02/05/2024 : 7:23 PM
আমার দেশ

আপনি কি জানেন মাস্টারদা সূর্য সেনের শেষ বার্তা কি ছিল?

জিরো পয়েন্ট বিশেষ প্রতিবেদন, ২২ মার্চ ২০২৩:


আজ ২২ মার্চ। মাস্টারদা সূর্য সেনের জন্মদিন। মাস্টারদা সূর্য সেন ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ চট্টগ্রামের নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। কলেজে পড়বার সময়ে কলকাতার বিপ্লবী কর্মীদের সংস্পর্শে এসে বিপ্লবী ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হন। চট্টগ্রামে বিপ্লবী দলের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনে তিনি অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। বি এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার কিছুকাল পর তিনি ন্যাশনাল হাইস্কুলে সিনিয়র গ্রাজুয়েট শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯২০ সালে কংগ্রেস কর্মী হিসেবে অসহযোগ আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯২১ সালে অসহযোগের আহবানে সমর্থন জানিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় পদত্যাগ করে তরুণদের দেশাত্মবোধ শিক্ষা দেবার জন্য ‘সাম্য আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করেন।

অসহযোগ আন্দোলন শেষে তিনি ১৯২৩ সালে চট্টগ্রামের দেওয়ান বাজারে অবস্থিত উমাতারা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে শিক্ষকের পদ গ্রহণ করেন। এ সময় থেকে তিনি তাঁর অনুসারীদের নিকট মাস্টারদা নামেই অধিক পরিচিত হয়ে উঠেন। ১৯২৪ থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত সময়ে তিনি গোপনে কয়েকবার কলকাতা গিয়ে যুগান্তর দলের কর্মীদের সাথে যোগাযোগ করেন। চট্টগ্রামে কিভাবে চরমপন্থী কার্যকলাপ আরও শক্তিশালী করা যায় এটাই তাঁর লক্ষ্য হয়ে উঠে। তাঁর কার্যকলাপ তখন পুলিশের নিকট প্রকাশ হয়ে পড়ে।

১৯২৬ সালে ১নং বেঙ্গল অর্ডিনেন্স অনুসারে কলকাতায় তিনি গ্রেফতার হন এবং তাঁকে জেলে আটক রাখা হয়। কিছুদিন পরে তাঁকে রত্নগিরি জেলে স্থানান্তর করা হয়। ১৯২৮ সালে অসুস্থ স্ত্রীকে দেখবার জন্য তাঁকে চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয় কিন্তু কিছুদিন পরেই তাঁর স্ত্রী বিয়োগ ঘটে। ১৯২৮ সালের শেষের দিকে তিনি জেলা থেকে মুক্তি পান। মুক্তিলাভের পরেই তিনি কলকাতা ও চন্দনগরের বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে চট্টগ্রামে বিপ্লবী সংগঠনে আত্মনিয়োগ করেন। ঐ বছরের ডিসেম্বর মাসে কলকাতা কংগ্রেস অধিবেশনে চট্টগ্রাম থেকে যোগদানকারী প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব করেন।

১৯২৯ সালে চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ বছরের মে মাসে চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেস সম্মেলনের তিনি প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। মাস্টারদা এবং তাঁর অনুসারীরা চট্টগ্রামে একটা সশস্ত্র অভ্যুত্থানের বিষয় নিয়ে সুভাষ বসুর সাথে একান্তে আলোচনা করেন। ১৯৩০ সালে কংগ্রেসের আহবানে আইন অমান্য আন্দোলন মাস্টারদার দলের পক্ষে সুযোগ সৃষ্টি করে। অনন্ত সিং, গনেশ ঘোষ প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা তরুণদের অস্ত্র চালনা শিক্ষা এবং অস্ত্র সংগ্রহের জন্য তৎপর হয়ে উঠেন। এপ্রিল মাসে গোপনে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি গঠিত হয় এবং বিপ্লবীরা সশস্ত্র বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে।

পরিকল্পনা মতে ১৮ এপ্রিল বিদ্রোহের ঘোষণা পত্র জারি করা হয়। এই তারিখের রাত্রেই তাঁরই নেতৃত্বে ও নির্দেশে প্রায় একই সঙ্গে বিপ্লবীরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে ধূম স্টেশনে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা, টেলিফোন ভবন আক্রমণ, পুলিশ অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, অক্সিলিয়ারী অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ প্রভৃতি সংঘটিত করে। এ সকল আক্রমণ পরিচালনার পর বিপ্লবীরা উত্তর দিকে অবস্থিত জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। ২২ এপ্রিল সরকারি সৈন্য জালালাবাদ পাহাড় আক্রমণ করলে বিপ্লবীদের সাথে ইংরেজদের সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। জালালাবাদ সংঘর্ষের পর মাস্টারদার নির্দেশে বিপ্লবীরা নূতন রণ কৌশল গ্রহণ করেন।

নূতন রণ কৌশলের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হলো গ্রামাঞ্চলে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে দেওয়া, অধিক সংখ্যায় তরুণদের ভর্তি করা এবং ইউরোপীয় ও পুলিশদের উপর অতর্কিত আক্রমণ পরিচালনা করা। ১৯৩২ সালে পটিয়ার ধলঘাট গ্রামে পুলিশের সাথে সূর্যসেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীদের সংঘর্ষ হয়। ক্যাপ্টেন ক্যামেরন এর নেতৃত্বে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর একটি দল ১৯৩২ সালে ১৩ জুন বিপ্লবীদের আশ্রয়স্থল ঘিরে ফেলে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে ক্যামেরন মারা যান এবং সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও কল্পনা দত্ত নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।

শেষ পর্যন্ত এক গ্রামবাসী চট্টগ্রামের গৈরলা গ্রামে সূর্য সেনের লুকিয়ে থাকার তথ্য পুলিশকে জানিয়ে দেন। ১৯৩৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে একদল গোর্খা সৈন্য গোপন স্থানটি ঘিরে ফেলে। সূর্যসেন পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। ১৯৩৩ সালের আগস্ট মাসে সূর্য সেনের ফাঁসির রায় হয়। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কারাগারে ফাঁসি কার্যকর হয়।

১৯৩৪ সনের ১১ জানুয়ারি তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু দেয় বৃটিশসাম্রাজ্য। মৃত্যুর ১দিন আগে ১১ জানুয়ারি মাস্টারদা তাঁর বিপ্লবী সাথীদের কাছে বিদায় বাণী লিখেছিলেন।

ইংরেজিতে লেখা মাস্টারদার শেষ বাণী বঙ্গানুবাদ:

আমার শেষ বাণী– আদর্শ ও একতা। ফাঁসির রজ্জু আমার মাথার উপর ঝুলছে। মৃত্যু আমার দরজায় করাঘাত করছে। মন আমার অসীমের পানে ছুটে চলছে। এই তো সাধনার সময়। বন্ধুরুপে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার এইতো সময়। চলে যাওয়া দিনগুলোকে স্মরণ করার এই তো সময়। কত মধুর তোমাদের সকলের স্মৃতি। প্রিয় আমার ভাই-বোনেরা আমার এই জীবনের একঘেয়েমিকে ভেঙে দাও তোমরা। উৎসাহ দাও আমাকে। এই আনন্দময়, পবিত্র, ও গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত আমি তোমাদের জন্য কি রেখে গেলাম? মাত্র একটি জিনিস, তা হলো আমার স্বপ্ন – একটি সোনালী স্বপ্ন। স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন। 

কী শুভ মুহূর্ত ছিল সেই টি যখন আমি এই স্বপ্ন দেখেছিলাম। বিগত জীবনে আগ্রহ ভরে ও অক্লান্তভাবে পাগলের মতো সেই স্বপ্নের পেছনে ছুটেছি। জানিনা কতটা সফল হতে পেরেছি। জানিনা কোথায় সেই অনুসরণ, আজ থামিয়ে দিতে হবে আমাকে। লক্ষে পোঁছানোর আগে মৃত্যুর হিমশীতল তোমাদের স্পশ করলে তোমরা অনুগামীদের হাতে এই অন্বেষণ এর ভার তুলে দেবে-যেমন আমি তোমাদের হাতে তুলে দিচ্ছি। প্রিয় বন্ধুরা-এগিয়ে চল-কখনো পিছিয়ে যেও না।ওই দেখা যাচ্ছে স্বাধীণতার নবারুণ। উঠে-পড়ে লাগো। কখনো হতাশ হয়ো না। সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।

১৯৩০ সনের ১৮ এপ্রিলের চট্টগ্রাম ইস্টার বিদ্রোহের কথা কোনদিন ভুলো না। জালালাবাদ, জুলদা, চন্দননগর, ও ধলঘাট সংগ্রামের কথা সবসময় স্পষ্ট মনে রেখো। ভারতের স্বাধীনতার বেদীমূলে যেসব দেশপ্রেমিক তাঁদের জীবন দান করেছেন, তাদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো। আমাদের সংগঠনে যেন বিভেদ না আসে — এই আমার একান্ত আবেদন তোমাদের কাছে। যারা কারাগারের ভেতরে ও বাইরে রয়েছো তাদের সবাইকে জানাই আমার আশীর্বাদ। বিদায় নিলাম তোমাদের কাছ থেকে। 

বিপ্লব দীঘজীবি হোক। বন্দেমাতরম।

Related posts

চতুর্দশ ভারত-সিঙ্গাপুর প্রতিরক্ষা নীতি সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে ভিডিও কনফারেন্সে আলোচনা

E Zero Point

শ্রীনগরের লাল চকের ক্লক টাওয়ার জাতীয় পতকার রঙে আলোকিত

E Zero Point

যাত্রীবাহী এবং শহরতলীর ট্রেন পরিষেবা পরবর্তী বিজ্ঞপ্তি জারি না হওয়া পর্যন্ত বাতিল থাকছেঃ রেলমন্ত্রক

E Zero Point

মতামত দিন