভোটের ফল ও আফটার এফেক্ট : নেতাদের উস্কানিমূলক মন্তব‍্যে ক্ষতি হতে পারে সাধারণ জনগণের

জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী



জিরো পয়েন্ট প্রতিবেদন



ঝড় বা বন্যা অথবা ভূমিকম্প বা সুনামি সহ যেকোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শেষে ‘আফটার এফেক্ট’ থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে এই ‘আফটার এফেক্ট’-টি নাকি ভয়ঙ্কর। মানব সমাজে চরম ক্ষতি ও সর্বনাশ ডেকে আনে। গত প্রায় ছ’মাস ধরে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাণ্ডজ্ঞানহীন নেতা-নেত্রীদের উস্কানিমূলক মন্তব্য শুনে মনে হচ্ছে ভোটের ফল পরবর্তী অর্থাৎ ২রা মে থেকেই ‘আফটার এফেক্ট’ ভয়ঙ্কর হতে চলেছে।
ভারতের অন্যান্য রাজ্যে ‘মব লিঞ্চিং’ বা অন্যান্য অবাঞ্ছিত ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও রাজনৈতিক সংঘর্ষে মৃত্যুর ঘটনা প্রায় শূন্য। পশ্চিমবঙ্গে উল্টোটা ঘটে। যদিও এটা তৃণমূলের সৃষ্টি নয়, অতীত কাল থেকেই এই ঐতিহ্য চলে আসছে। রাজ্যের শাসক ও বিরোধী দলগুলো কেবল যত্ন সহকারে সেই ঐতিহ্য বজায় রেখে চলেছে। সুতরাং ভোটের ফল প্রকাশের পর রাজনৈতিক সংঘর্ষের আশঙ্কা থেকেই যায়।

এবার পশ্চিমবঙ্গের ভোটে মোটামুটি ত্রিমুখী লড়াই দেখা যাবে। তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি এবং কংগ্রেস, বামফ্রন্ট ও আইএসএফ- জোটের মধ্যে এই লড়াই সীমাবদ্ধ থাকবে। বাস্তবে দু’একটা জায়গা ছাড়া নির্বাচনে জোট খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারবে বলে মনে হয়না। মূল লড়াই হবে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে। এরমধ্যে একটা হলো রাজ্যের শাসকদল, অপরটি কেন্দ্রের। শুধু কেন্দ্রের বলা ভুল হবে। ডজন খানেক রাজ্যে একক ক্ষমতা সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে বিজেপি জোট সরকার গড়ে ক্ষমতায় আছে। সুতরাং আশা ছিল দুটো দলের নেতা-নেত্রীরা ভোটের প্রচারে দায়িত্বশীল আচরণ করবে। বাস্তবে ঘটল উল্টো। ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে দায়িত্ব জ্ঞানহীনতার পরিচয় বেশি পাওয়া গেল।


২০১৮ সালে বিরোধী শূন্য পঞ্চায়েত গঠনের লক্ষ্যে রাজ্যের বিভিন্ন স্হানে তৃণমূল কংগ্রেসের এক শ্রেণির নেতা-নেত্রী নির্লজ্জের মত আচরণ করল। তাদের অত্যাচারে তৃণমূল-বিরোধী দলগুলো সমস্ত আসনে প্রার্থী দিতে পারলনা। ঠিক যেন বাম আমলের চিত্রনাট্যের রিমেক। মনোনয়ন পত্র তুলতে বাধা না দিলে সব আসনে বিরোধীরা হয়তো প্রার্থী দিতেও পারতনা। কারণ সেই সময়কার প্রধান বিরোধী দল বামফ্রন্ট পুরোপুরি ক্ষমতাহীন দল। শুধু বিরোধীদের নয় বিভিন্ন এলাকায় তৃণমূলের ক্ষমতাসীন অংশ নিজ দলের অপচ্ছন্দের অংশকেও মনোনয়ন পত্র তুলতে বাধা দিল। ক্ষমতা প্রদর্শন করতে গিয়ে তৃণমূলের পায়ের তলার মাটি দুর্বল হয়ে গেল। বন্দুকের নল নয় গণতন্ত্রে শেষ কথা বলে জনগণ। প্রথম সুযোগেই বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশের স্বপ্ন দেখা তৃণমূল মুখ থুবড়ে পড়ল লোকসভা নির্বাচনে সেই জনগণের ভোটে।

লোকসভা ভোটে অপ্রত্যাশিত ভাবে আঠারোটা আসন পেয়ে রাজ্য বিজেপির এক শ্রেণির নেতা মনে করল রাজ্যে তারা ক্ষমতায় এসেই গেছে। আচরণে শাসক সুলভ মনোভাব প্রকাশ পেল। তারা বুঝতেই চাইলনা নিজেদের সংগঠনের জোরে বা বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্র সরকারের জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য তারা এখানে লোকসভায় আঠারোটা আসন পায়নি। এখনো পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত বুথে এজেন্ট দেওয়ার ক্ষমতা বিজেপির নাই। কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্টই প্রমাণ করে দেয় বিজেপির আমলে দেশে আদৌ কোনো উন্নতি হয়নি। যদি সত্যিই কোনো উন্নতি হতো তাহলে প্রচারের সময় বিজেপির নেতারা সেই তথ্য তুলে ধরত এবং প্রচারে সেটাই হতো তাদের মূল সুর। পরিবর্তে ‘আর নয় অন্যায়’, ‘তোলাবাজ ভাইপো’, ‘ডাবল ইঞ্জিন’ ইত্যাদি গল্পকে প্রাধান্য দিয়েছে। লোকসভায় তাদের আসন বৃদ্ধির মূল কারণ নীচু তলায় তৃণমূলের এক শ্রেণি নেতার তোলাবাজি ও কাটমানি খাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি এবং উদ্ধত আচরণের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ।


তৃণমূলের এক শ্রেণির নেতা-নেত্রী ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিপর্যয়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে না পারলেও দলনেত্রী মমতা ব্যানার্জ্জী কিন্তু পরিস্থিতি বুঝতে পারেন। ভোট কুশলী পিকে কে এনে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন। গত বছর ২৩ শে জুলাই সমস্ত কমিটি ভেঙে দেওয়া হলেও বহু স্হানে নব গঠিত কমিটিতে অত্যাচারী মুখগুলো সামনে থেকে গেছে । কোনো কোনো জেলায় তো কমিটি গঠিত হলোনা। নব্য তৃণমূলী বা তোলামূলীদের অত্যাচারে কোণঠাসা আদি তৃণমূলীরা অবহেলিত থেকে গেল। শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে নিজেদের ‘পয়েণ্ট’ বাড়ানোর তাগিদে তোলামূলীদের অত্যাচার বেড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পেল মানুষের ক্ষোভ। অনেকেই বাঁচার তাগিদে বিজেপিতে আশ্রয় নিল।

এই পরিস্থিতিতে বিধানসভা ভোট শুরু হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। ভোটের অনেক আগে থেকেই বিজেপির প্রথম সারির নেতা-নেত্রীরা বলতে শুরু করে দিয়েছে এবার ভোট হবে ‘দাদা’র পুলিশ অর্থাৎ কেন্দ্র বাহিনীর অধীনে। ভাবখানা এমন বাড়াবাড়ি করলেই মার। প্রথম পাঁচদফা ভোটে তার কিছু নমুনা পাওয়া গেছে। সত্যি মিথ্যা যাইহোক বিভিন্ন জায়গায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে । রাজ্য পুলিশের উপস্থিতিতে এতদিন বিভিন্ন স্হানে তৃণমূলের নেতারা যে কাজটা করত এখন কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতিতে বিজেপির নেতারা সেই কাজটাই করছে। সুযোগ পেলেই তৃণমূলের নীচু তলার কর্মীদের আক্রমণ করা হয়েছে। অন্য রাজ্য থেকে ভোটের প্রচারে আগত বিজেপির নেতা-নেত্রীরা একের পর এক উস্কানিমূলক মন্তব্য করে চলেছে।উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী তো ‘এনকাউণ্টার’ এর হূুঁশিয়ারি দিয়ে গেছেন।

উস্কানিমূলক মন্তব্যে পেছিয়ে নাই তৃণমূলের নেতা-নেত্রীরা। তাদের মুখে হাত-পা কেটে নেওয়ার হুমকি শোনা গেছে। বিভিন্ন প্রান্তে অকারণে বিজেপি কর্মীদের উপর একতরফা আঘাত করা হয়েছে। ঘর ভাঙচুর করা হয়েছে। প্রচারে বাধা দেওয়া হয়েছে। তৃণমূল-বিজেপি সংঘর্ষ তো লেগেই আছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি যথেষ্ট উত্তপ্ত। কেউই বুঝতে চাইছে না প্রত্যেক ক্রিয়ার বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া আছে।
২০১১ এর নির্বাচনে তৃণমূলের স্লোগান ছিল – বদলা নয় বদল চাই। সেবারের ভোটে বামফ্রন্টের বিপর্যয় ছিল অনিবার্য। আশঙ্কা করা হয়েছিল ভোটের ফল বের হওয়ার পর অত্যাচারী বাম নেতাদের কপালে দুর্দশা আছে। কিন্তু মমতা ব্যানার্জ্জী কঠোরভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। ফলে অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটেনি।


এবার রাজ্য বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব বারবার বলে চলেছে – বদল এবং বদলা দুই হবে। ভোটের ফল কি হবে নিশ্চিত নয়। কিন্তু ‘মাইণ্ড গেম’ খেলতে গিয়ে বিজেপি বদলার কথা বলছে। বদলার রাজনীতি করতে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে তো?

আমরা ধরে নেব উভয়দলের নেতা-নেত্রীরা শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন এবং উস্কানিমূলক মন্তব্যগুলো কেবল কথার কথা অর্থাৎ রাজনৈতিক ভাষণ।


কিন্তু ভয় হয়। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে প্রাক্-নির্বাচনী ও নির্বাচন চলাকালীন সংঘর্ষ হয়েছে। বিভিন্ন স্হানে শাসক ও বিরোধীদলগুলো প্রচারে বাধা পেয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় ভোট চলাকালীন শাসক ও বিরোধী উভয় দলের প্রার্থীরা আক্রান্ত হয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে আক্রান্ত মহিলা প্রার্থী মাঠের মধ্যে দিয়ে ছুটেছে। ভোট হয়ে যাওয়ার পরেও কোনো কোনো জায়গায় ঝামেলা হয়েছে। তাতে ভোটের ফল বের হওয়ার পর কোনো রাজনৈতিক সংঘর্ষ হবেনা সেটা নিশ্চিত করে বলা যায়না।


২ রা মে ভোটের ফল বের হবে। যেহেতু ইভিএম এর মাধ্যমে ভোট গণনা হবে মোটামুটি ঘণ্টা খানেক পরই একটা চিত্র পাওয়া যাবে – পরিবর্তন না প্রত্যাবর্তন। বিভিন্ন ভোট সমীক্ষায় তৃণমূল কংগ্রেস এগিয়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত তৃণমূল বা বিজেপি কোন দল ক্ষমতায় আসবে সেই ব্যাপারে কেউই নিশ্চিত নয়। যে দলই ক্ষমতায় আসুক শীর্ষ নেতৃত্ব সংযত নাহলে রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক সংঘর্ষ অনিবার্য।

Related posts

মেমারির গন্তারে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবির

E Zero Point

নাদনঘাটে সাপের কামড়ে ছাত্রীর মৃত্যু

E Zero Point

মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী নিজেই টোটো চালিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে

E Zero Point

মতামত দিন