28/03/2024 : 8:13 PM
ই-ম্যাগাজিনসাহিত্য

একুশের অনুভূতি – ২১ স্রষ্টার একুশে শ্রদ্ধাঞ্জলি

জিরো পয়েন্ট স্রষ্টা সেখ আনসার আলি প্রতিষ্ঠিত

জিরো পয়েন্ট সাহিত্য আড্ডা
একুশের অনুভূতি – ২১ স্রষ্টার একুশে শ্রদ্ধাঞ্জলি

মেমারিতে একুশে উদ্যানে অস্থায়ী ভাষা শহীদ স্মারকে শ্রদ্ধা অর্পন করা হলো মেমারি পৌরসভার উদ্যোগে

১) সুব্রত মণ্ডল

বাংলা আমার অহংকার

আসবে একুশ যাবে একুশ
রক্তের দাগ রবে।
ভাষার জগতে শ্রেষ্ঠ ভাষা
বাংলা, ভাষার গৌরবে।

আমার ভাষা আমার শব্দ,
আমার কান্না হাসি।
মিষ্টি ভাষা বাংলা আমার,
তাই, বাংলা ভালোবাসি।।

আমার ভারত ভূমিতে বাস,
পরি, বাংলার বেশভূষা।
বাংলায় গায় গান,
বাংলা, আমার মাতৃভাষা।।

আমার অনুভূতি সুখ দূঃখ
বাংলাতে করি প্রকাশ।
মধুর সুরে বাংলা গানে
রুক্ষ জমি করি চাষ।।

বাংলার বাউল পল্লী গীতি
ভাটিয়ালি কবি গান।
রবি-নজরুল বিশ্ব সাহিত্যে
বাংলা ভাষার রেখেছে মান।

আন্তর্জাতিক ভাষা মর্যাদা
বাঙালি মানেনি হার।
বাংলা আমার মাতৃভাষা,
বাংলা, আমার অহংকার।।

 

২) আফরিন আবৃত্তি আলি

মেমারি, পূর্ব বর্ধমান

বিশ্ব ভাষা, মনের ভাষা

 

৩) মিতালী মুখার্জী

রহড়া, খড়দহ

দাড়িভিটের মাটি

নিরুদ্দেশের যাত্রা ছিল
সামনের পথ নেইকো জানা
বাংলা ভাষার মান বাঁচাতে
শুনিনি তাই মায়ের মানা।

বাঙলা ভাষা আমার ভাষা
এই ভাষা তাই মাতৃসমা
এই ভাষাতেই ক ই যে কথা
এই ভাষা তেই চাইছি ক্ষমা।

এই গ্রামেতেই জন্মেছিলাম
বাঙলা মায়ের পরম স্নেহে
উর্দু ভাষার বিরোধ করে
আগুন গোলা লাগলো দেহে।

নিরুদ্দেশের যাত্রা একা
দুঃখ নেইতো মনের কোনে
তোর কোলেতেই আসবো আবার
ছেলেকে তোর রাখিস মনে।

দাড়িভিটের গাছ আর মাটি
আবার আমি আসবো ফিরে
দূর থেকে আজ জানাই প্রণাম
মাগো তোমায় অশ্রুনীরে।

***
ভাষার জন্য জীবন দিল
কিশোর দুটি দামাল ছেলে
জন্মদিনের পায়েস জুড়ায়
আজ ও মায়ের অশ্রুজলে।

আজ ও দু”জন আছে শুয়ে
দোলঞ্চ ওই নদীর তীরে,
রাজেশ তাপস এই দুটি নাম
থাকবে সবার হৃদয় জুড়ে।
ভাষা শহীদ রাজেশ তাপস
থাকবে সবার হৃদয় জুড়ে।

৪) ড. শর্মিষ্ঠা চক্রবর্তী

২১শে

মানুষ অনেক কিছুর জন্য প্রাণ
দেয়-
ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ।
ভালোবাসার জন্য প্রাণ দিলে
ইতিহাস লেখা হয়।

মানুষ অনেক বার চোখের জল
ফেলে-
হারিয়ে গেলে, হারিয়ে ফেললে।
ভালোবেসে কারও জন্য কাঁদলে
তা অমৃত হয়।

মানুষ অনেক কিছুর কাছে ফিরে
আসে-
মাটির কাছে,নদীর কাছে।
মায়ের কাছে এলে অদৃশ্য বৃত্ত
সম্পূর্ণ হয়।

সারাজীবন ধরে আশ্রয় খোঁজে
মানুষ –
প্রেমের কাছে,বিশ্বাসের কাছে।
ভাষার কাছে আশ্রয় খুঁজে পেলে
২১শে ফেব্রুয়ারি হয়।

৫) ডঃ রমলা মুখার্জী

বৈঁচী, হুগলী

বাহান্নর বাংলাভাষা আন্দোলন ও নারীদের ভূমিকা

বাংলার বাহান্নর ভাষা আন্দোলন সমগ্র পৃথিবীর মাতৃভাষার আন্দোলনের ইতিহাসে এক গৌরবময় গাথা। জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ বাংলার এই ভাষা আন্দোলন তার পরবর্তী সময়ে বাঙালিয়ানার যে জোয়ার নিয়ে এসেছে সেটা আমাদের বাংলাভাষীদের জাতীয়তাবোধের জন্ম দেয়। আর এই জাতীয়তাবোধের উৎসারিত চেতনা থেকেই সমগ্র পৃথিবীরবাসী এখনও সব সংগ্রামের প্রেরণা পায়। শোষণের বিরুদ্ধে, নির্যাতনের বিরুদ্ধে, দাবি আদায়ের সংগ্রামে জনজীবনকে নতুন করে উজ্জীবিত করে বাংলার মাতৃভাষা আন্দোলনের স্মৃতি।

বাংলার ভাষা আন্দোলন তথা একুশের চেতনার জন্ম হয়েছিল একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের মাধ‍্যমে।
তৎকালীন পাকিস্তানে ছাপ্পান্ন শতাংশের মুখের ভাষা ছিল বাংলা কিন্তু শতকরা সাত জনের মুখের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে উদ‍্যত হয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এবং ১৯৪৮ সালে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জন‍্য তারা ঘোষণা করে দেয়। এর প্রতিবাদে গর্জে ওঠে আপামর বাঙালি এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে তারা আন্দোলন শুরু করে। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫১-র মধ্যে তা ক্রমশই জোরালো হয়ে উঠতে থাকে।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ ও সাধারণ ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। পাকিস্তান সরকার আন্দোলন দমন করার জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে সমস্ত মিটিং-মিছিল নিষিদ্ধ করে দেয়। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙলে পুলিশ তাদের ওপর নির্মমভাবে গুলি চালায়। শহীদ হন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতসহ আরও অনেকে।
পরদিন শহীদদের স্মরণে গড়া হয় শহীদ মিনার। পুলিশ তা ভেঙে ফেললে আবারও গড়ে ওঠে শহীদ মিনার। ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তায় জন্ম নিয়েছিল একুশের চেতনা।

অনেক নারীরাও একুশের বাংলাভাষা আন্দোলনে এগিয়ে এসেছিলেন কিন্তু তাঁরা অন্তরালেই রয়ে গেছেন। ভাষা-আন্দোলনকারী নারীদের মধ‍্যে যে নামটি সবার আগে উঠে আসে তিনি হলেন দৌলতুন্নেসা খাতুন। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রেরণা বহু নারীরাই তাঁর কাছ থেকে পেয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি ছিলেন সে সময় বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের একজন সংগ্রামী উদ্যোক্তা। ১৯৩৫ সালে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণকারী অধ্যাপিকা চেমন আরার নামও এ প্রসঙ্গে উল্লখ‍্য। ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংগঠক তমুদ্দন মজলিসের সঙ্গে ১৯৪৮ সাল থেকেই চেমন আরা সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং এ সময় থেকেই সভা ও মিছিলে যোগদান শুরু করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে চেমন আরা ইডেন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী হয়ে নেতৃত্ব দেন। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শহীদ বরকতের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে যে মিছিল বের হয়, সে মিছিলে চেমন আরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। আর এক নারী, শামসুন নাহার আহসান; জন্ম তাঁর ১৯৩২ সালে ১১ মে বরিশাল জেলার আলোকান্দায়, ৫২ এর ভাষা আন্দোলনে ঢাকার রাজপথে প্রায় সব ছাত্র মিছিলে ও পিকেটিংয়ে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালের ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে সব মিছিল ও সমাবেশ হয়েছিল তার প্রায় সব মিছিলেই শামসুন নাহার অংশগ্রহণ করেছিলেন। ড. হালিমা খাতুনের নামও উল্লেখযোগ্য যাঁর জন্ম ১৯৩৩ সালের আগস্ট মাসে বাগের হাট জেলার বাদেকা পাড়া গ্রামে। ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের লক্ষ্যে তিনি প্রস্তুতিমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং একুশের সকালে তার দায়িত্ব ছিল পিকেটিং করা। আহত ভাষা সৈনিকদের চিকিৎসা ব্যায় বহন করার জন‍্য তিনি সে সময় সহকর্মীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলেছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি এভাবেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।


বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সেই সংগ্রাম মূখর দিনগুলোতে নারী সমাজের সক্রিয়ভাবে আরও যাঁরা অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন-
বেগম সুফিয়া কামাল, সানজিদা খাতুন, সৈয়দা লুৎফুন্নেসা খাতুন, রাণী ভট্টাচার্য, নুর জাহান বেগম, মাহমুদা খাতুন, বেগম জাহানারা মতিন, সারা তৈফুর, সোফিয়া খাতুন, জোবেদা খাতুন, রাবেয়া খাতুন, মিসেস কাজী মোতাহার হোসেন, সৈয়দা শাহরে বানু চৌধুরীসহ আরও অনেক নাম না জানা নারী।
১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা আন্দোলনের যে সব নারীরা জীবন কে বাজী রেখে তুচ্ছ জ্ঞান করে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষাকে ছিনিয়ে এনেছেন, তাঁদেরও আমরা শ্রদ্ধার সাথে পুরুষদের সাথে স্মরণ রাখব।

স্বাধীন বাংলাদেশের অঙ্কুরোদ্গম হয়েছিল সেই ১৯৫২ সনে, ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। পরবর্তীতে এই আন্দোলনের হাত ধরেই নিষ্পেষিত নির্যাতিত বাঙ্গালীরা এক সময় বিস্ফোরিত হয় ১৯৭১ এ সেই রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধে, যা এনে দিয়েছিল এক স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। পরবর্তীতে অন্যান্য দেশও এই আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে কখনো কারো উপর ভাষা বা অন্য কিছু চাপিয়ে দেয়ার সাহস করেনি। কিন্তু ভীষণ কষ্ট হয় যখন দেখি বাঙালিরা মাতৃভাষার চাইতেও অন্য ভাষায় কথা বলতে বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে, গর্ববোধ করছে। বাংলার সাথে বিদেশী ভাষা মিশিয়ে নয় তো হিন্দি মিশিয়ে বলার এক প্রবণতা নতুন প্রজন্মের মধ্যে প্রায়শই দেখা দিচ্ছে। “আমরা সব বাঙালিরা বিশুদ্ধ বাংলায় কথপোকথন করবো, বাংলাভাষার ওপর শ্রদ্ধাশীল হব” এই শপথের পথ ধরে হাঁটলেই পারবো আমরা বাংলাভাষাকে বাঁচাতে। এত রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ভাষা বাংলাভাষা যুগে যুগে সমাদর পাক। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস একুশে ফেব্রুয়ারি পরম শ্রদ্ধার সাথে পালন করি আমবাঙালি।

৬) মিরাজুল সেখ

জঙ্গিপুর মুর্শিদাবাদ

আমার ভাষা

আমার ভাষা বাংলা ভাষা
বাংলা আমার প্রাণ,
ভুবন জুড়ে ছড়িয়ে গেছে
বাংলা ভাষার ঘ্রাণ।

নদীর ঘাটে সবুজ মাঠে
বাংলার কলতান,
সোনালি রোদে উড়িয়ে ধুলো
বাংলা বাংলা গান।

পথের পানে অবুঝ মনে
বাউল ফকির ওই,
একতারাটি বাজিয়ে বলে
বাংলা আমার সই।

দেশ বিদেশে নানান ভাষা
নয়তোরে যাযাবর,
প্রাণের ভাষা বাংলা ভাষা
ধরার একক বর।

প্রভাত কুলে ফুলের কুঁড়ি
বঙ্গ ভূমির মান,
বাংলা ভাষা আমার ভাষা
শালিক পাখির গান।

৭) দীপঙ্কর বেরা

বাংলা ভাষা

বাংলা ভাষা আজ অনেকটা পথ পেরিয়ে তার মর্যাদার গৌরব ভূমিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। সেদিনের সাধুভাষা, তৎসম শব্দের ব্যবহার, অবোধগম্য সাহিত্য ভাষা ও বিশেষ ছন্দ প্রকরণ ইত্যাদি থেকে এদিনের বাংলা ভাষা বেরিয়ে আসতে পেরেছে।
যতই কিছু কিছু ‘বাংলাটা ঠিক আসে না’ বাবুবেশধারী আসুক না কেন সেদিনের বাংলা ভাষা আজ এদিনে কথ্য ভাষায় চলতি ভাষায় রাস্তা ঘাটের বলতি ভাষায় অসামান্য যুগোত্তীর্ণ সাহিত্য সৃষ্টি করছে। ফলে বহু বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে বাংলা ভাষা ছড়িয়ে পড়ছে গল্প কবিতা গান আবৃত্তি ও ভাবনার মাধ্যমে।
এখন আর এবে যবে তোমা মম ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হয় না। স্বরবৃত্ত অক্ষরবৃত্ত মাত্রাবৃত্ত পয়ার মহাপয়ার সনেট চতুর্দশপদাবলী হাইকু ইত্যাদি ছন্দের জামা উল্টেপাল্টে পরিবর্তন করে সেদিনে মধুসূদন রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে জীবনানন্দ শঙ্খ সুনীল জয়ের সাথে সাথে বাংলাভাষা আজ ইন্টারনেট ইবুক ব্লগে এসে পৌঁছেছে তার আপন মহিমায়।


চর্যাপদের পরে তদ্ভব প্রাকৃত অপভ্রংশ পেরিয়ে আজ ‘আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়’ এসে পৌঁচেছে।
তারই ফলশ্রুতি হিসেবে বরাকর শিলচর মানভূম ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে ২০০০ সাল থেকে ইউনেস্কোর স্বীকৃতিতে অমর একুশের জন্য গোটা বিশ্ব ২১ ফেব্রুয়ারি পালন করে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। একুশের শহিদেরা হয়ে উঠতে পেরেছে গোটা বিশ্বের প্রতিটি ভাষার প্রতিটি বর্ণমালার পাহারাদার। এর আগে বরকত, রফিক, সালাম জব্বারের উদ্যেশে এই দিনটি শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হত।
বাংলাভাষাভাষী বহু প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব আপন মহীমায় সাহিত্য ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের গৌরবজ্জ্বল উপস্থিতির ছাপ রেখে চলেছেন আজও।
বাংলাভাষা এখনো তাই মণি মুক্তোয় ভরা। সেদিনের রবীন্দ্র নজরুল সঙ্গীতের সাথে সাথে বাংলা ব্যাণ্ডও তার নিজস্ব জায়গা করে নিয়েছে। কবিতা গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ গান ইত্যাদি সাহিত্যের প্রতিটি ধারায় বাংলাভাষা বিশ্বের দরবারে এখনো সমান জনপ্রিয়। তাই তো আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তকমেলায় বাংলাভাষার যথেষ্ট প্রাধান্য দেখা যায়।

৮) গৌর গোপাল পাল

লাভপুর, বীরভূম

একুশে ফেব্রুয়ারি

পাক সেনাদের বুলেটের ঘায়ে
ঝরে গেল কত প্রাণ!
মাতৃভাষাকে রক্ষার দায়ে
তারা হল মহীয়ান!!

সফিক সালাম বরকত ভাই
বাংলা ভাষার জন্য!
দিয়েছিল প্রাণ জানে তা সবাই
তাইতো হয়েছে ধন্য!!

জব্বারে নিয়ে রফিকও হাজির
হয়েছিল ময়দানে!
প্রাণ দিয়ে তারা গড়েছে নজির
সে কথা সকলে জানে!!

রক্ত ঝরানো সেদিনটা ছিল
একুশে ফেব্রুয়ারি!
তাদের সে কথা আমরা কি বলো
কখনো ভুলতে পারি!!

৯) পূর্বায়ণ চ্যাটার্জী

মেমারি, পূর্ব বর্ধমান

একুশ আমার অহঙ্কার

১০) অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য দুঃখিত এই কবিতাটি মুঝে ফেলা হলো পেজ থেকে

১১) সুনীল কৃষ্ণ বণিক

“আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” প্রসঙ্গে দুচার কথা

“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী আমি কি ভুলতে পারি ?”
—আব্দুল গফ্ফর চৌধুরী।
সত্যিই ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আমরা,বাঙালিরা, কখনই ভুলতে পারব না।মাতৃভাষা প্রেমী পৃথীবীর কোন মানুষই এই দিনটিকে ভুলতে পারবেন না। স্মরন করবেন। হৃদয়ের মনিকোটায় এই দিনটিকে সুরক্ষিত রাখবেন জীবনভোর। ১৯৫২খ্রীষ্টাব্দের ২৭শে জানুয়ারী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকার পল্টন ময়দানে উচ্চকিতকন্ঠে উর্দুকে মাতৃভাষা করার পক্ষে সওয়াল করেন। এতে প্রচন্ড ক্ষুদ্ধ ছাত্র ছাত্রীরা চরম আন্দোলনের শপথ নেয়। পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী ২১শে ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে সমবেত হয়।অবস্থা বেগতিক দেখে প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। শুরু হয় নিরস্ত্র ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণ।ঘটনাস্থলেই মারাযান আব্দুল সালাম, আব্দুল বরকত সহ আরও অনেকে।অহিউল্লাহ নামে ৮|৯ বছরের এক শিশুও নিহত হয়।এর পর আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে সারা দেশ।22শে ফেব্রুয়ারি সরকারের দমন নীতির শিকার হন আরও অনেক সাধারণ মানুষ। আন্দোলন চরম সাফল্য পায় ১৯৫৪ খ্রীষ্টাব্দের ৭ই মে।সেই দিন মুসলিমলীগের সমর্থনে “বাংলাকে” রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়। পৃথিবীর সব বাঙালির কাছেই ২১শে ফেব্রুয়ারি একটি অত্যন্ত পবিত্র দিন।

এই ভাষা আন্দোলনই ১৯৭১খ্রীষ্টাব্দে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের প্রস্তুতি পর্ব হিসাবে চিহ্নিত হয়।১৯৯৯ খ্রীষ্টাব্দের ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কো দিনটিকে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে স্বীকৃতি দেন । ভাষার জন্য বাংলাদেশ রাষ্ট্রগঠন– পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীন বাংলাদেশে রূপান্তর সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসাবে আজও চিহ্নিত হয়ে আছে। পরিশেষে বলি- আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ২১শে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর সকল মানুষের কাছে একটি পবিত্র দিন।এদিন সবাই যে যার মাতৃভাষাকে স্মরণ করবে, মনন করবে, হৃদয়েও গভীর শ্রদ্ধা জানাবে। “ও আমার ভাষা
আমি তোমারই ভিতরে ফিরি
চুপ করে থাকতে থকতে যখন
আমার জিভ অসাড় হয়ে যায়
আমার আত্মা দুঃখ হয়ে ওঠে”।

১২) সেখ আব্দুল মান্নান

মুকুন্দপুর, কলকাতা

ভাষা জননী

তুমি আছো বলেই
খিদের জ্বালায় ককিয়ে ওঠে শিশু,
বইয়ের পাতায় অক্ষরেরা বেজে ওঠে ঝমঝম।
চোখের ভাষা ভালোবাসা হয়ে
ঝরে পরে টুপটুপ,
প্রেমিকের চিঠি আশা ভালোবাসা
জাগায় প্রেমিকার চোখে,
প্রবাসী সন্তানের দূরালাপ
ভিজিয়ে দেয় জননীর চোখ।

তুমি আছো বলেই
খামে ভরা প্রেম প্রিয়াকে পাঠায় সেনানী,
রাষ্ট্রসঙ্ঘে শান্তিচুক্তির অঙ্গীকার করে রাষ্ট্রনেতা,
পুরুষের অহংকারের খাস তালুকে নারী স্বাধীচেতা,
যারা এতদিন ছিল অন্ত:পুরে শুধু রমনী ও মাতা ।

তুমি আছো বলেই
বরকত,জব্বাররা মৃত্যুকে করেছিল বরণ নির্দ্বিধায়,
‘একবার বিদায় দে’মা’ বলে
ফাসির মঞ্চে গেয়েছিল গান
শহিদ ক্ষুদিরাম,
গুলিবিদ্ধ মুমূর্ষু মাহাত্মা
শেষবার উচ্চারণ করেছিল – হে রাম।

তুমি আছো বলেই
বিশ্বকবির জয়টিকা পরেছিল রবীন্দ্রনাথ,
কাল কুঠুরিতে বসে দুখু মিয়া জ্বেলেছিল
বিদ্রোহের আগুণ,
প্রকৃতি প্রেমের বিপ্লব ঘটিয়েছিল জীবনানন্দ দাশ,
রানার কবিতায় জীবনের জয়গান গেয়েছিল সুকান্ত।

তুমি আছো বলেই
প্রচার মাধ্যমে মেকি দেশভক্তির
কথার ফানুস রাষ্ট্রনেতার,
একমুঠো অন্ন দাও’ বলে
নিরন্ন ভিখিরি হাত পাতে দ্বারে,
এজলাসে এজলাসে দানা বাঁধে
সত্য মিথ্যার তুমুল প্রতিযোগিতা।

তুমি আছো বলেই
সৃষ্টির মাটিতে বোনে শব্দের বীজ
শব্দচাষী,
অবুঝ প্রেমিক অর্থহীন ভাষায়
প্রেমিকাকে বোঝায় প্রেমের অর্থ।

তুমি আছো বলেই
‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গড়িয়সি’।


১৩) জয়শ্রী রায় মৈত্র

কৃষ্ণনগর, নদীয়া

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের পিছনে বাংলা

মাতৃভাষাকে বাঁচানোর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি (বাংলা ১৩৫৮,৮ই ফাল্গুন) বাংলাদেশের আন্দোলন । বাংলা ভাষাকে বঞ্চিত করে পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জঘন্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী ছাত্র ও সাধারণ জনগণের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ সারা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল । শহীদ হন শত শত তরুণ । তাদের মধ্যে অন্যতম রফিক, জব্বার, শফিউল, বরকত, সালাম সহ আরো অনেকে । মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার দৃষ্টান্তস্বরূপ ২০১০ খ্রিস্টাব্দের ৫ই আগস্ট জাতিসংঘের সিদ্ধান্তে প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়ে থাকে । কানাডার ভ্যাঙ্কুয়ার শহরে বসবাসকারী দুইজন বাঙালি রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে ঘোষণা করার আবেদন জানান ।

১৯৯৮ সালের ২০শে জানুয়ারি তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেলের প্রধান তথ্য বিভাগের কর্মী হাসান ফেরদৌস রফিককে অনুরোধ করেন যে রফিক যেন জাতিসংঘের অন্য সদস্য রাষ্ট্রের কাছ থেকেও এই ধরনের প্রস্তাব আনার ব্যবস্থা করেন । পরে রফিক, আব্দুস সালাম “মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভারস অফ দা ওয়ার্ল্ড” নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন । পুনরায় তারা কফি আনানকে ‘’এ গ্রুপ অফ মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ অফ দা ওয়ার্ল্ড‘’- এর তরফ থেকে একটি পত্র লেখেন এবং তার একটি কপি ইউ এন ওর দুত ডেভিড ফাউলারের কাছে জমা দেন । মাতৃভাষার প্রেমিক গোষ্ঠীর চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলেন সাত জাতি ও সাত ভাষার দশ জন সদস্য । ফিলোপেন, ইংরাজ, কনট্রিজ, কচি, জার্মান, হিন্দি ও বাংলা এই সব জাতির দশ জন সদস্য । হাসান ফেরদৌস সাহেবের পরামর্শে ১৯৯৯ সালে তারা ইউনেস্কোর ভাষা বিভাগের সচিব জোসেফ পডের সাথে সাক্ষাত করেন । জোসেফের পরামর্শ মতো তারা ইউনেস্কোর অপর এক কর্মকর্তা আনা মারিয়ার সাথে দেখা করেন । আনা মারিয়ার দেশ সুইডেন । কিন্তু তার মাতৃভাষা ইংরেজি । তিনিও চেয়েছিলেন সুইডিশ ভাষার পাশাপাশি তার মত অনেকের মাতৃভাষা ইংরেজি বেঁচে থাকুক সুইডেনে । তিনি সর্বাত্মকভাবে মাতৃভাষা দিবসের জন্য সহযোগিতা করেন । সদস্য হিসাবে ছিলেন একজন ইংরেজভাষী, একজন ক্যান্টোনিজ ভাষী, একজন জার্মানভাষী, একজন কাচ্চিভাষী । ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কোর আনামারিয়ায় ৫টি দেশ ভারত, কানাডা, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড এবং বাংলাদেশ দ্বারা প্রস্তাব আনিতো হয় । ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে এই প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় । ১৮৮টি দেশ এই প্রস্তাবে সমর্থন জানালে ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষিত হয় । ২০০০ সাল থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে জাতিসংঘের সদস্য দেশ সমূহে যথাযথ মর্যাদার সাথে পালিত হয়ে আসছে । ধ্বনিত হয় ১৮৮ দেশের কন্ঠে কন্ঠে— “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলতে পারি ?
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু ঝরা এ ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলতে পারি ?
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলতে পারি ?”

বাংলা ভাষা রক্ষার্থে অসমের বরাক উপত্যকায় যে আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল, সেটিকেও ভাষা আন্দোলনের এক অধ্যায় হিসাবে যুক্ত করা যেতে পারে । অসমের বরাক উপত্যকায় বাঙ্গালীদের উপর অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে ১৯৬১ সালের ৫ ই ফেব্রুয়ারি অসমের কাছারি গণসংগ্রাম পরিষদ সংগঠন তৈরি হয়। অসম সরকারের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ১৯৬১ সালের ১৪ ই এপ্রিল শিলচর, করিমগঞ্জ হাইলাকান্দির মানুষেরা সংকল্প দিবস পালন করেন। বরাকের মানুষের মধ্যে সচেতনতা জাগানোর জন্য এই পরিষদ ২৪শে এপ্রিল থেকে ২ রা মে পর্যন্ত এক দীর্ঘ পদযাত্রা করেন মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য। পদযাত্রার শেষে পরিষদের মুখাধিকারি রথীন্দ্রনাথ সেন ঘোষণা করেন ১৩ই মের মধ্যে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা না হলে ১৯৬১ র ১৯শে মে তারা ব্যাপক হরতাল করবেন। ১৮ ই মে রথীন্দ্রনাথ সেন,বিধুভূষণ চৌধুরী ও নলিনীকান্ত দাস এই তিনজন নেতাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ১৯শে মে শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে হরতাল ও পিকেটিং শুরু হয়। শিলচর স্টেশনে। সকালের শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল হলেও বিকালে স্টেশনে অসম রাইফেলস উপস্থিত হয়। পুলিশ এসে সত্যাগ্রহী দের গ্রেফতার করে নিয়ে গেলে তীব্র প্রতিবাদ করে পিকেটিংকারিরা। জলে আগুন। ডোমকল এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তারপর আসে স্টেশনের প্যারামিলিটারি বাহিনী। বন্দুক ও লাঠি দিয়ে মারতে শুরু করে পুলিশ আন্দোলনকারীদের। তারপর সাত মিনিটের মধ্যে পুলিশ আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে ১৭রাউন্ড গুলি চালায়। ১২ জন লোকের দেহের সেদিন গুলি লাগে। তাদের মধ্যে ৯ জন লোক সেই দিনই মারা যান। পরদিন অর্থাৎ ২০শে মে শিলচর থেকে জনগণ শহীদদের শবদেহ নিয়ে শোক মিছিল করে, জানায় তীব্র প্রতিবাদ। এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর অসীম সরকার বরাক উপত্যকায় সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
প্রতিবছর ১৯শে মে বরাক উপত্যকা সহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে বাংলা ভাষা শহীদ দিবস পালন করা হয়।

মাতৃভাষা যখন বাংলা, তার উৎকর্ষতা সম্পর্কে কিছু কথা বলা উচিৎ। “কোন শিক্ষাকে স্থায়ী করিতে হইলে, গভীর করিতে হইলে, ব্যাপক করিতে হইলে, তাহাকে চিরপরিচিত মাতৃভাষায় বিগলিত করিয়া দিতে হয়। যে ভাষা দেশের সর্বত্র সমীরিত অন্তপুরের অসূর্যস্পশ্য কক্ষেও যাহার নিষেধ নাই, যাহাতে সমস্ত জাতির মানসিক নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিষ্পন্ন হইতেছে, শিক্ষাকে সেই ভাষার মধ্যে মিশ্রিত করিলে তবে সে সমস্ত জাতির রক্তকে বিশুদ্ধ করিতে পারে, সমস্ত জীবন ক্রিয়ার সহিত তাহার যোগ সাধন হয়।‘’ —- বলেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
মানুষ জন্মলগ্ন থেকে স্বাভাবিকভাবে মায়ের কাছ থেকে যে ভাষাটি শেখে তাকে মাতৃভাষা বলা যায় । সাধারণত শিশু ভূমিষ্ঠ হবার পর থেকেই মায়ের কোলে থাকে । সব ব্যাপারেই শিশুটি মাকে অনুসরণ করে । এই ভাবেই সে মায়ের মুখ থেকে বার হওয়া ধ্বনি বা ধ্বনি সমষ্টি শুনে ভাষাকে আয়ত্ত করে । মায়ের হাতে খেতে, হাসতে, ঘুমাতে মায়ের মুখ থেকে ভাষা শেখে । তাই এই ভাষাই হল তার মায়ের ভাষা অর্থাৎ মাতৃভাষা । অনেক ক্ষেত্রে যে শিশুটি জন্মের মুহুর্তেই মাতৃহারা হয় তখন শিশুটি বড় হয় পিতা বা মাতৃস্থানীয়া অন্য কারো কাছে । অন্য কারো তত্ত্বাবধায়নে বড় হলেও তার মুখের ভাষাকে ‘’মাতৃভাষা’’ বলে অভিহিত করা হয় ।

বাংলা ভাষা ব্যবহারে প্রথম সারিতে রয়েছে ভারতের পশ্চিমবাংলা রাজ্য ও বাংলাদেশ । তার পরে আছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, অসম রাজ্যের বরাক উপত্যকা এবং ঝাড়খন্ড রাজ্যের কিয়দংশ । এসকল দেশে সকলে মাতৃক্রোড় থেকেই শেখে এই ভাষা । মাতৃভাষার মাধ্যমে মানুষ নিজের সংস্কৃতির সাথে সুন্দর ও সুষ্ঠু সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে এবং শিশুর কল্পনাশক্তি ও চিন্তা বিকশিত করতে পারে । যেকোনো কঠিন বিষয়কে খুব সহজেই সে প্রকাশ করতে পারে মাতৃভাষার মাধ্যমে । মাতৃভাষার শক্ত ভিত শিশুদের অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যে ও সমাজের মধ্যে তাদের অবস্থান সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি বৃদ্ধি করে এবং পাশাপাশি সার্বিক মঙ্গল ও আস্থা অর্জন করতে পারে । মাতৃভাষা একটি শিশুকে তার সমালোচনা মূলক চিন্তা-ভাবনা ও শিক্ষার দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করে । মাতৃভাষা শিশু-জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শিক্ষাগত কৃতিত্বের অধিকারী হয় । এই ভাষায় বিদ্যালয়ে পড়ানো হলে সহজেই তাদের কাছে বোধগম্য হয় ও খুব সহজেই তারা শিক্ষা লাভ করতে পারে । মাতৃভাষার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল শিক্ষার্থীরা যখন মাতৃভাষায় বিকাশ লাভ করে তখন একই সঙ্গে তারা সমালোচনামূলক চিন্তা-ভাবনা, সাক্ষরতা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার বিষয়গুলিতে উৎসাহিত বোধ করে । শিশুদের ক্ষেত্রে অন্য বিভিন্ন ভাষা শেখার, বোঝার বিষয়ে মাতৃভাষা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে । গবেষক পি. সি. নায়ার শিক্ষা স্তরে বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে উপলব্ধি করেছেন শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে মাতৃভাষা শিশুদের জন্য বিশেষ সহযোগী । পরিবারের কাছে থেকে মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করতে সারা বিশ্বের সমর্থন পায় তারা । পাঠ্যক্রম আরো ভালভাবে বোঝার উপায় এই মাতৃভাষা । সে যখন দ্বিতীয় ভাষায় স্থানান্তরিত হয় তখন শেখা মাতৃভাষার দক্ষতাগুলি বিশেষভাবে কার্যকরী হয় । দক্ষতাগুলি পুনরায় শেখানোর প্রয়োজন হয়না । বিদেশী ভাষা শেখার চাপ মোকাবেলা করার জন্য মাতৃভাষা তাদের অপ্রয়োজনীয় চাপ থেকে বাঁচায় । প্রতিটি মানুষের মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ সমান । দৈহিক বিকাশের জন্য শিশুর ক্ষেত্রে মাতৃদুগ্ধ যেমন অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়, ঠিক তেমনি তার মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে মাতৃভাষার গুরুত্বও অপরিসীম ও তুলনাহীন । বাংলা বাঙালির মাতৃভাষা। বাঙালির জীবনে তার গুরুত্ব অপরিসীম।


“আবুল ফফজলে“ কথায়— “মাতৃভাষার দাবি স্বভাবের দাবি, ন্যায়ের দাবি, সত্যের দাবি । এ দাবির লড়াইয়ে কোনো আপোষ চলে না, মৃত্যুর ভ্রুকুটি উপেক্ষা করেই তার সম্মুখীন হতে হয়।‘’
ভাষাবিজ্ঞান অনুযায়ী জন্মের পর মানুষ তার পরিবেশ থেকে যে ভাষাটি প্রথম শেখে সেই ভাষাতেই সে সর্বাধিক স্বাচ্ছন্দ বোধ করে । সেটিই তার মাতৃভাষা । যেমন বাঙালির মাতৃভাষা বাংলা। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, মাতৃভাষা কিংবা একটি বিশেষ ভাষা শেখার পর বিদ্যালয় শিক্ষার প্রারম্ভে একটি শিশু অন্য ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করে । এতে শিশুটির উপর চাপ বাড়ে । অনেক ভাষাবিদদের মতে, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি যে ভাষায় সে বেশি সময় কথা বলে সেই ভাষাটিই শিশুর মাতৃভাষা হিসাবে গণ্য হওয়া উচিৎ । কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিম কামিনস তাঁর গবেষণায় একটি শিশুর বিকাশ ও মাতৃভাষার মধ্যে যোগসূত্র উন্মোচন করেন । তিনি বলেছেন একটি শিশু একই সঙ্গে দুই বা ততোধিক ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারে । আবার এই শিশু বড় হয়ে বাক্য গঠন করে তার গভীর ধারণা অর্জন করে সামগ্রিকভাবে ভাষার ব্যবহার অধিকতর সহজ করে তুলতে পারে । তিনি এটিও আবিষ্কার করেন যে মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিশু তার দ্বিতীয় ভাষা সনাক্ত করতে এবং তার শিক্ষার দক্ষতা বাড়াতে বা বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয় এবং এভাবে শিশুর জ্ঞান ও দক্ষতা স্থানান্তরিত হয়ে থাকে । তবে মাতৃভাষা শিক্ষার দক্ষতাগুলো ভাষা শিক্ষা পদ্ধতির মধ্যে স্থানান্তরিত হয় । ফলে শিশু তার চিন্তা ধারা ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সাথে খুব সহজেই মানিয়ে নিতে পারে । শিশুর মানসিক বিকাশে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম ।

একটি শিশু মাতৃভাষায় তার পরিবেশের স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে বিদ্যালয়কেও সুন্দর ভাবে উপভোগ করতে পারে এবং সাথে সাথে দ্রুত শিক্ষালাভও করতে পারে । মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রমের কারণে গৃহের কাজগুলিতে তারা পিতামাতাকে সহায়তাও করতে পারে । ফলে পিতা-মাতা ও পরিবারের অন্যান্যদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় থাকে । কাজেই এই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে মাতৃভাষা একটি ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করতে পারে এবং শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্বকে নির্দ্বিধায় আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলতে সমর্থ হয় । শিক্ষার্থীদের আরো ভালো শিক্ষাগত ভূমিকা লাভের দিকে নিয়ে যায় মাতৃভাষা । মাতৃভাষার সাথে অভিভাবকদের পরিচিতি থাকায় তারা তাদের পুত্র-কন্যাদের শিক্ষা দানে সহায়তা করতে পারে মাতৃভাষা । তাদের সন্তানদের শিক্ষা লাভের ব্যাপারে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে পারেন তারা । একটি গবেষণায় বলা হয়েছে বাড়িতে পিতা-মাতাদের স্থানীয় ভাষা অর্থাৎ মাতৃভাষার সাথে সমতা মিলিয়ে চলা বাঞ্ছনীয় । কারণ এই ভাষাটি তাদের কাছে সাবলীল । সুষ্ঠু বাক্য-বিন্যাসের ক্ষমতা অর্জন, নির্ভুল পরিচ্ছন্ন ও দ্রুত লেখার কুশলতা অর্জন সম্ভব হয় শুধু মাতৃভাষারই মাধ্যমে । মাতৃভাষা প্রসঙ্গে ড: চার্লস ডাবলিই ইলিয়ট বলেছেন – ‘’মাতৃভাষা যথাযথ ভাবে শেখাই হচ্ছে যে কোন ভদ্রলোক বা মহিলার জন্য প্রকৃত শিক্ষা….।‘’ সাহিত্য ও সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার জন্য মাতৃভাষা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম । মাতৃভাষা থেকে অপর একটি ভাষায় অনুবাদ প্রকৃত সংলাপের সারাংশটি বহুলাংশে হারিয়ে যায় । মাতৃভাষা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির একাত্মতা ও পরিচয় বোধ তৈরি করে । মাতৃভাষা একটি জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষা করার জীবন্ত প্রতীক । মাতৃভাষা শিক্ষায় আত্মমর্যাদা, সামাজিকতা ও ভৌগলিক অবস্থানগত সম্মান ও বিভিন্ন জাতিগত পটভূমি গঠনের জন্য সম সুযোগ দিয়ে থাকে । আন্ত:সংযুক্ত বিশ্বের কোন ব্যক্তি যদি মাতৃভাষায় পারদর্শী হন তাহলে গবেষকরা বলেন বিশ্বের সাথে যোগ সূত্র রচনা ও কথোপকথন আরো অনেক সহজসাধ্য হয়ে যায় । এজন্যই সহজাত বিকাশের ভাষা হল মাতৃভাষা । বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আর, সি, ট্রেনসের মতে – “মাতৃভাষা হচ্ছে মন্দিরের মত পবিত্র, যার সুচিতা রক্ষা করার জন্য জীবন-পণ করতে দ্বিধাবোধ করা উচিত নয়” । প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব পন্ডিত ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় বাংলা বর্ণ শিক্ষার জন্য রচনা করেছিলেন ‘বর্ণ-পরিচয়’ । বাংলা ভাষায় বিভিন্ন সাহিত্য-কর্মের জন্য কাশীরাম দাস, কৃত্তিবাস ওঝা, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রভৃতি ছাড়াও পরবর্তিতে অনেক কবি-সাহিত্যিক স্মরণীয় হয়ে আছেন । তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন, নজরুল ইসলাম, মধুসূদন দত্ত প্রভৃতি অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক । সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করে বাংলা ভাষার কবি-সাহিত্যিক-দার্শনিক-সঙ্গীত স্রষ্ঠা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সারা বিশ্বে বাংলা ভাষার গৌরব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ।
মো: ওয়াজেদ আলী মাতৃভাষা প্রসঙ্গে বলেছেন – “বাংলা আমাদের মাতৃভাষা এবং এই মাতৃভাষা ও সাহিত্যের যথোচিত সেবা ব্যতীত আমাদের সামাজিক ও জাতীয় উন্নতি একান্তই অসম্ভব ।


মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত পরবর্তীকালে ইংরেজি সাহিত্য চর্চার পাশে মাতৃভাষা বাংলার গুরুত্ব গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন । নিজ মাতৃভাষায় বহু নাটক, প্রহসন, কবিতা তিনি রচনা করেন । মাতৃভাষায় তার উল্লেখযোগ্য অবদান অমিত্রাক্ষর ছন্দ । নিজের মাতৃভাষা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন “ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি, এ ভিখারী দশা তবে কেন তোর আজি ? যা ফিরি অজ্ঞান তুই, যারে ফিরি ঘরে ।‘’
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম মাতৃভাষার মধ্যে আত্মার ধ্বনিকে উপলব্ধি করেছেন। তিনি উপলব্ধি করেছেন মানুষের মন ও মানবিকতার প্রতিধ্বনি । যুগের মন ও বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক রূপের ভিতরেই খুঁজে পেয়েছেন মাতৃভাষার যথার্থ রূপ । তাঁর কথায় মাতৃভাষায় বিদগ্ধ বিন্যাসের যেমন মূল্য আছে তেমনি সহজ, সরল, তীব্র ও ঋজু বাক্যের মূল্যও কিছু কম নয় ।
মাতৃভাষা বাংলা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের উপন্যাসিক হুমায়ুন আজাদ বলেছেন—- “তোমার ‘ অ ‘, ‘আ’ — চিৎকারে সমস্ত আর্যশ্লোকের চেয়েও পবিত্র অজর,
তোমার দীর্ঘশ্বাসের নাম চন্ডীদাস,
শতাব্দী কাঁপানো উল্লাসের নাম মধুসূদন,
তোমার থর থর প্রেমের নাম রবীন্দ্রনাথ,
বিজন অশ্রুবিন্দুর নাম জীবনানন্দ,
তোমার বিদ্রোহের নাম নজরুল ইসলাম’’ ।

প্রতিটি দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে নিজের মাতৃভাষা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । বিভিন্ন ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে সকলের নিজস্বতা আছে । তবে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ তার নিজস্ব দেশের নিজ মাতৃভাষা । তার আসন সবার উপরে । ভাষার ঐক্যতা ও সম্প্রীতি ভাষার মৌলিক অধিকার । শিক্ষা, নৈতিক মানসিকতা, মানবিক বিকাশ এবং সর্বোপরি মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার প্রতি প্রতিটি দেশের প্রতিটি নাগরিকের দৃষ্টিদান অবশ্যই কর্তব্য । তার ফলে মাতৃভাষার উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পাবে এবং সর্বক্ষেত্রেই বিরাজমান হবে । ঠাকুরবাড়িতে ইংরেজি ভাষাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিলেও মাতৃভাষা চর্চা ছিল সবার আগে । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনেপ্রাণে উপলব্ধি করতেন বিদ্যাশিক্ষায় মাতৃভাষার বিকল্প কিছু হয় না । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় — “আমাদের মধ্যে যাহা-কিছু অমর এবং আমাদিগকে যাহা-কিছু অমর করবে, সেই সকল মহাশক্তিকে ধারণ করিবার, পোষণ করিবার, প্রকাশ করিবার এবং সর্বত্র প্রচার করার একমাত্র উপায় যে মাতৃভাষা” । মনোবিজ্ঞান সম্মত পদ্ধতিতে জানা থেকে অজানা এবং সহজ থেকে কঠিন বিষয়ের দিকে এগুনোতে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার ব্যবহার হয় উদ্দেশ্যমুখি, সহজবোধ্য ও প্রাঞ্জল । বিশ্বায়ন, পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতি, দেশপ্রেম, মর্যাদাবোধ, জাতীয়তাবোধ, আত্মসম্মানবোধ, সৃজনশীলতা, শিল্পের ভাব প্রকাশ, স্থিতিশীল মূল্যবোধ অর্জন করে সমাজের একজন দায়িত্বশীল সদস্য হিসাবে তার যথাযথ ভূমিকা পালন করে মাতৃভাষা । চলিত রীতিতে ভাষা প্রয়োগের যথার্থতা জাগ্রত করে মায়ের ভাষা, মাতৃভূমির ভাষা । ভাববস্তু ও বিষয়বস্তুর যথার্থতা নিরূপণে বিশেষ সহায়ক হয়ে ওঠে মাতৃভাষা । অন্তর্জগৎ ও বহির্বিশ্বের যাবতীয় তথ্য প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে জীবনের প্রত্যেকটি পরিস্থিতির মোকাবিলা করে মাতৃভাষা । মৌখিক ও লিখিত প্রকাশভঙ্গির মনোনয়ন দেয় মাতৃভাষা । সমসাময়িক চিন্তাধারার সাথে সঙ্গতি রক্ষা, অন্তর্নিহিত রীতি ও শান্তি-শৃঙ্খলা সম্পর্কে সচেতনতার মাধ্যম হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে মাতৃভাষা । বিশ্বের সকল বিষয়ের রসাস্বাদন ও মর্ম হল মাতৃভাষা ।


কবি, সঙ্গীতজ্ঞ অতুলপ্রসাদ সেনের ভাষায় বলা যায় বাংলা ভাষার উৎকর্ষতা—–
“মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা
তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা
কি যাদু বাংলা গানে গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে
এমন কথা আর আছে গো
গেয়ে গান নাচে বাউল, গান্ গেয়ে ধান কাটে চাষা……..।
….. আ মরি বাংলা ভাষা।।‘’

১৪) পশুপতি দত্ত

আসানসোল. পশ্চিম বর্ধমান

একুশ

ভুলতে পারিনি একুশ তোমায়
ভুলেনি বিশ্ববাসী
শহীদের রক্তে ভিজেছে মাটি
জব্বাররা প্রাণ দিয়েছে হাসি হাসি।

যে ভাষা মায়ের মুখে
শোনায় বড় ভালো
শোণিতের ওই ছিটেতে সেদিন
অভিমানের জয় হলো।

কেঁদেছে আকাশ কেঁদেছে বাতাস
দুঃখে ফেটেছে মায়ের বুক
জীবন গেছে মহৎ কাজে
দুখীর এটাই পরম সুখ ।

 

১৫) সুনন্দা মালাকার

মেমারি, পূর্ব বর্ধমান

আমি বাংলা ভাষা

আমি বাংলা ভাষা। আমি তোমার প্রাণের ভাষা বাংলা ভাষা।
যে দুঃখ গুলো, রক্ত মাখা মুক্তি যুদ্ধ গুলো, সেগুলো আজ থেকে গিয়েছে ইতিহাস এর খাতায়।
রয়ে গেছে শুধুই ২১ শে ফেব্রুয়ারি তোমাদের স্মৃতি সুধায়।
হ্যাঁ আমি পরে রইলাম শুধুমাত্র একটা দিন হিসাবে আন্তর্জাতিক তকমায়।
কারন বাংরেজী আছে আজ তোমাদেরই কাছে ভীষণ একটা পাকাপোক্ত জায়গায়।

১৬) সেখ আজমত হক

জাকরা, বোহার, পূর্ব বর্ধমান

অহংকার

হে বীর বিপ্লবী চলে গেছো তুমি রেখে গেছো কত স্মৃতি;
তোমার ত্যাগের রক্তকণিকা হবে না কভু বিস্মৃতি!
বীর বিপ্লবী সালাম বরকত আব্দুল্লাহর ত্যাগ,
আজও চেয়ে আছে করুন নয়নে, দেখরে জোয়ান দেখ!
বাংলা মায়ের ভিজে গেছে কোল রক্ত নদীর ধারায়;
গৃহ হীন বধূ আজও চেয়ে আছে প্রিয়ের অপেক্ষায়!
সিঁদুর খানি মুছে গেছে কবে, সে কথা কি ভোলা যায়!
কেড়েছিস তোরা দামাল ছেলেরে তার কোন ক্ষমা নাই!
আজও পুব দিকে সূর্য ওঠে, আজও গোধূলি হয়,
বুক নিংড়ানো রক্তের দাগ ভুলি নাই , ভুলি নাই!
ছিলে তুমি প্রিয়ে, আজও আছো হিয়ে, থাকবে চিরকাল;
বুকের রক্ত, করেছো সিক্ত, সরিয়েছো জঞ্জাল!
হয়নি ব্যর্থ, তোমাদের রক্ত, হে শহীদ বীর;
বিশ্ব মাঝারে বাংলা আজকে তুলেছে উন্নত শির!

ভুলবো না কভু,বলিদান হে প্রিয়, ভুলবোনা কভু হায়;
বাংলা ভাষার, সেরা কোন’ ভাষা, জগতে আর যে নাই!
ছিলনা স্বার্থ, হয়নি ব্যর্থ, তোমাদের বিপ্লব;
মরা সেই ডালে, ফুটিয়ে দিয়েছো, ফুল ফল পল্লব!
এটাই মোদের গর্ব হে প্রিয়, এটাই মোদের গর্ব;
বিশ্ব ভাষার জগতে আজিকে, বাংলা পেয়েছে স্বর্গ!!

১৭) কুহেলী বিশ্বাস

বেলডাঙ্গা, মুর্শিদাবাদ

ভাষা শহীদ দিবস

আমরা স্বাধীন ভারতের নাগরিক।এই স্বাধীনতার জন্য অনেক লড়াই করতে হয়েছে। কোটি শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের দেশের স্বাধীনতা। পারতপক্ষে আমরা কোন কিছুই এমনি এমনি পেয়ে যাইনি।সংগ্রাম করে অর্জন করতে হয়েছে।
আমরা বাংলাদেশের ১৯৫২-র ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা সংগ্রামের কথা জানি, যার স্বীকৃতিস্বরূপ ইউনেস্কো এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।অসমেও ভাষা আন্দোলন ঘিরে যেভাবে হাজার হাজার বাঙালিকে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে তারজন্য ২১ ফেব্রুয়ারির পাশাপাশি ১৯ মে ভাষা শহীদ দিবস পালন করা হয়।

আসামের বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল আসাম সরকারের অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, যেহেতু ঐ অঞ্চলের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল বাংলাভাষী।
১৯৬০ সালের এপ্রিলে, আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিতে অসমীয়া ভাষাকে প্রদেশের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার একটি প্রস্তাবের সূচনা হয়।এতে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় উত্তেজনা বাড়তে থাকে।অসমে বসবাসকারী বাংলা ভাষাভাষী তথা অন্যান্য অন-অসমিয়ারা এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলে তাদেরকে চাপ দিয়ে এই সিদ্ধান্তটিকে মেনে নিতে বাধ্য করতে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বসবাসকারী বাংলা ভাষাভাষী মানুষের ওপর শুরু হয় অকথ্য নির্যাতন।যা কিছুদিনের মধ্যেই সারা রাজ্য জুড়ে ভয়াবহ দাঙ্গার রূপ নেয়।

বরাক উপত্যকার বাঙালীদের ওপরে অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে কাছাড় গণ সংগ্রাম পরিষদ নামক সংগঠনটির জন্ম হয়। অসম সরকারের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ১৪ এপ্রিল তারিখে শিলচর, করিমগঞ্জ আর হাইলাকান্দির লোকেরা সংকল্প দিবস পালন করেন । বরাকের জনগণের মধ্যে সজাগতা সৃষ্টি করার জন্য এই পরিষদ ২৪ এপ্রিল একপক্ষ দীর্ঘ একটি পদযাত্রা শুরু করেছিল। ২ মে তে শেষ হওয়া এই পদযাত্রাটিতে অংশ নেওয়া সত্যাগ্রহীরা প্রায় ২০০ মাইল উপত্যকাটির গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচার চালিয়েছিলেন। পদযাত্রার শেষে পরিষদের মুখ্যাধিকারী রথীন্দ্রনাথ সেন ঘোষণা করেছিলেন যে, যদি ১৩ এপ্রিল,১৯৬১ সালের ভিতর বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা না হয়, ১৯ মে তে তারা ব্যাপক হরতাল করবেন। ১২ মে তে অসম রাইফেল, মাদ্রাজ রেজিমেন্ট ও কেন্দ্রীয় সংরক্ষিত পুলিশ বাহিনী শিলচরে ফ্ল্যাগ মার্চ করেছিল।১৮ মে তে অসম পুলিশ আন্দোলনের তিনজন নেতা নলিনীকান্ত দাস, রথীন্দ্রনাথ সেন ও বিধুভূষণ চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে।

১৯ মে তে শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে হরতাল ও পিকেটিং আরম্ভ হয়। করিমগঞ্জে আন্দোলনকারীরা সরকারী কার্যালয়, রেলওয়ে স্টেশন, কোর্ট ইত্যাদিতে পিকেটিং করেন। শিলচরে তারা রেলওয়ে স্টেশনে সত্যাগ্রহ করেছিলেন। সকালে হরতাল শান্তিপূর্ণ ভাবে অতিবাহিত হয়েছিল। কিন্তু বিকালে স্টেশনে অসম রাইফেল এসে উপস্থিত হয়।

নয় জন সত্যাগ্রহীকে কাটিগোরা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের একটি ট্রাক তারাপুর স্টেশনের (বর্তমানের শিলচর রেলওয়ে স্টেশন) কাছ থেকে পার হয়ে যাচ্ছিল । পিকেটিংকারী সকলে তাদেরকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেতে দেখে তীব্র প্রতিবাদ করেন। ভয় পেয়ে ট্রাকচালক সহ পুলিশরা বন্দীদের নিয়ে পালিয়ে যায়। এরপর জনৈক একজন লোক ট্রাকটি জ্বালিয়ে দেয়, যদিও দমকল বাহিনী এসে তৎপরতার সাথে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তারপর পুলিশ স্টেশনের সুরক্ষায় থাকা প্যারামিলিটারী বাহিনী আন্দোলনকারীদেরকে বন্দুক ও লাঠি দিয়ে মারতে শুরু করে। এরপর সাত মিনিটের ভিতর তারা ১৭ রাউণ্ড গুলি আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে চালায়।১২ জন লোকের দেহে গুলি লেগেছিল। তাদের মধ্যে ন’জন সেদিনই নিহত হয়েছিলেন,দু’জন পরে মারা যান।

এই ঘটনার পর অসম সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসাবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।

১৯৬১-র ১৯ মে বরাক উপত্যকার শিলচর রেলস্টেশনে বাংলা ভাষা রক্ষার সংগ্রামে, আসাম সরকারের গুলিতে প্রাণ দেয় ১১ জন। তাঁরা হলেন, কমলা ভট্টাচার্য, কানাইলাল নিয়োগী, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, হিতেশ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্র কুমার দেব, কুমুদ রঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুকোমল পুরকায়স্থ। আজকে তাঁদের উদ্দেশ্যে জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা ও প্রণাম। 🙏🙏🙏

 

১৮) তন্দ্রা বোস

মেমারি, পূর্ব বর্ধমান

বাংলা ভাষা

প্রিয়তমা তোমার জন্য রেখে গেলাম মাতৃভাষা
তোমার ভাষা আমার ভাষা
বাংলা ভাষা
চলে গেলাম ভাষার জন্য শহীদ হলাম
শিশুটিরে পান করিও মাতৃ দুগ্ধটা।

ভাষার জন্য আসে স্বাধীনতা
এতো নজিরবিহীন
তাই আজ একুশে ডাক দিলো
আমার মায়ের ভাষা থাক অমলিন।
এপার বাংলা ওপার বাংলা
এক ভাষা এক প্রাণ
কাঁটা তারের খোঁচায় ছিন্ন
মায়ের আঁচল, এ পারে মা, ওপার থেকে ভাই দিলো টান।

হাত বাঁধা যায় পা বাঁধা যায়
মন তো বাঁধা যায় না
দুই বাংলা মায়ের বাংলা
মুখের ভাষাও আলাদা করা যায় না।
কথা দিলাম ফিরবো আবার
এপার নয় তো ওপারে
পদ্মা নয়তো ভাগীরথী
থাকবে সদা শিয়রে।

১৯) শম্ভু সরকার

চাকদহ, নদীয়া

রফিকের শেষ গান

ওরা এলো কেড়ে নিতে আমার মুখের বুলি
বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছি চলুক যতই গুলি।
রক্ত দিয়ে লিখে দেবো বাংলা মায়ের নাম
এই জনমে আর কিছু নেই আমার মনস্কাম।
শত্রু যত হানবে আঘাত শক্ত হবে ভীত
গলা ছেড়ে গাইব সবাই বাংলা ভাষার গীত।
আর কত বার যুদ্ধ হবে মুক্তি পেতে বল
দেখ চেয়ে ওই তৈরি আছে তরুণ সেনা দল।
আমি না হয় ফিরবো না আর দুঃখী মায়ের কোলে
তাই বলে কি বীর সেনা দল মাতৃভাষা ভোলে?
তোদের হাতে অস্ত্র আছে তোরা সর্বনাশা
আমার অস্ত্র ভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসা।
এই যে আমার দু’পাশে আজ আমারই সব ভাই
প্রাণ যাবে যাক আমরা তবু বাংলা ভাষা চাই।

২০) কিঞ্জল ব্যানার্জী

আসানসোল, পশ্চিম বর্ধমান

আমার গ্রাম বাংলা

২১) সন্দীপন সরকার

পাল্লারোড, মেমারি, পূর্ব বর্ধমান

বাংলা ভাষা কি বিকৃতি ও বিলুপ্তির পথে ?

প্রথমেই জানতে হবে ভাষার সংজ্ঞা কি ? আমার কাছে ভাষা হল মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম। শুরুর দিন থেকে আজ অবধি বহু ভাষার সৃষ্টি হয়েছে আবার বহু ভাষা কালের অতলে হারিয়েও গেছে। বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম ও আমাদের দেশের দ্বিতীয় সর্বাধিক প্রচালিত ভাষা বাংলা। এই ভাষাতেই লেখা দু ২টি দেশের জাতীয় সংগীত। সারা বিশ্বের প্রায় ২৬ কোটি মানুষ এই ভাষায় কথা বলে। ১৩০০ বছর পেরিয়ে এই ভাষা নাকি আজ সংকটের মুখে। অবলুপ্তির পথে ! অবাস্তব শোনালেও এটাই নাকি বাস্তব বলছেন অনেকেই, তাই কি ? নাকি বিকৃতির বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে টিকে থাকবে বাংলা ! সে বাংলা কি আদৌ সেই বাংলা, যে বাংলায় লিখতেন রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুল। অথবা যে বাংলায় লিখে কবি শঙ্খ ঘোষের বই দেশের বেস্টসেলার বইয়ের তকমা পেয়েছে।


আমরা জানি পরিবর্তন ভাষার ধর্ম। আর শুধু ভাষা কেন মানুষের মন থেকে রাজনীতির ময়দান সবারই ধর্ম পরিবর্তন দেখা গেছে, সেই অনেককাল আগে থেকেই সব ভাষাতেই কিছু নতুন শব্দ আসে, প্রয়োগ আসে, বাগধারা আসে, সেই সবের মধ্যে থেকে কিছু জিনিস অর্জন এবং কিছু পুরোনো জিনিস বর্জন সে সব নিয়েই সজীব ও সচল ১টা ভাষা এগিয়ে যায়। হয়ত কিছুটা পরিবর্তন হয়ে এগিয়ে যায়। যে ভাবে ১৩০০ বছর পুরোনো এই ভাষা ইন্দো আর্য ভাষা থেকে আজকের বাংলা ভাষায় এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই পরিবর্তনের সাথে সাথে যদি ভাষার বিকৃতি ঘটে তাহলে সেই ভাষা কি আর বাঁচে ? ইদানিং কালে দেখা যাচ্ছে ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক কারণে হোক বা অকারণে হোক বাংলা বাক্যে বা শব্দে নিশব্দে ঢুকে পড়ছে ইংরেজি বা হিন্দি। বাংলা অচিরেই হয়ে যাচ্ছে বকচ্ছপ জগাখিচুরী “বাংরেজি” বা “বাংন্দী” ভাষায় !
একটা সময় ছিল যখন বাংলা সাধু ভাষায় যারা কথা বলত তাদের উচ্চমার্গের ভাবা হত। এখন যারা ঝড়ঝড়ে হিন্দি বা ইংরেজী তে বলে তাদের তা ভাবা হয়। যত দামী জামাকাপড় তার সাথে তত মানানসই ইংরেজী। যত ভুল বা কম বাংলা বলবে ততই যেন তুমি মর্ডান, এটাই এখন স্ট্যান্ডার্ড। তা হঠাৎ এমন কেন হল ! এর কারণ এক কথায় “বাজার”।


এই বাজার কি ? এটা কি কোনো এক অখন্ড মন্ডলাকার মুন্ডহীন বস্তু; না তা নয়, বাজার হল আমার আপনার মতন “গণ” কে নিয়ে নিয়ে তৈরি এক জগৎ যারা মনে করছি বাংলা হল এঁদো, গাঁইয়া নিচু মার্গের একটা ভাষা, সেটা যত বেঁকিয়ে , চুরিয়ে, কাত করে, শুইয়ে বলবে ততই তুমি উচ্চ মার্গের। আর যত তুমি কম, খারাপ, সীমিত ইংরেজী বলবে, হিন্দি বলবে ততই তুমি নিম্নমার্গের। এমন টা কি হঠাৎ হয়ে গেল ? না একদিন বা মাসে বা বছরে তা হয় না। আপনি হয়ত নিজেও বাংলা মিডিয়ামে পড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। আপনার চোদ্দগুষ্টি হয়ত বাংলা মিডিয়ামে পড়েছে। আপনি আবার “বাংলা বাঁচাও” নামে ফেসবুকে পেজ ও চালান। হোটেল রেঁস্তোরা থেকে এয়ারপোর্ট সর্বত্র বাংলা বলেল, অপর প্রান্তের মানুষ অন্য ভাষা বললেও নিজে বাংলাই বলেন কিন্তু নিজের ফোনের ভাষাটা ইংরেজী রাখেন, নিজের বাচ্চাকে ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করান, রেঁঁস্তোরায় গিয়ে বাংলায় কথা বললেও মেনুকার্ডে যদি বাংলা না থাকে তা বিনা বাক্যালাপে মেনেও নেন আবার সংস্কৃত বা বাংলা অনার্সের চেয়ে ইংরেজী অনার্সের মেয়েটিকে বেশী যোগ্য ভেবে বেছে নেন নিজের জীবন সঙ্গী হিসাবে। এ কেমন অবিচার !
অপর দিকে গোটা একটা দেশের প্রায় ১৬ কোটি মানুষ এই বাংলা ভাষা কে নিয়ে বাঁচে। চিন্তা কি আর; বাংলা এত সহজে মরবে না, এত লোক বাংলা বলে, পড়ে, লেখে, বাংলা ভাষা তাহলে গায়েব হবে কি ভাবে ?! ওই যে আগেই বললাম “বাজার”। বাংলাদেশের বাজার শেখায় না ভাবায় না যে বাংলা বলা মানে তুমি উচ্চমার্গের না , বাংলায় স্বাক্ষর করা মানে তুমি স্বল্পশিক্ষিত না ! যা আমাদের লজ্জা দেয় তা ওদের গর্ব দেয় !


বাংলাদেশ ও অনত্র প্রচলিত বাংলা ভাষায় কিছু উচ্চারণ গত ও কিছু শব্দগত পার্থক্য রয়েছে, সময়ের ভারে বাংলাদেশের ভাষার যা না তারতম্য ঘটেছে তার থেকে বেশী বদল এসেছে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষায়। অনেক শব্দ হারিয়ে গেছে আবার অনেক নতুন শব্দ যোগ হয়েছে। লেখক চন্দ্রিল বলেছেন আমরা এখন ভাবছি হিন্দি আর ইংরেজিতে আর সেটা থেকে টুক করে বাংলায় রুপান্তরিত করে তৈরি করছি নতুন শব্দ। তাই এখন “কারণ” হয়েছে “কেন কি”, “খাবার বেরে দিয়েছি” হয়েছে “খাবার লাগিয়ে দিয়েছি”; তাহলে এই যে বাংলা ভাষার রুপান্তর ঘটছে সেটাকি বিকৃতি না পরিবর্তন ?! আমার মতে সেটা যাই হোক তা এই ভাষার পক্ষে মঙ্গল জনক না; ইন্দো আর্য ভাষা এইরকম বিকৃতি বা পরিবর্তন পেরিয়েই আজকের বাংলা ভাষায় রুপান্তরিত হয়েছে। ভবিষ্যতে জানিনা আমরা এই বাংলা ভাষা কিসে রুপান্তরিত হবে !!
আগেই বলেছি ভাষা মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম, “বর্ধমান” উচ্চারণ করতে না পারার জন্য ইংরেজরা নাম রেখেছিল “বার্ডওয়ান”।
ভাষার বদল ঘটলেও প্রকৃত নাম এখন বেশী জনপ্রিয় কেন? কারণ বাজার বর্ধমান নাম কে বেশী আপন করে বার্ডওয়ান কে নয় ! সেইরকমই প্রাশ্চাত্যের ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলা ভাষা কে গোটা একটা জাতি যে ভাবে ভুলতে বসেছে তা ভাষার আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছুই না। ভুলতে বসলে এত কোটি কোটি লোক কিভাবে বাংলা পড়ছে, লিখছে, বাংলায় গাইছে, বলেছে কি ভাবে ? আসলে এই কোটির ভিতর উচ্চকোটি কি করছে সেটাই ভাবার, কোটির ভিতর এই উচ্চকোটির দাম সব থেকে বেশী, যারা বৈভব শিক্ষা সব দিক থেকে উচ্চ ।
ঠিক যেমন দেশে বুদ্ধিমানের চেয়ে বোকার সংখ্যা বেশি। ঠিক যেমন চাকুরী জীবির চেয়ে বেকারের সংখ্যা বেশী ঠিক তেমনই এই উচ্চকোটির চেয়ে নিম্ন কোটির সংখ্যা বেশী কিন্তু দেশে বুদ্ধিমান, চাকুরীজীবি আর এই উচ্চকোটি এদের মান সব থেকে বেশী। তাই এরা কি
ভাষায় বলছে কি ভাষায় গাইছে কি ভাষায় লিখছে তা সব সময় সকলে অনুসরণ করতে চায়। তারই ফল বাংলা ভাষার আজকের অবস্থা! রাস্তায় হাতে এখনও আমাদের নীলদর্পণ নিয়ে হাঁটতে ব্যকডেটেড লাগে কিন্তু “ম্যাকবেথ” বগলে নিয়ে হাঁটতে বেশ সাহেব সাহেব লাগে বইকি! এই ভাবনাই বদলে দিচ্ছে ভাষাকে। কারণে অকারণে দরকারে অদরকারে বাক্যে ঢুকে পড়ছে ইংরেজী কিংবা হিন্দী থেকে টুক করে তুলে আনা বাংলা অনুবাদ; নব্য এই শব্দ যা হটিয়ে দিচ্ছে আদি বাংলার শব্দ কে; পরিবর্তন হচ্ছে ভাষা বিকৃতির মধ্য দিয়ে। ইউনেসকো বাংলা কে তকমা দিচ্ছে “সুইটেস্ট ল্যাঙ্গুয়েজ ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড” হিসাবে কিন্তু “পৃথিবীর সবথেকে মধুর বা মিষ্টি ভাষা” হিসাবে নয়; সেখানেও ইংরেজীর সমাহার।
সারা বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো ভাষা তামিল। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তার কিন্তু সেইভাবে বিকৃতি বা পরিবর্তন অনেক কম; কেন, তার কারণ কি ?


তারও কারণ বাজার। তাদের বাজার শেখায় না নিজের ভাষার মধ্য অপ্রয়োজনীয় ভাবে অন্য ভাষার প্রবেশ ঘটানো। তাদের কাছে তাদের ভাষা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষা; ঠিক যেমনটা বাংলাদেশের মানুষের কাছে তাদের বাংলা ভাষা; তাদের গর্ব তাদের ঐতিহ্য, তাদের অহংকার।
পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যতদিন না এই আত্মবিস্মরণের পথ থেকে সরবে ততই বিকৃত হবে এই পারের বাংলা ভাষা। যা শত চেষ্টা করেও, কাগজে বই এ , রাস্তায় নেমে আন্দোলন করে বা যে ভাবেই হোক কারুর ক্ষমতা নেই রুখে দেয়।
বাঁচুক বাংলা, থাকুক বাংলা, বলুন বাংলায়, গর্ব করুন বাংলায়, লিখুন বাংলায়, তবেই না বাঁচবে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা, জন্মের পর প্রথম বলা বাংলা, মনের ভাষা বাংলা।

(

Related posts

দৈনিক কবিতাঃ ৫ – এ পঞ্চবাণ

E Zero Point

শিয়ালদহে অনুষ্ঠিত হলো পঞ্চবান মহাসম্মেলন

E Zero Point

ছোটগল্পঃ একাকী

E Zero Point

মতামত দিন