জিরো পয়েন্ট বিশেষ প্রতিবেদন, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ :
তৈমুর খান
ফাতিহা-ই-দোয়াজদাহম ও ঈদ-এ-মিলাদুন্নবীর অর্থ :
হজরত মুহাম্মদ (সা:) কত তারিখ জন্মগ্রহণ করেছিলেন তা নিয়ে ইসলামী পণ্ডিতদের মধ্যে নানা মতভেদ আছে। তবে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মত হল আরবি তৃতীয় মাসের ১২ তারিখ। এইটিকেই বলা হয় ‘ফাতিহা-ই-দোয়াজদাহম’। ‘দোয়াজদাহম’ ফারসি শব্দ, যার অর্থ বারো।অর্থাৎ বছরের সেই দিনটি যেদিন আরবের বুকে জন্ম নেন শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা:)। আরবি ক্যালেন্ডারের তৃতীয় মাস রবিউল আউয়ালের ১২ তারিখ দিনটিকেই মুসলিমবিশ্ব ফাতেহা দোয়াজ দাহম উপলক্ষে মান্যতা দেয়।তারিখ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সেই দিনটি যে সোমবার ছিল সেক্ষেত্রে কারো কোনো দ্বিমত নেই। এই দিনটিকেই বলা হয় ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী। এটি একটি আরবি শব্দ যার অর্থ হল নবীর জন্মদিনের আনন্দ উদযাপন। ‘ঈদ’ শব্দ আনন্দ, ‘মিলাদ’ শব্দ জন্ম এবং একসঙ্গে ‘মিলাদুন্নবী’র অর্থ নবীর জন্মদিন। শেষ নবীর জন্মদিন হিসেবে মুসলমানদের কাছে পালিত একটি উৎসব। তবে তা উৎসব হিসেবে পালনীয় কিনা এ নিয়েও ইসলামি পণ্ডিতদের মাঝে অনেক বিতর্ক রয়েছে। কেউ কেউ পবিত্র দিন হিসেবে হামদ, তসবিহ, রোজা, র্যালি, নাত, পারিবারিক ও সামাজিক সম্মেলন, সড়ক ও ভবনে সাজ-সজ্জার মধ্য দিয়ে পালন করেন। কেউ কেউ এসবকে বাহুল্য মনে করেন এবং প্রতিদিনই নবীর পথ অনুসরণ করাকেই মিলাদুন্নবী মনে করেন। তা আড়ম্বর বা জৌলুসের মধ্য দিয়ে প্রদর্শন করেন না।
বাংলাদেশের মুসলমানেরা এই দিনটিকে ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী বলে অভিহিত করেছেন। অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের কাছে এই দিনটিই নবী দিবস নামে পরিচিত।
কে প্রথম পালন করেছিলেন ?
ইতিহাস থেকে জানা যায় ইরাকের মসুল শহরে বাদশা আবু সাঈদ ৬০৪ হিজরিতে আবুল খাত্তাব ওমরের মাধ্যমে ১২ই রবিউল আউয়ালএই দিনটি পালন করেন। তারপর থেকেই বিভিন্ন মুসলিম দেশে বিভিন্ন শোভাযাত্রা অন্যান্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তা পালিত হয়ে আসছে।
কারা ফাতিহা দোয়াজ দাহামের অনুসারী?
তুমি কি মুসলমান?এক স্রষ্টাকে বিশ্বাস করে অথবা ভয় করে তুমি কি জীবনযাপন করো?তুমি কি সমূহ অহংকার ত্যাগ করতে পেরেছ? তোমার প্রতিবেশীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে অভ্যস্ত? গরিব-দুঃখী মানুষকে সাহায্য করো? তোমার ধর্মের বা ভিন্ন ধর্মের মানুষের প্রতি তোমার বিদ্বেষ নেই তো? সব মানুষই সমান, সব মানুষই একজন স্রষ্টার দ্বারা সৃষ্ট, কারো মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই—এসব কথা তুমি মানতে পারো তো? তোমার উপার্জিত সম্পদের বাড়তি অংশ(যাকাত) তুমি এতিম-মিসকিনদের দান করো তো? তোমার পিতা-মাতা আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে বিরোধ নেই তো? সকলকে সাধ্যমতো সাহায্য ও সকলের সঙ্গে সু-ব্যবহার করো তো? কাউকেই তার ধর্মপালনে বাধা দাও না তো? ক্রোধ জয় করার ক্ষমতা রাখো তো? যথাসাধ্য তোমার সহিষ্ণু ও ক্ষমা করার সামর্থ্য আছে তো? এসব থাকলেই তুমি বিশ্ব নবীর আদর্শের মানুষ। ফাতিহা দোয়াজ দাহমে তুমিও শামিল হতে পেরেছ। তোমার নিজের দিকে তাকাও—কতটা পরিশুদ্ধ অন্তর তা দ্যাখো। কাউকে কখনো আঘাত করোনি তো? কারো হক মেরে সম্পদ আত্মসাৎ করোনি তো? অবৈধ নারী-পুরুষ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়োনি তো? সমস্ত রকম অশ্লীলতা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছ তো? যথাসম্ভব শালীনতা বজায় রেখে মুখের ভাষাকে সংযত করে, ইন্দ্রিয় লালসায় বশীভূত না হয়ে সততার সঙ্গে যদি জীবনযাপন করতে পারো, সুদ ও মদ খাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারো, যদি ভুলবশত পাপ কাজ করে ফেললেও তৎক্ষণাৎ অনুশোচনাসহ সেই পথ পরিত্যাগ করে স্রষ্টার কাছে ক্ষমা চাইতে পারো—তবে নিশ্চিত তুমি বিশ্ব নবীর অনুসারী। নিশ্চিত তুমি ফাতিহা দোয়াজ দাহমের পবিত্রতা ও তাৎপর্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল।
সুতরাং যা করতে হয়:
বিশ্ব নবীকে স্মরণ করে এই দিনটিকে আলাদাভাবে কি মর্যাদা দেওয়ার প্রয়োজন আছে?এ প্রশ্ন আজকের দিনে নানা মহল থেকেই উত্থাপিত হচ্ছে। যেহেতু নবী নিজেই চাইতেন না—তাঁর জন্মদিন আড়ম্বরপূর্ণভাবে পালিত হোক। বাড়াবাড়ি যাতে না হয় সে ব্যাপারে তিনি সতর্কও করে গেছেন। তিনি সোমবারে জন্মেছিলেন বলে প্রতি সোমবার নিজেই রোজা রাখতেন। অর্থাৎ তিনি সাপ্তাহিক জন্মদিনকে মর্যাদা দিতেন তা মুসলিম শরীফের১১৬২ নং হাদিসে উল্লেখ আছে। নিজের জন্মদিনটি উল্লেখ করে তিনি বলতেন, সোমবার কুরআন নাযিল করা হয়েছে, সোমবার নবুয়াত প্রাপ্তিও। কিন্তু মুসলমান সমাজে এর বাইরেও দিনটিকে মর্যাদাপূর্ণ করা হয়েছে যাকে ‘বেদাতে হাসানা’(নবী যা না করলেও তাঁর অনুসারীরা করেন) বলে আলেমগণ উল্লেখ করেন। আমরাও জানি, নবীর ভাবনা ও আদর্শ সম্পর্কে বহু মানুষই জানেন না।সাম্য ও সততা সম্পর্কেও তারা সচেতন নন। ধর্ম বলতে নামাজ ও রোজা পালনকেই বোঝেন। ধার্মিক বলতে দাড়ি ও টুপিই তার পরিচয় বলে জানেন। কিন্তু সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে যে দায়বদ্ধতা আছে, যে বৃহত্তর মানবিক জাগরণের প্রয়োজন আছে, যে ত্যাগ ও কৃচ্ছ্র সাধনার মধ্যদিয়ে নিজেকে সততার প্রতিমূর্তি করে তোলা দরকার, যে ধৈর্য ও ক্ষমার মতো গুণ অর্জন করা জরুরি এবং সর্বোপরি মানুষকে ভালবাসার শিক্ষা লাভ করা—এসবের জন্যই নবী দিবসকে গুরুত্ব দেওয়া। এই বিশেষ দিনটিতে নবীকে বেশি বেশি স্মরণ করার মধ্য দিয়েই তাঁর ভাবনা ও আদর্শে সকলে অনুপ্রাণিত করা।আত্মশুদ্ধি ও আত্মজাগরণের পথে অগ্রসর হবার উৎসাহ দেওয়া। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জ্ঞানীগুণী আলেম-উলেমাদের বক্তৃতায় নবীর জীবন ও বাণী তাদের জীবনেও প্রতিফলিত করা। আদর্শ শাসক হিসেবে, আদর্শ পিতা হিসেবে, আদর্শ স্বামী হিসেবে,আদর্শ নেতৃত্বদানকারী হিসেবে তিনি যে সবারই অনুকরণীয় তা বলাই বাহুল্য। সর্বোপরি মানুষ হিসেবে কতটা বিচক্ষণ, কতটা দয়াবান, কতটা যুক্তিবাদী ও দার্শনিক তা জানানো। বিশ্বভুবনে চিরন্তন মানবের প্রজ্ঞাময় দ্যুতিতে তিনি চির অম্লান, শান্তির বার্তাবাহক হিসেবেও চির উন্নত। তাই তাঁর আলোচনা মানুষের জীবনকেও পাল্টে দিতে পারে। এসব কারণেই প্রয়োজন হয় মিলাদুন্নবী তথা নবী দিবসের। এই দিনের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে প্রসিদ্ধ তাবেঈ হজরত হাসান বসরী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেছেন, “যদি আমার উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ থাকত তাহলে আমি তা রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মদিন উপলক্ষে মাহফিলে খরচ করতাম।”( আন নেয়মাতুল কুবরা আলাল আলাম)।এতে এ কথাই প্রমাণ করে এর গুরুত্ব কতখানি।
তাহলে আমরা কি পথভ্রষ্ট:
বিশ্ব নবীর আদর্শে আমরা অনুপ্রাণিত হয়েও আজ অনেকটাই আদর্শচ্যুত। কোথাও কোথাও নবীর জন্মদিনকে পুরোপুরি আড়ম্বর পূর্ণ করে পালন করতে উদ্যোগী হয়েছি। মাইক-বক্স বাজিয়ে দল বেঁধে কোথাও রাস্তা দখল করে যানজট সৃষ্টি করে নানা স্লোগান দিতে দিতে আমরা শহর নগর অতিক্রম করছি। কোথাও জোর করে চাঁদা আদায় করে জম্পেশ খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করছি। এসব কি কাম্য? না, তা একেবারেই নয়। কারো ক্ষতি হোক, বা কাজে বাধার সৃষ্টি হোক—এটা ঘোরতর অন্যায়।এভাবেই নবী দিবসটিকে ভ্রান্তপথে পরিচালিত করতে উদ্যোগী হয়েছে কিছু স্বার্থপর মানুষ। কিছুটা রাজনীতিকরণেরও ছায়াপাত ঘটেছে।কারণ এই শোভাযাত্রায় ভিন্ন সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক ব্যক্তিদেরও দেখা যাচ্ছে। সারা বছর ধরে ধর্মীয় ব্যাপারে তারা উদাসীন। নবীর জীবনদর্শন অনুসরণ করার প্রয়োজন বোধ করেন না। সমাজের সুদখোর ঘুষখোর, অন্যের সম্পদ হরণকারী, পরকীয়াসক্ত হয়েও নবী দিবসের জাঁকজমকে শামিল হন। এর মধ্য দিয়ে মুসলিম সমাজের শক্তি ও অহংকার প্রদর্শন করতে চান। এসব বরদাস্ত করা যায় না। এদের থেকে সতর্ক থাকতে হবে পুরো মুসলিম সমাজকে। মনে রাখতে হবে—ধর্ম আড়ম্বরে নয়,আস্ফালনে নয়,স্লোগানে নয়—নিজেকে সংশোধনে, সহানুভূতিতে, ভালবাসায়, পরোপকারে এবং প্রকৃত সত্য ও জ্ঞানের অনুশীলনে।