26/04/2024 : 2:37 AM
জীবন শৈলীধর্ম -আধ্যাত্মিকতা

জেনে নিন রটন্তী কালী পুজোর কাহিনী

জিরো পয়েন্ট প্রতিবেদন৩১ জানুয়ারি ২০২২:

অশোক কুমার ভট্টাচার্য


এক মনোমুগ্ধকর লীলায় শ্রীকৃষ্ণ পরিণত হয়েছিলেন দেবী কৃষ্ণকালী রূপে। এই দেবী কৃষ্ণকালী রটন্তী কালী নামেও পরিচিত। মাঘ মাসের চতুর্দশী সংযুক্ত অমাবস্যায় রটন্তী কালীপূজা হয়। “রটনা” শব্দের অর্থ প্রচার হওয়া। দ্বাপরযু‌গে এই তি‌থি‌তেই জগন্মাতা মুক্তকেশী শ্রীশ্রী রটন্তী কা‌লী মাতার অপার মহিমা ধরাধা‌মের চতুর্দিকে রটনা হ‌য়ে যায় অর্থাৎ শ্রীশ্রী রটন্তী কালী মাতার কৃপা ও আশীর্বাদ ইহ জগ‌তের চতুর্দিকে তাঁর সকল ভক্তগ‌ণের প্র‌তি বর্ষিত হতে থা‌কে। দেবী কৃষ্ণকালী রটন্তী কালী মাতার আরাধনা করলে গৃহস্থের সর্বপ্রকার দুঃখের বিনাশ হয়। মোক্ষলাভ করেন সাধক।


শাস্ত্রে উল্লেখিত কাহিনী অনুসারে শ্রীরাধা যখন শ্রীকৃষ্ণের প্রেমলীলায় মত্ত তখন একদিন বেলা দ্বিপ্রহর। মেঘহীন নীল আকাশের নীচে থাকা সবুজ কুঞ্জে আপন মনে বাঁশী বাজাচ্ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। মোহনবংশীধারী শ্রীকৃষ্ণের বাঁশীর প্রাণকাড়া সুর, সীমাহীন প্রান্তর পেরিয়ে চলে যাচ্ছিল অনেক দূরে। দূরের গ্রামে থাকা গোপনারীরা যদুকুলপতির বাঁশীর সুর শুনে চঞ্চল হয়ে উঠেছিলেন। কৃষ্ণপ্রেমে বিভোর, আনমনা শ্রীরাধা তখন সবে উনুন ধরিয়েছিলেন রান্নার জন্য। তাঁর কাছেও পৌঁছে গিয়েছিল মদনমোহনের বংশীধ্বনি। উতলা হয়ে উঠেছিলেন রাধা। কারণ রাস-রাসেশ্বরের আহ্বান ফিরিয়ে দেবার সাধ্য তাঁর নেই। সখীদের নিয়ে দ্রুতপদে রাধা এগিয়ে গিয়েছিলেন কুঞ্জের পথে।


ঘরেই ছিলেন রাধার স্বামী আয়ান ঘোষের বোন কুটিলা। রাধার নিঃশব্দ অভিসার যাত্রা বোন কুটিলা দেখেও না দেখার ভান করেছিলেন। রাধা বাড়ীর চৌকাঠ পার হতেই কুটিলা ছুটে গিয়েছিলেন মা জটিলার কাছে। জটিলাকে বলেছিলেন, “মা, আবার সেই বাঁশী। সেই দুপুর বেলায়, রাধা ঘরে নেই। কী অধর্ম বলত মা ! আয়ান দাদা একটু পরেই বাড়ি ফিরবে। আজই এই অন্যায়ের বিহিত করতেই হবে। আজ হাতে নাতে ধরিয়ে দেব পাপিষ্ঠাকে। আজ আর নিস্তার নেই।” কুটিলার কথা শুনে জটিলার মুখে ফুটে উঠেছিল ক্রূর হাসি। চাপা কণ্ঠে বলেছিলেন, “আজ বাড়ি আসুক আয়ান, আজই এই পাপের হাঁড়ি ভাঙতে হবে।”


কিছুক্ষণ পরেই ঘরে ফিরেছিলেন রাধার স্বামী দুগ্ধ ব্যবসায়ী আয়ান ঘোষ, সম্পর্কে কৃষ্ণের পালিকা মা যশোদার ভাই। বয়েসে রাধার চেয়ে অনেক বড়। রাধার সঙ্গে আয়ানের বিয়ে দিয়েছিলেন কৃষ্ণের পালক পিতা নন্দ। প্রচণ্ড কালীভক্ত ছিলেন আয়ান ঘোষ। দুধের ব্যবসা আর দেবী কালী ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে ভাবতেন না। সেদিন বাড়ী ফিরে রাধার খোঁজ করেছিলেন আয়ান। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল তাঁর। সাড়া না পেয়ে আবার ডেকেছিলেন। এবার বেশ জোরেই। কুটিলা বেরিয়ে এসেছিলেন অন্য ঘর থেকে। দাদাকে বলেছিলেন, “আরোও জোরে চেঁচাও। না হলে তোমার রাধে যে শুনতে পাবে না।” বিরক্তি প্রকাশ করে আয়ান বলেছিলেন, “শুনতে পাবে না মানে ! কোথায় রাধে ?” কপট হাসি হেসে কুটিলা বলেছিলেন, “দেখ, কুঞ্জে টুঞ্জে গেছে কিনা !”


“কুঞ্জে মানে ! কী বলতে চাইছিস পরিষ্কার করে বল কুটিলা। তামাশা করিস না আমার সঙ্গে। খিদেয় পেটে আগুন জ্বলছে। রাধে কোথায় ?”
“বললাম তো একটু আগে কুঞ্জে গেছে।”
“এখন কুঞ্জে ! কী করতে গেছে !”
“ফুল তুলতে গো দাদা। ফুল তুলতে।”
“এই ভর দুপুরে রাধে ফুল তুলতে গেছে। কোন দেবতার পায়ে দেবে শুনি !”
“দেখ, তোমার জন্য মালা গেঁথে আনতে গেছে কিনা !”
রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে আয়ান বলেছিলেন, “তাহলে আমায় খেতে দেবে কে ?” কুটিলা বলেছিলেন, “তা তো বলতে পারব না দাদা। তোমার রাধে বনভোজন করতে গেছে গো সখীদের নিয়ে। সেই বনভোজনে তোমার নামে কুকথা রটাবে হয়ত।” বোনের কথায় তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠা আয়ান বলেছিলেন, “মাথা গরম করাস না কুটিলা। মা কোথায় ! মাও কি বাড়িতে নেই !”
আয়ানের চিৎকার শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন আয়ান জননী জটিলা। ক্রুদ্ধ কণ্ঠে আয়ানকে বলেছিলেন, “তোর বউ উনুন জ্বালিয়ে গেছে। অপেক্ষা কর, এসে ভাত রেঁধে দেবে।”
হতভম্ব ও ক্ষুধার্ত আয়ান মা ও বোনকে বলেছিলেন, তাঁর সঙ্গে মশকরা না করে আসল কথাটা বলতে।


মা জটিলা বলেছিলেন, ”তোকে অনেকবার বলেছি বাবা। আমাদের কথা তো কানেও তুলিস নি। যা সর্বনাশ হওয়ার হয়ে গেছে। এখন তুই তোর বউকে নিয়ে থাক। আমাদের নিস্তার দে। আমাদের জন্য অন্য বাড়ী বানিয়ে দে বাবা। আমরা মা মেয়ে সেখানে চলে যাই। রোজ রোজ এই অধর্ম আর চোখে দেখা যাচ্ছে না। পাড়ায় কান পাতা যাচ্ছে না তোর বউয়ের জন্য।”
কাতর কণ্ঠে আয়ান বলেছিলেন, “আর হেঁয়ালি কোরো না মা। আমায় বল, কী হয়েছে !”
“রাতদুপুরে বাড়ি থেকে উধাও হওয়া তোর ঐ বউয়ের সঙ্গে আমরা থাকতে পারব না বাবা।”
“কিন্তু রাধে আমায় বলেছে রাতে সে আমার জন্য শ্যামাপূজা করে মা।”
হাসিতে ফেটে পড়েছিলেন জটিলা আর কুটিলা। তাঁরা আয়ানকে বলেছিলেন, শ্যামাপূজা নয় শ্যামের পূজা করে আয়ান ঘরণী রাধা। আর এই জন্যই গ্রামে বাস করাই তাঁদের পক্ষে দুষ্কর হয়ে উঠেছে। গ্রামের লোকের দিকে তাঁরা মুখ তুলে তাকাতে পারেন না। সব সময় লজ্জায় মাথা হেঁট করে চলতে ফিরতে হয়।


রাগত কণ্ঠে জটিলা আয়ানকে বলেছিলেন, “তুই তো বাবা চোখ থেকেও কিছু দেখতে পাসনা। তোকে বলে আর কী হবে ! তবে এক বাড়িতে থাকি, তাই আমরা বলে ফেলি। আগে গভীর রাতে কুঞ্জে যেত। এখন সব লজ্জার মাথা খেয়েছে তোর রাধা। দিনে দুপুরে যাচ্ছে অভিসারে। তুই আমাদের অন্য বাড়ি করে দে বাবা। মায়ে ঝিয়ে সেখানে চলে যাই।”
আষাঢ় মাসের আকাশের মতোই অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল আয়ান ঘোষের মুখ। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে আয়ান বলেছিলেন, “তোরা হাতে নাতে ধরিয়ে দিতে পারবি তো ? তাহলে আজই একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাবে।”
“নিশ্চয়ই পারবো। এই মুহূর্তে দুজনকেই কুঞ্জে পাবি। প্রেমলীলায় মগ্ন হয়ে আছে তোর বউ।”
“চল মা, চল বোন, রাধে বলেছিল আমার জন্য নির্জনে শ্যামাপুজো করতে সে কুঞ্জে যায়। যদি তোদের কথা সত্যি হয়,তাহলে আজ রাধের একদিন কি আমার একদিন। আজ আমার হাতেই ওর মরণ লেখা আছে।”


এই বলে আয়ান হাতে তুলে নিয়েছিলেন প্রকাণ্ড একটা লাঠি। জটিলা চিনতেন তাঁর ছেলেকে। এমনিতে সহজ সরল হলে কী হবে, রেগে গেলে আয়ানের মাথায় খুন চেপে যায়। তাই জটিলা বলেছিলেন, স্ত্রী হত্যা করিস না বাবা। তার চেয়ে মেরে হাত পা ভেঙে দিয়ে মাথা ন্যাড়া করে ঘরে বেঁধে রাখ। তাতেও কুলের সম্মানটা বাঁচে। আর গঞ্জনা দেওয়ার জন্য আমরা তো আছিই। ভয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ করা আয়ান ঘোষ বলেছিলেন, “না মা পাপের শেষ রাখব না। এক ঘায়ে পাপের বিনাশ করব। তোমরা বাধা দিও না। আজই ছলনার সমাপ্তি ঘটাব মা। মান রাখব কুলের।”
ওদিকে কালিন্দী নদীর তীরে, ফুলে ফুলে ভরে ওঠা কুঞ্জে নিজের হাতে মদনমোহনকে সাজিয়ে দিচ্ছিলেন রাধা। সখীরা সাজি করে ফুল এনে দিচ্ছিলেন। কেউ বেটে দিচ্ছিলেন শ্বেত চন্দন। ঠিক তখনই সখীরা দেখতে পেয়েছিলেন আয়ানকে। হাতে লাঠি নিয়ে ক্রোধে উন্মত্ত আয়ান কালবৈশাখী ঝড়ের গতিতে কুঞ্জের দিকেই আসছিলেন। আয়ানের সঙ্গে ছিলেন জটিলা ও কুটিলা। ছুটে গিয়ে সেই সংবাদ তাঁরা দিয়েছিলেন ‘ব্রজের গোপাল’ ও শ্রীরাধাকে।


কাতর কণ্ঠে রাধা বলেছিলেন, “এই ভয়ংকর সংকট থেকে আমাকে রক্ষা কর হে প্রভু, হে অনাদির আদি, হে ভব-ভয়হারী।” শ্রীরাধার কথা শুনে স্মিত হেসেছিলেন ‘গোপী মনোহারী’।
দেখতে দেখতে ‘দূর্বাদল শ্যাম’ ধারণ করেছিলেন এক অকল্পনীয় কলেবর। অখিলের সার শ্রীমধুসূদন পরিণত হয়েছিলেন এক চতুর্ভুজা কৃষ্ণকায়া দেবী প্রতিমায়। কুঞ্জবনে আবির্ভূত হয়েছিলেন দেবী কৃষ্ণকালী। কপালে অর্ধচন্দ্রাকৃতি তিলক, কণ্ঠে ঝুলছে মুণ্ডমালা, চার হাতে ধারণ করে আছেন খড়্গ, বংশী, শঙ্খ ও খর্পর। দেবীর সর্বাঙ্গ থেকে নির্গত হচ্ছিল শতসহস্র নক্ষত্রের জ্যোতি। দেবীর রূপমাধুরী তে মোহাবিষ্ট হয়েছিল বিশ্বভুবন।
কুঞ্জে প্রবেশ করে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন মারমুখী আয়ান। তাঁরই আরাধ্যাদেবী শ্রীশ্রীকালীর এক অপরূপ শ্যামামূর্তির সামনে বসে আছেন রাধে। অপলকে তাকিয়ে আছেন দেবীর দিকে। ভাববিহ্বল শ্রীরাধার অশ্রুকণা সবুজ ঘাসে ঝরে পড়ছে মুক্তবিন্দু হয়ে।
অনুতপ্ত আয়ান রাধের পাশে বসে বলেছিলেন, ”তোমার জন্যই আজ মায়ের শ্যামামূর্তি দর্শন করার সৌভাগ্য হল রাধে। আর কখনও আমি তোমায় অবিশ্বাস করব না। আমি গর্বিত তোমার মতো ঘরণী পেয়ে। তুমিও ধন্য তুমি রাধে, তুমিই মা কালীর সবচেয়ে বড় ভক্ত। তাই মা তোমায় নবরূপে দেখা দিয়েছেন।” এই বলে আয়ান দুই হাত জড়ো করে দেবী কাত্যায়নীর স্তবগাথা শুরু করেছিলেন।


জয় আদ্যা সতী, দেবি ভগবতী, অগতির গতি তারা !
নমো নারায়ণি, ব্রহ্ম সনাতনি, চন্দ্রাননি, হর-দারা !
শ্যামা সুরেশ্বরী, ভীমা ভয়ঙ্করী, দিগম্বরী, ঘোরবেশী !
শ্মশান-বাসিনী, শমন-ত্রাসিনী, সুহাসিনী, এলোকেশি !
উমেশ-অঙ্গনা, অঞ্জন-গঞ্জনা, নিরঞ্জনা নিরুপমা !
নামে পূর্ণ আশ, মুক্ত মোহপাশ, দিগবাস-মনোরমা !
নমো নৃত্যকালী, নিশানাথ-ভালী, মুক্তমালী, মহোদরি !
মৃত্যুঞ্জয়-জায়া, দে মা পদছায়া, মহামায়া, মহেশ্বরী !
বরাভয়-করা, অসি-মুণ্ড-ধরা, তাপহরা ত্রিনয়না !
নমো নিস্তারিণী, শিব-সীমন্তিনী, দেহি দীনে কৃপাকণা॥
দেবীর স্তব করতে করতে ধ্যানে বিভোরে হয়ে গিয়েছিলেন আয়ান ঘোষ। নানান উপাচারে দেবী কৃষ্ণকালীর পূজা করেছিলেন শ্রীরাধা। বিপদ আসন্ন অনুমান করে স্থান ত্যাগ করেছিলেন জটিলা-কুটিলা।
সেইদিন থেকে পৃথিবীতে শুরু হয়েছিল দেবী কৃষ্ণকালী রটন্তী কালী মাতার পূজা। কৃষ্ণকালী কালীমূর্তির মতোই। শান্ত, সৌম্য অপূর্ব রূপ তাঁর। পরনে লাল শাড়ী। গয়নায় সুসজ্জিত থাকেন তিনি।


কৃষ্ণকালীর ধ্যান মন্ত্র অনুযায়ী, কৃষ্ণকালী চতুর্ভুজা কৃষ্ণবর্ণা চূড়ামুকুট মণ্ডিতা। দক্ষিণহস্তে শঙ্খ ও খর্পরধারিণী এবং নবযৌবন সম্পন্না। বামহস্তে খড়্গ ও চক্র ধারণ করে আছেন এবং মুণ্ডমালা বিভূষিতা। গোপিনীদের দ্বারা অর্চিতা এবং নানালঙ্কার ভূষিতা। আয়ানের (রাধার স্বামী) দ্বারা ভয়ত্রস্ত শ্রী রাধিকার দ্বারা পূজিতা। চতুর্বর্গ প্রদানকারিনী সেই দেবী ব্রহ্মরূপা সনাতনী। দারিদ্র্য শোক নাশকারিনী এবং মোক্ষদায়িনী। দেবীর পূজায় সকল বিপদ, দুঃখ দৈন দূরে চলে যায়।


যাদের জীবনে দাম্পত্যকলহ চলছে বা যারা কোন অবাঞ্ছিত কারণে দাম্পত্য সুখ থেকে বঞ্চিত বা যারা সদ্য প্রেম হারিয়েছেন অথবা প্রেম নিবেদন করেও তেমন কোন সুফল পান নি তারা এই সময় রটন্তী কালী মাতার আরাধনার মাধ্যমে নিশ্চিত ভাবে সফলতা লাভ করতে পারেন। রটন্তী কালী মাতা মানুষের কোন ইচ্ছাই অপূর্ণ রাখে না। ভক্তিভরে তাঁকে স্মরণ করলে অসাধ্য সাধন করা যায়।

Related posts

মুসলিমদের পবিত্র মাস মাহে রমজানের গুরুত্বঃ পর্ব-১

E Zero Point

বাতাসেও করোনা ছড়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নতুন গাইডলাইন

E Zero Point

আজ কেমন যাবে আপনার দিন ? কী বলছে আপনার রাশি ? চলুন জেনে নেওয়া যাক

E Zero Point

মতামত দিন