24/04/2024 : 7:51 AM
আমার বাংলা

নন্দীগ্রামে পরাজয়ের পর- ভবানীপুরের ভোট জয়ের তাৎপর্য

জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী


অবশেষে সব জল্পনা ও আশঙ্কার অবসান ঘটিয়ে মমতা ব্যানার্জ্জী ভবানীপুর বিধানসভার উপনির্বাচনে রেকর্ড মার্জিনে জয়লাভ করলেন এবং নিজের অনিশ্চয়তায় ভরা মুখ্যমন্ত্রীর পদের উপর ঝুলে থাকা প্রশ্ন চিহ্নের অবসান ঘটালেন। যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে মার্জিনের থেকে জয়লাভটা ছিল বেশি জরুরি। একইসঙ্গে বিরোধীদের বিশেষ করে বিজেপির আক্রমণকে ভোঁতা করলেন। এরপর থেকে তাকে আক্রমণ করার জন্য বিজেপিকে অন্য কোনো ইস্যু খুঁজতে হবে। যদিও একশ্রেণির তৃণমূল নেতা-কর্মীর দৌলতে ইস্যুর অভাব হবেনা।

বিধানসভা নির্বাচনে নন্দীগ্রামে ‘বিতর্কিত’ পরাজয়ের পরেও মমতা ব্যানার্জ্জী তৃতীয় বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর পদে শপথ নেন। ভারতের সংবিধান শুধু তাকে নয় প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিককে ভোটে না জিতেও ছ’মাসের জন্য মুখ্যমন্ত্রী বা অন্য মন্ত্রীর পদ গ্রহণ করার সুযোগ দিয়েছে। যে বিজেপি তার সমালোচনা করে তাদের নেতা নরেন্দ্র মোদি ২০০১ সালে এবং যোগী আদিত্যনাথ ২০১৭ সালে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করেও মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে মোদি নির্বাচনে জিতে বিধায়ক হলেও আদিত্যনাথ বিধান পরিষদের সদস্য হয়ে নিজের মুখ্যমন্ত্রীর পদ বজায় রেখেছেন। যা কিছু হয়েছে সব কিছুই সংবিধান সম্মত ভাবে। এরমধ্যে বিতর্কের কিছু নেই। যদিও তারা কেউই ভোটে পরাজিত হওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী হননি। আবার এটাও ঠিক মমতা ব্যানার্জ্জী মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন সংবিধান সম্মত ভাবে। সেখানে বিতর্কের কিছু থাকতে পারেনা। কেউ কেউ রাজনীতিতে নিজেদের প্রাসঙ্গিক রাখার জন্য অযথা বিতর্কের সৃষ্টি করতে চেয়েছেন।

এই মুহূর্তে বাংলার জনপ্রিয়তম রাজনীতিবিদের নাম হলো মমতা ব্যানার্জ্জী। বিজেপির সঙ্গে গোপন আঁতাতের অভিযোগ তুলে যতই বিরোধীরা তার সমালোচনা করুক না কেন মোদির যেকোনো জনবিরোধীনীতির তীব্র সমালোচক হলেন মমতা। সুতরাং বিধানসভা ভোটে তাকে হারানোর জন্য বিজেপি সর্বশক্তি দিয়ে বাংলা জয়ের লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পরে। বাংলায় মোদি-শাহ হয়ে ওঠেন নিত্যযাত্রী। ডজনখানেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, একাধিক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, বিজেপির বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা ভোটের প্রচারে ঝাঁপিয়ে পরে। নিজের দুর্গ রক্ষা করার জন্য অভিষেক, ভোটের বাজারে নবাগত বর্তমান ‘সেনসেশন’ দেবাংশু ও দেবকে নিয়ে মমতা অসম লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। যদিও জয়া বচ্চনের মত কয়েকটি জনপ্রিয় মুখ তৃণমূলের হয়ে প্রচার করেন। তার আগে কাটমানি, দুর্নীতি, এক শ্রেণির তৃণমূল নেতার উদ্ধত আচরণের ফলে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে তৃণমূলের বিপর্যয় ঘটে যায়। শুভেন্দু, রাজীব সহ একাধিক প্রথম সারির নেতা-নেত্রী দল ছাড়ে। হাজার প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিজেপির ও তথাকথিত ভোট বিশেষজ্ঞদের দাবিকে নস্যাৎ করে দিয়ে তৃণমূল দুই শতাধিক আসনে জয়ী হলেও মমতা ব্যানার্জ্জী পরাজিত হন।

নিয়ানুযায়ী ছ’মাস অর্থাৎ ৫ ই নভেম্বরের আগে মমতাকে ভোটে জিততে হবে। তার জয়কে সহজ করার জন্য ভবানীপুরের তৃণমূলের বিজয়ী প্রার্থী শোভনদেব চ্যাটার্জ্জী পদত্যাগ করেন। শুধু সেখানে নয় অন্যান্য উপনির্বাচন বা স্হগিত হয়ে যাওয়া নির্বাচন নিয়ে কোনো এক অদৃশ্য অঙ্গুলি হেলনে নির্বাচন কমিশন টালবাহানা করতে থাকে। যাইহোক শেষ পর্যন্ত ভোট হয় এবং মমতা জয়লাভ করেন।

নির্দিষ্ট সময়ে মমতা জয়লাভ না করলে তাকে নিয়মানুযায়ী মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিতে হতো। ঠিক তখনই মুখ্যমন্ত্রীর পদ নিয়ে ত‍ৃণমূলে দ্বন্দ্ব শুরু হতো। দ্বিতীয় বার ভোটে হেরে গেলে স্বাভাবিক ভাবেই দলের উপর মমতার নিয়ন্ত্রণ কমে যেত এবং তৃণমূল ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে পারত । ব্যক্তি নির্ভর আঞ্চলিক দলগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি সেই ইঙ্গিত দেয়। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ফিরহাদ হাকিমের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বিজেপি সূক্ষ্মভাবে সেই চালটাই দিতে চেয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত সেটা ব্যর্থ হলো।

ভোটের ফলাফল নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে খুব একটা আগ্রহ ছিল বলে মনে হয়না। উপ নির্বাচনে মূলত শাসক দলকেই জিততে দেখা যায় এবং প্রার্থীর নাম যেহেতু মমতা ব্যানার্জ্জী তাই ভোটের ফল অন্য রকম হবে বলে মানুষ ভাবেনি। তাছাড়া অধিকাংশ মানুষ এখনো বিশ্বাস করে নন্দীগ্রামে মমতা হারেনি তাকে জোর করে হারিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যদিও সেটা আদালতই বিচার করবে। মনে হয়না একটা প্রত্যাশিত জয়লাভের ফলে মমতার জনপ্রিয়তা অতিরিক্ত বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু তার দাপট আরও বাড়বে। এবার হয়তো তিনি দলের মধ্যে ‘এক ব্যক্তি এক পদ’ নীতি কড়া ভাবে কার্যকর করবেন। বাংলা বিজেপি কোণঠাসা হবে। বিজেপির অনেক বিধায়ক ও সাংসদ এবার তৃণমূলে যোগদান করবে এবং সেটাই অনিবার্য। শুভেন্দু ধীরে ধীরে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে এবং ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে বামেরা আরও পেছিয়ে পড়বে।

অন্যদিকে বিজেপি জয়লাভ করলে বিধানসভায় তাদের নিছক একটা আসন বাড়তনা, বাড়তি উদ্যম নিয়ে তারা মমতা বিরোধিতায় ঝাঁপিয়ে পড়ত। ক্ষমতালোভী ধান্দাবাজ এক শ্রেণির তৃণমূল বিধায়ক বিজেপিতে যোগ দিত। হয়তো তাতে বিজেপি সরকার গঠন করে ফেলতে পারত। সারা ভারত জুড়ে অপ্রতিরোধ্য গতিতে বিজেপির বিজয় রথ এগিয়ে যেত। সেক্ষেত্রে শুধু কংগ্রেস মুক্ত নয় আগামী কয়েক বছর বা দশক ধরে বিরোধীশূন্য গণতন্ত্রও দেখা যেত। সুতরাং বলা যেতেই পারে ভবানীপুর শুধু নিছক একটা উপনির্বাচন নয় ভারতীয় রাজনীতির একটা ‘টার্নিং পয়েন্ট’। যদিও সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেতে গেলে কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।



Related posts

সেরা পুজোঃ সুভাষ সংঘের শোভাযাত্রায় মেমারির পথ সুবাসিত

E Zero Point

কালনা-১ ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যুবদের স্মারকলিপি

E Zero Point

উল্টোরথে মেতে উঠল বেলঘড়িয়া রথতলা, উপস্থিত বিধায়ক মদন মিত্র

E Zero Point

মতামত দিন