25/04/2024 : 11:18 AM
সাহিত্য

কাজী নজরুল ইসলামঃবাংলার যৌবনের দিশারী

বিমল মণ্ডল


সাম্যবাদী কবিতা কিংবা কোনও প্রকারের তত্ত্বপন্থী কবিতা কখনও যে আদৌ কবিতার স্তরে উঠতে পারে,সেই বিরল ব্যতিক্রমী বাঙালি, প্রধান উদাহরণ নজরুল। তাই যদি এই নামের অর্থ খুঁজি, তাহলে দেখতে পাবো কাজী নজরুল ইসলাম মানেই — আনন্দিত আর অপরিমিত যৌবন। প্রাণদীপ্ত যৌবন কোনো অন্যায়,কোনো মিথ্যা,কোনো বিষাদ,কোনো ভণ্ডামি সহ্য করে না- তাই তিনি স্বভাব বিদ্রোহী।


‘জয় সত্যম্ মন্ত্র শিখা’ – তাঁর বুকের ভিতরে জ্বলছে অম্লান আলোকে; সেইজন্যই—
‘কারার লৌহ-কপাট
ভেঙে ফেল রক্ত জমাট
শিকল পূজার পাষাণবেদী’

এই ভেঙে ফেলাই তাঁর একমাত্র সংকল্প।তা রাষ্ট্রিক কিংবা সামাজিক কিংবা মানবিক যারই হোক। তাই ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতায় লিখেছেন —
‘অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া,জানে না সন্তরণ,
কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ।’

—দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর,তাঁরই নেতৃত্বে হিন্দু- মুসলমানের বিভেদ দূর করার জন্যে যে ‘ বেঙ্গল প্যাক্ট’ বা হিন্দু-মুসলমান চুক্তি হয়েছিল তা বাতিলের প্রতিবাদের ফল স্বরুপ এই গান-
‘ হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।’


কাণ্ডারীর কানে সেদিন কবির সাবধানবাণী প্রবেশ করেনি,কাণ্ডারী হুঁশিয়ার হয়নি, তার বিষময় পরিণতিতে উপমহাদেশের মানুষ গত এক শতাব্দীকালের বেশি প্রত্যক্ষ করেছে।সাম্প্রদায়িক রাজনীতির খেলার জেরে উপমহাদেশে খণ্ডবিখণ্ড হয়েছে।মানবিকতা চরমভাবে লাঞ্ছিত হয়েছে।

নজরুলের সাধনার মূলমন্ত্র ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তাই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তিনি সবচেয়ে সোচ্চার ও বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। নজরুল অসাম্প্রদায়িক ছিলেন কিন্তু অধার্মিক ছিলেন না। তিনি ধার্মিক ছিলেন কিন্তু ধর্মান্ধ বা পরধর্মের প্রতি অসহিষ্ণু মৌলবাদী ছিলেন না।’বিশ্বাস’ বা ‘ধর্ম’ সমন্ধে তাঁর বোধ ছিল তিনি ধর্মের বাহ্যিক বা প্রথাগত অর্থাৎ আচার- সর্বস্বতা অপেক্ষা ধর্মের মূল ভিত্তির প্রতি অধিকতর নিষ্ঠাবান ছিলেন।
যুগপুরুষ রবীন্দ্রনাথ তো এই যৌবনের উদ্বোধনী শুনিয়েছেন বারবার —
‘ওরে সবুজ ওরে অবুঝ,
আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।’
আর এই তরুণেরা এগিয়ে আসছিল রাজনৈতিক আন্দোলনের পথ ধরে,বিদ্রোহী চিন্তার উদ্ধত আধুনিকতায়,সব ফিলিস্টাইনে স্থির- স্থবিরতার প্রতিবাদে।তারপর নজরুল এলেন তাঁদেরই অগ্নিস্ফুরিত বাণীমুখ হয়ে -‘নতুনের কেতনে’ কালবৈশাখী ঝড়ের দোলা লাগালেন তিনি।


প্রাচীন চিন্তার অভ্যস্ত সমালোচক ভুরু কুঁচকে ‘লাগলো লড়াই মিথ্যা এবং কাঁচায়।’ এটি কি জিজ্ঞাসা করে বলেছিলেন’ এর নাম কবিতা?’ দেখা দিল প্যারিডি আর ব্যাঙ্গবিদ্রুপ।ইংরেজ সরকার একটার পর একটি বই বাজেয়াপ্ত করতে লাগলো, তার পর থেকে বারবার কবিকে জেলে যেতে হলো। তাঁর অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনায় ক্ষিপ্ত হলেন রক্ষণশীল হিন্দু, হিংস্র হয়ে উঠলেন গোঁড়া মুসলমান। সরল আত্ম বিশ্লেষণে নজরুল বললেন —
‘যাব না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি
নাড়ি কাছা।’
এই বোধ শুধু নজরুলের ছিল।আর এটাই স্বাভাবিক। কারণ বিদ্রোহী নবীন বীরের পথ তো পুষ্প বিকশিত নয়।বাংলা সাহিত্যের পথে তাঁর এই সংগ্রামী সাধনার স্মরণীতে অগ্রপথিকের রক্তাক্ত পদচিহ্ন রেখে গেছেন নজরুল। সেই পদরেখা বাংলার যৌবনের দিশারী। আর সেই দুঃখের পথ আর পাথেয় নজরুলের গান।বুকভরা, কণ্ঠভরা গান। অপরাজিত প্রাণের আনন্দিত উদার কলোচ্ছ্বাস— রাত্রির সীমান্তে প্রভাতী পাখির কলধ্বনি।

কাজী নজরুল ইসলাম সাহিত্য ও সঙ্গীত সাধনা করেছিলেন পরাধীন দেশে।যে পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য তাঁর লেখা গ্রন্থ বারবার বাজেয়াপ্ত হয় আর কবিকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়।আর এর প্রতিবাদে তিনি অনশন করেন এবং কিংবদন্তীর নায়কে পরিনত হয়।কিন্তু পরাধীন যুগের এই কবির মন মানসিকতা ও সৃষ্টিকর্মে এর কোনও ছোঁয়া নেই।তাই নজরুল এক স্বাধীনস্বত্ত্ব। তাঁর এই চিত্ততার যে জাগরণ তা তাঁর সুস্থাবস্থায় কোনদিন লয় হয়নি।তিনি জনগণের কবি ও মানুষের কবি হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

আজ এই মহান কবিকে সম্মান জানাতে গিয়ে আমরা যেন তাঁকে বিশেষ দেশ বা জাতির কবিতে পরিনত করে না ফেলি।এই বিদ্রোহী কবিকে যেন আমরা যথার্থ বিদ্রোহীর মর্যাদা দিতে পারি – এই অতিমারির চক্করে দাঁড়িয়েও আমাদের সবাইকে একেই সুরে শপথ নিতে হবে- এটাই হোক আমাদের সবার অঙ্গীকার।


 

Related posts

দৈনিক কবিতাঃ শঙ্খ ঘোষ – কমলেশ মন্ডল

E Zero Point

মঙ্গলকোটে অনুষ্ঠিত হলো কুমুদ সাহিত্য মেলা

E Zero Point

দৈনিক কবিতাঃ দেশপ্রেমিক ক্ষুদিরাম

E Zero Point

মতামত দিন