জিরো পয়েন্ট নিউজ ডেস্ক, ১৩ জুন ২০২২:
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে পুরুষের সাথে পাল্লা দিয়ে নারীরাও অংশগ্রহণ করেছিলো সে কথা অনস্বীকার্য। কথায় আছে স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ বাংলায় অঙ্কুরিত হয়েছিল। আমরা চেষ্টা করবো আমরা সেই সব মহান স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ইতিহাসকে স্মরণ করার জন্য এবং বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ায় আমাদের লক্ষ্য।
শরীরে দু’বাটি লঙ্কাবাটা ঢোকানো হয়েছিল তাঁর, যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন। আর সেই দৃশ্য দেখে হাসছিল সেখানে থাকা বীর পুঙ্গব পুলিশের দল। অত্যাচারে বার বার জ্ঞান হারাচ্ছিলেন তিনি। মুখে সামান্য জলের ঝাপটা দিয়ে আবার সেই অত্যাচার। তবু তাঁর মুখ থেকে একটি কথাও বার করতে পারেনি ইংরেজের বেতনভুক পুলিশের দল। তিনি ননীবালা দেবী। বাংলার প্রথম মহিলা রাজবন্দি। জন্ম ১৮৮৮ সালে, হাওড়া জেলার বালিতে। বাবা সূর্যকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, মা গিরিবালা দেবী। ১৮৯৯ সালে মাত্র এগারো বছর বয়সে বিয়ে। পাঁচ বছরের মাথায় ১৯০৪ সালে স্বামী মারা যান। তাঁর বয়স তখন মাত্র ষোলো। এর পর তিনি তাঁর বাবার কাছেই ফিরে আসেন।
ননীবালা দেবী ( ১৮৮৮-১৯৬৭) ষোল বছরে বিধবা হয়ে তাঁদের বাড়িতেই থাকতেন। নিজে উৎসাহী হয়ে ভাইপোর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন। ননীবালা দেবী কখনো চন্দননগরে কখনো রিষড়াতে গৃহকর্তৃ সেজে ঘরভাড়া নিয়ে বিপ্লবীদের আশ্রয় দিতেন আর পুলিশের চোখে ধুলো দিতেন। কলকাতার শ্রমজীবী সমবায়এ হঠাৎ পুলিশ এসে হাজির হয়েছিল। বিপ্লবী অমরেন্দ্র পালিয়ে গেলেও, ধরা পরেছিল রামচন্দ্র মজুমদার। রামচন্দ্র মজুমদার তাঁর ‘মসার’ পিস্তল কোথায় রেখে গেছেন জানার জন্য কুলীন ব্রাহ্মণের বিধবা ননীবালা দেবী সধবা সেজেছিলেন। না রঙ্গমঞ্চে নয়, স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিমঞ্চে দাপিয়ে অভিনয় করেছিলেন ননীবালা। রামচন্দ্র বাবুর স্ত্রী সেজে শাখা সিঁদুর পরে জেলে গিয়ে জেনে এসেছিলেন পিস্তলের খবর। তাঁর মত বিধবাদের একাদশীর উপবাস ছিল জীবনসঙ্গী, চা খেলেও জাত যেত, সিন্দুর তো দূরের কথা লালরঙ থেকে দূরে থাকত তারা। অন্যের স্ত্রী সাজার জন্য শাখা সিঁদুর পরা অত্যন্ত দুঃসাহসিক পদক্ষেপ ছিল, সমাজের চোখে ছিল বেশ্যাবৎ কর্ম। পুলিশ জানতে পারল আগেই ননীবালা দেবী তাঁর ছোটবেলার বন্ধুর দাদা প্রবোধ চন্দ্র মিত্রের সঙ্গে পেশোয়া চলে গেলেন। সেযুগে একজন বিধবার পরপুরুষের সঙ্গে দেশছাড়া মানে সমাজের কাছে ‘চোখেরবালি’ হওয়া। তবু সমাজকে থোড়াই কেয়ার করলেন দেশের জন্য, পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তি ছিল তাঁর একমাত্র কাম্য।
তিনি দেশছাড়ার পর পুলিশ তাঁর বাবা সূর্য কান্ত ব্যানার্জীকে ইলিসিয়াম রো তে নিয়ে গিয়ে সকাল দশটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত জেরা করত। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে পুলিশ পেশোয়া গেলো। তিনি ধরাপড়লেন যখন তখন তিনদিনের কলেরার রুগী। স্ট্রেচারে করে আনা হয়েছিল তাঁকে হাজতে, তারপর কাশীর জেলে। জেরা করে কিছু জানতে না পেরে জিতেন ব্যানার্জী লংকা বেটে তাঁর যৌনাঙ্গে ঢেলে দেবার মত অত্যাচার চালিয়েছিল। যন্ত্রনায় ছটফট করেছেন, চিৎকার করেছেন তবু কারও সন্ধান দেননি। পরে আলো বাতাসহীন শেলেও সংজ্ঞা হারিয়েছেন বারবার তবু বিপ্লবীদের কোনো সন্ধান দেননি। তিনি ছিলেন প্রথম মহিলা রাজবন্দী। জেলের সুপার ইন্টেন্ডেন্ট গোল্ডির কথামত দরখাস্ত লিখেছিলেন জেলারকে সারদামায়ের কাছে যেতে চেয়ে কিন্তু গোল্ডি নিজে হাতে ননীবালার সামনে সেই দরখাস্ত ছিঁড়ে ফেললে সপাটে চড় বসিয়ে দিয়েছিলেন গোল্ডির গালে।
এমনই আত্মসম্মান বোধ ছিল তাঁর। আর ছিল মমত্ববোধ, দু কড়িবালা নামে এক বিপ্লবী ঐজেলে থার্ড গ্রেডের শাস্তি পাচ্ছেন জেনে দাবি করেছিল বামুনের মেয়ের হাতের রান্না না হলে অনশন ভাঙ্গবেন না। বামুনের মেয়ে বলতে দুকড়ি বালা দেবীর কথাই বুঝিয়েছিলেন যে! দুকড়িবালা দেবীর শাস্তি লাঘব করতে তাঁকে নিজের রান্না করিয়ে ঊনিশদিন পর অনশন ভাঙ্গেন। এহেন মহিলা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সকলের কাছে অবাঞ্ছিত হলেন। বালি ছেড়ে কলকাতায় আসতে বাধ্য হলেন। শেষ জীবনে রান্নার কাজ করে ছোট্ট ঘর ভাড়া নিয়ে নিঃসঙ্গ জীবন কাটালেন। শেষ জীবনে টিবি রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে ১৯৬৭ এর মে মাসে শেষ ৫০ টাকা পেনশন পেয়েছিলেন। এর পর তাঁর আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
(ইতিহাস সাক্ষী আছে, কোনও দেশের গৌরব তখনই সঞ্জীবিত থাকে যখন তা নিজের আত্মাভিমান এবং বলিদানের পরম্পরা পরবর্তী প্রজন্মকেও শেখায়। যখন শিষ্টাচার প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সঞ্চারিত হয়। কোনও দেশের ভবিষ্যৎ তখনই উজ্জ্বল হয়, যখন নিজেদের অতীতের অভিজ্ঞতা ও ঐতিহ্যের গর্বের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে থাকে। আর ভারতের তো গর্ব করার জন্য অফুরন্ত ভাণ্ডার আছে, সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে, চেতনা সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক বৈভব আছে। সেজন্য স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপনের এই সুযোগ বর্তমান প্রজন্মের কাছে অমৃতসম হয়ে উঠবে। এ এমন অমৃত যা আমাদের প্রতি মুহূর্তে দেশের জন্য বাঁচতে, দেশের জন্য কোন কিছু করতে প্রেরণা জোগাবে। জিরো পয়েন্ট আজাদি কা অমৃত মহোৎসবের এই যাত্রায় পা মিলিয়েছে। জিরো পয়েন্ট তার পাঠক-পাঠিকা সহ সকল ভারতবাসীর জন্য এই মহৎ উদ্যোগক সফল করার জন্য সচেষ্ট। আসুন সকলে মিলে আজাদি কা অমৃত মহোৎসব পালন করি। আপনিও অংশগ্রহণ করতে পারেন এই আজাদি কা অমৃত মহোৎসবে। আপনার এলাকার কোন স্বাধীনতা সংগ্রামী সম্পর্কে জানা থাকলে তার সম্পর্কে লিখে পাঠান আমাদের জিরো পয়েন্ট এর ইমেইল অথবা ওয়াটসঅ্যাপে আমরা তা প্রকাশ করবো আমাদের ওয়েবসাইটে।)