ডিরেক্টর পদ থেকে সরে আসার পর মনোতোষ বাবু ফিরে এসেছেন তাঁর নিজের জায়গায়, যেখানে তাঁর বাবা-মার শেষ দিনগুলো কেটেছে নিদারুণ দুঃখে। বাকি সমস্ত বৈভব ছেড়ে এসেছেন তাঁর এতোদিনের কর্মভূমি মুম্বাই মহানগরীতে। ব্যালকনিতে বসে গরম কফিতে চুমুক দিয়ে মনোতোষ বাবু ভাবছেন – ” একেই কি বলে শিকড়ের টান ! নাকি বিবেক টেনে আনলো আমায় আমার অতীতকে স্মরণ করাতে !” নিজের সর্বস্ব দিয়ে মেধাবী মনোতোষকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়েছিলেন তার প্রাইমারি-স্কুল-শিক্ষক বাবা। চাকুরি-ক্ষেত্রে আলাপ হয় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট বাবার একমাত্র মেয়ে মেঘনার সাথে। তার রূপ, শিক্ষা ,বৈভব মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল মনোতোষের। সাথে ছিল উপরে ওঠার অনন্ত আহ্বান, অনেক অনেক উপরে। ভুলতে বসলেন বাবার বন্ধু-কন্যা রমাকে , অস্বীকার করলেন দীর্ঘ আট বছরের ভালোবাসাকে , ফিকে হতে শুরু করলো গ্রামের আকর্ষণ, বাবা-মার আর্ত-চিৎকারও আর কানে পৌঁছায় না , যেমন পৌঁছায়নি রমার নিঃশব্দ হাহাকার। মনোতোষের সামনে তখন শুধু সুখের পাহাড় । মনো ছুটছে সেই পাহাড়ের সবটুকু সুখ নিজের ঝুলিতে ভরবে বলে । বৃদ্ধ বাবা-মাকে গ্রাম থেকে এনে এই ফ্ল্যাটে রেখেছিলেন , বিক্রি করে দিয়েছিলেন যাবতীয় পৈতৃক সম্পত্তি এমনকি চারকাঠার বসতবাড়ি-টাও , সব পুঁজি নিয়োগ করেছিলেন ব্যবসার কাজে। বৃদ্ধ বয়সে সব হারিয়ে ছেলে-অন্ত প্রাণ প্রভাদেবী চোখ বুজেছিলেন অচিরেই । মায়ের মৃত্যু-সংবাদে বাড়ি ফিরেছিলেন মনো , কিন্তু ব্যস্ততার কারণে মোটা টাকার বিনিময়ে পুরোহিতকে দিয়ে নিজের সুবিধামতো সমস্ত পারলৌকিক কাজ নিয়মের বিরুদ্ধে করিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন মুম্বাইয়ে। বাবাকে অবশ্য সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন , উনি তাতে সম্মত হননি। সুখতোষ বাবু বুঝেছিলেন, পয়সা দিয়ে কেনা সুখের ভাগিদার হতে তিনি পারবেন না , তাই একাকিত্বকেই আপন করে নিয়েছিলেন। মনোতোষের তখন ভরা সংসার , ছেলে-মেয়ে নামী স্কুলে পড়ে , খেলাধুলা ,সাঁতার, নাচ-গান সবকিছুই চলছে নামী সেন্টারের তত্বাবধানে , নিজেও নামকরা ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট , দেশ-বিদেশে যাতায়াত ,আজ এই মন্দিরে দান করেন তো , কাল অনাথ আশ্রমে , আজ এই বৃদ্ধাশ্রমে খাবার খাওয়ান তো কাল মোটা অংকের টাকা এনজিও-তে দান করেন। অথচ দিনের শেষে বৃদ্ধ বাবা কি খেলেন , কেমন আছেন , আদৌও কি বেঁচে আছেন, তার থাকে না খোঁজ । সারাদিনের এতো কাজ , সমাজসেবার পর হিসেব-নিকেষের আড়ালে হারিয়ে যান জন্মদাতা , যিনি প্রতি মুহূর্তে আহ্বান জানান মৃত্যু-কে। অবশেষে এলো সেই দিন , এবারও মনোতোষ একাই এসেছিলেন , বাবার অস্থি বিসর্জন দিয়েই ফিরে গিয়েছিলেন নিজের জগতে।প্রতিপত্তির নেশায় বুদ পাষাণ হৃদয়ে এতটুকু কষ্টের রেশ-ও মেলেনি সেদিন। আজ বড়ো ক্লান্ত লাগে , মেঘনা বিদায় নিয়েছে আজ পনেরো বছর । কর্কট-রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল সারা শরীরে , চরম বিত্তবান মনোতোষ সেদিন অসহায়ভাবে দেখেছিলেন স্ত্রীর ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাওয়া। বিত্তের পিছে দৌড়তে গিয়ে মেঘনাকেও সময় দেওয়া হয়নি, ভালোবেসে সংসারটাও করা হল না যে ! মেঘনার মৃত্যু মনোতোষকে সমূলে নাড়া দিয়েছিল। “কে ধনী , কে গরীব -রোগের কাছে যে সবাই সমান!” স্ত্রী-কে হারিয়ে ক্রমশ একা হয়ে যাচ্ছিলেন মনোতোষ । মেয়ে বিয়ে করে বিদেশে সেটেল্ড , বছরে একবার দেখা ।ছেলের সাথে মানসিক দূরত্ব অনেক , যেদিন মোটা টাকার বিনিময়ে ওকে জেল থেকে ছাড়িয়ে এনেছিলেন, সেদিন থেকেই। মেনে নিতে পারেননি নিজের অন্যায়কে । ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে নিরপরাধ মেয়েটির যে সর্বনাশ তিনি করেছিলেন, তা আজও তাঁকে কুড়ে কুড়ে খায় , সেদিনও হার মেনেছিলেন স্নেহের কাছে , আজও সেই স্নেহের চাবুকে আহত হয়েই সব ছেড়ে ফিরে এসেছেন বাবার আশ্রয়ে ।
আজ প্রতি মুহূর্তে অনুভব করেন বাবা-মার অসহায়তা , একাকিত্ব, হাহাকার । ডায়েরির প্রতিটি পাতায় বাবার আকূল আহ্বান , প্রতীক্ষা , কষ্ট – সব , সব যেন আজকের মনোতোষের মানসিক অবস্থার প্রতিফলন। কোন কাজে এলো এত বৈভব ! কি সুখ দিল ঐ অর্থ ! যার পিছনে দৌড়াতে গিয়ে হারিয়ে গেল বাবা-মা , সে তো পারল না মেঘনাকে মৃত্যু-মুখ থেকে ফিরিয়ে আনতে ! অথচ সেই বেহিসাবি অর্থ কেড়ে নিল তার সন্তানকে স্বাভাবিক জীবন-যাপন থেকে ! সেই অর্থই আজ তাঁকেও ঠেলে দিয়েছে চরম একাকিত্বের দিকে! প্রতিজ্ঞা করেছেন মনোতোষ , এবার নাম কেনার জন্য নয় , প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে তাঁকে , তাঁর নিজের অতিরিক্ত অর্থ তিনি তুলে দেবেন প্রকৃত সাহায্য-প্রার্থীদের হাতে হাতে। নিজের এনজিও-র মাধ্যমে চেষ্টা করবেন যতটা সম্ভব সমাজে সমতা ফিরিয়ে আনতে । সত্যি , সবাই ঠিকই বলেন … ” অর্থ-ই অনর্থের মূল ” – সে থাকলেও , আবার না থাকলেও ।।