24/04/2024 : 8:25 AM
আমার বাংলাট্রেন্ডিং নিউজ

‘পাড়ায় শিক্ষালয়’ – বিপদে কিশলয়

জিরো পয়েন্ট প্রতিবেদন, ২৫ জানুয়ারি ২০২২:


শ্রীমন্ত ঘোষ


শিক্ষার সাথে শাসকের অহিনকুল সম্পর্ক সেই প্রাচীন কাল থেকেই। ভন্ড শাসকরা চিরকালই ভয় পায় নির্ভীক প্রশ্নকে। শিক্ষা, শিক্ষক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমাজকে প্রশ্ন করতে শেখায়। জগতের সব শাসকই চায় শিক্ষক সমাজকে তার পৃষ্ঠপোষক বানাতে এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে হাতিয়ার করে আত্মপ্রচার করতে। আজকের ‘পাড়ায় শিক্ষালয়’ সেই প্রচেষ্টারই নবতম রূপ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিমূখ শিক্ষাব্যবস্থার একটা আধুনিক প্রবণতা চালু হয়েছে বেশ কয়েকদিন ধরে।

এই সমান্তরাল চটকদার শিক্ষাব্যবস্থার পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করে কিছু পুঁজিবাদী শক্তি। একটা ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের মাধ্যমে, সকল স্তরের শিক্ষা আপনার শিশুর স্টাডি টেবিলে পৌঁছে দেবে কিডজি, বাইজুস, টিউটোরিয়াল এর মতো সংস্থা। যাদের এক এবং একমাত্র উদ্দেশ্য শিক্ষাকে পণ্য হিসাবে বিক্রি করে মুনাফা তৈরি করা। ব্যক্তিগতভাবে যতটুকু বুঝেছি, তাতে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ সেই ব্যবস্থাকেই আরও বেশিকরে তোল্লায় দেয়। এতে দু পক্ষেরই লাভ। রাষ্ট্রকে নতুনভাবে শিক্ষাপরিকাঠামো তৈরি করতে হবেনা বা শিক্ষক নিয়োগ করতে হবেনা। অপরপক্ষে উল্লেখিত সংস্থাগুলোর পুঁজির পাহাড় ফুলে ফেঁপে উঠবে। ক্ষতি কেবলমাত্র একপক্ষের, যারা চড়া দামে নিজের বাচ্ছাকে শিক্ষিত করে তোলা থেকে বঞ্চিত হবে। মনসার কথামতো লখিন্দরের বাসরঘরে ছিদ্র রেখেছিল বিশ্বকর্মা। সেই চুল পরিমাণ ছিদ্র দিয়েই কালনাগিনী প্রবেশ করেছিল লখিন্দরের ঘরে। পরবর্তী উপাখ্যান আপনারা প্রত্যেকেই জানেন।

সদ্য মুকুলিত যে কচি পাতাগুলো নিজেদের মেলে ধরতে চাইছে এবং বনস্পতি হয়ে উঠার স্বপ্ন দেখছে, তাদের গায়ে এই মুহুর্তেই বিষাক্ত কীট ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নয়তো এটা ? শপিংমল, রেস্তোরাঁ, জিম সেন্টার বা অনুষ্ঠান বাড়িতে করোনা ভাইরাস নেই, কারণ সব ভাইরাস এসে জমা হয়েছে শ্রেণীকক্ষে। সেখানে গেলেই নাকি শিশুরা আক্রান্ত হবে বলে সরকারপক্ষ ভয় পাচ্ছে। ঐ শিশুর অভিভাবকরা উৎসব বা মেলা প্রাঙ্গণ থেকে ফিরে এসে তাদের আদর করলে সংক্রমণ ছড়াবেনা, কারণ সকল অভিভাবকই নিয়ম মেনে নিজেদের স্যানিটাইজ করে তারপর শিশুদের কাছে যায়। বিশ্বাস করুন, বড্ড হাস্যকর এই যুক্তি। জানিনা, “পাড়ায় শিক্ষালয়” প্রকল্প পরিমার্জিত হয়ে কিভা‌বে উপস্থাপিত হবে আমাদের সামনে। তবে একজন শিক্ষক হিসাবে কয়েকটা মৌলিক অসুবিধার কথা এই মুহুর্তেই মনের মধ্যে খচখচ করছে। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী যেখানেই মিলিত হয়ে বসবে, সেখানটাই বিদ্যালয় হয়ে উঠবে, এই আপ্তবাক্য মেনে চলার মতো সামাজিক তথা রাজনৈতিক পরিবেশ কি আদেও বেঁচে আছে বর্তমানে ? মিছিল, স্লোগান, গাড়ির হর্ণ, পাড়ার গন্ডগোল, বিয়েবাড়ির হুল্লোড়, প্রাকৃতিক দূষণ সেখানে বাধ সাধবেনা তো ?
খামখেয়ালি প্রকৃতি ভন্ডুল করে দেবেনা তো এই শিক্ষালয়গুলিকে তার খামখেয়ালিপনা দিয়ে ? কোনো শিক্ষক/শিক্ষিকা বা শিক্ষার্থীর যদি হঠাৎই প্রকৃতির ডাক অনুভূত হয়, তাহলে কি খোলা প্রকৃতির কোলেই সেই ডাকে সাড়া দেবে ?


বিদ্যালয়ের দেওয়াল, সিঁড়ি, চকবোর্ড, চার্ট, মডেল ইত্যাদি সবকিছুর মধ্যেই যেভাবে শিক্ষাকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, সেটার কতটুকু সম্ভব হবে পাড়ার মাঠে ? মুক্ত বিদ্যালয়ের ধারণা দেওয়া কবিগুরুর বিশ্বভারতীও বর্তমানে সময়ের দাবিকে মেনে নিয়ে বড়ো বড়ো বিল্ডিং এবং ডিপার্টমেন্ট বানিয়েছে। শিশুদের একবেলা পুষ্টিকর খাবার দেওয়ার উদ্দেশ্যে যে মিড-ডে-মিল খাওয়ানোর ব্যবস্থা চলে আসছিল, সেটা কিভাবে পাড়ার মাঠে সম্ভব ? বিদ্যালয়ের শ্রেনীকক্ষে ধর্ম জাতি গোষ্ঠী অর্থনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে যে সাম্যবাদী ব্যবস্থাপনা চলতো সেটা কি এক্ষেত্রে সম্ভব হবে ? বিদ্যালয়ের প্রতিটি কর্ম-পরিকল্পনায় যে বহুত্ববাদী ভাবনা জুড়ে থাকতো, সেটা পাড়ার মাঠে কিভাবে পালিত হবে ?

জানি অনেকেই বলবেন, এই ব্যবস্থা তো সাময়িক। করোনা আবহ কেটে গেলে আবারও সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু বিশ্বাস করুণ, যারা দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর তৃতীয় ঢেউয়ের ভয় দেখিয়েছে, তারা যে চতুর্থ বা পঞ্চম ঢেউয়ের ভয় দেখাবে না এমন নিশ্চয়তা অন্তত আমার কাছে নেই। চিরকালই মহম্মদ পর্বতের কাছে গেছে। এটাই দস্তুর। পর্বত যেদিন মহম্মদের কাছে যেতে বাধ্য হবে, সেদিন মহম্মদের কতটা আগ্রহ থাকবে তার সাথে আলাপ করার সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে।

এই সাধারণ কথাগুলো শিক্ষা দপ্তরের আধিকারিকগণ বোঝেন না এমন যুক্তি অবান্তর তো বটেই, রিতিমতো হাস্যকরও। কেবলমাত্র বিরোধিতা করার জন্য বিরোধিতা করবো বলে এই অশনিসংকেত গুলোর কথা মোটেও তুলে ধরছি না। একজন পিতা হিসাবে এবং সর্বোপরি একজন শিক্ষক হিসাবে, নিজের চেতনা দিয়ে যতটুকু অনুধাবণ করতে পেরেছি, সেটুকু তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র। একজন মধ্যবিত্ত প্রান্তিক পিতা হিসাবে আমিও মনেপ্রাণে চাই আমার শিশু শিক্ষার অধিকার থেকে যেন বঞ্চিত না হয়।
আরও পড়ুনঃ- ধাপে ধাপে স্কুল খোলার ভাবনা রাজ্যের, ফেব্রুয়ারিতে শুরু ‘পাড়ায় শিক্ষালয়’ প্রকল্প

আর একজন শিক্ষক হিসাবে প্রাণপণে চাই শ্রেনীকক্ষে ফিরে যেতে, আবারও কচিকাঁচাদের সাথে জাতীয় সঙ্গিত গেয়ে প্রতিটা দিন শুরু করতে। সনামধন্য IAS-গন ‘I Am Servant’ বলে নিজেদের দায় এড়িয়ে গেলেও আমাদের মতো অসংখ্য শিক্ষক শিক্ষিকা সেটা পারছেন না। তারাও নিজেদের মধ্যে থাকা শিক্ষাকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দিয়ে দেশের পক্ষে সমাজের পক্ষে কাজ করতে চায়। এভাবেই তারা নিজেদের ‘দেশপ্রেমিক’ হিসাবে তুলে ধরতে চায়। তারা যত বেশি সম্ভব ছাত্র ছাত্রী তৈরি করতে চায়, ভক্ত তৈরি করতে চাইনা। আমি বিচারক নই। এই মুহুর্তে যেটা ঠিক বলে মনে হলো, সেটা বলার চেষ্টা করলাম মাত্র। চূড়ান্ত ঠিক ভুলের বিচার একদিন মহাকাল নিশ্চয়ই করবে।

Related posts

পূর্ব বর্ধমানে করোনায় প্রথম মৃত্যু – মেমারির ৭০ বছরের বৃদ্ধের

E Zero Point

বিরোধী শিবির ছেড়ে শতাধিক সিপিএম-বিজেপি কর্মীর যোগদান তৃণমূলে

E Zero Point

মেমারিতে লকডাউন কার্যকরী করতে গেলে ৫ দিনে ৫০০০ টেস্ট হোক

E Zero Point

মতামত দিন