09/12/2024 : 5:56 PM
অন্যান্য

রবীন্দ্রালোকে বিজ্ঞান

দিগন্তিকা বোস


প্রতিবছর পচিশে বৈশাখ আসে আমাদের জীবনে নুতনতর প্রেরণায়।কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনকে আমরা খুব আপন করে নিয়েছি, নানা রকমের আনুষ্ঠানিকতা দিয়ে আমারা রবীন্দ্রনাথের আরো কাছে পৌছাতে চাই। এবারের পচিশে বৈশাখ এক অন্যরকম পরিস্থিতির মধ্যে পালন করছি ।
বিজ্ঞানপ্রেমী রবীন্দ্রনাথকে উন্মোচন আজ জরুরি হয়ে পড়েছে। আমি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে যেটুকু পড়েছি তা তাঁর বিশালতার কাছে খুবই নগণ্য। তবু যা পড়েছি তাতে রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান চেতনা সম্পর্কে কোন বিশেষ জ্ঞানই অর্জন করতে সক্ষম হইনি।আসলে রবীন্দ্রনাথ কে বোঝা সত্যিই খুব কঠিন কাজ। তবে এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত।
কবি রবি ঠাকুর প্রেম সৌন্দর্যে অপরূপ স্রষ্টা হলেও তিনি প্রবলভাবে বিজ্ঞানমনস্ক। এবারের পঁচিশে বৈশাখকে সামনে রেখে বিজ্ঞান মনস্ক রবীন্দ্রনাথ কে ধরার চেষ্টা।
রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বুঝেছিলেন অন্ধবিশ্বাসের মূঢ়তার প্রতি অবিশ্বাস জাগাতে বিজ্ঞানের চেতনার বিকল্প নেই।
এটা বুঝে নিতে আমাদের তাকাতে হবে তাঁর শৈশব জীবনচর্চার দিকে।
রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, ‘আমি বিজ্ঞানের সাধক নই সে কথা বলা বাহুল্য। কিন্তু বাল্যকাল থেকে বিজ্ঞানের রস আস্বাদনে আমার লোভের অন্ত ছিলো না’। তিনি মনে করতেন অধিকাংশ মানুষ বিজ্ঞানবোধের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারেন না।
এই নিদারুণ দৈন্যতাই আমাদের পিছিয়ে রেখেছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনকাল (১৮৬১-১৯৪১)
বিস্তৃত।উনিশ শতকের প্রথম ভাগে ইউরোপে শিল্প বিপ্লব ঘটে।পৃথিবীর দূরত্ব ঘুচতে শুরু করে স্টিম ইঞ্জিন ব্যাপকভাবে চালু হওয়া। সভ্যতার বিকাশ দ্রুততর হয়। তাঁর জন্মের ঠিক আগেই ডারউইনের তত্ত্ব জীববিদ্যার ক্ষেত্রে বিপুল পরিবর্তন আনে। সমসাময়িক জীবাণুতত্ত্ব ,রসায়ন বিদ্যায় নানান আবিষ্কার, বিদ্যুৎ শক্তির ব্যবহার, মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক রূপান্তর ঘটাতে শুরু করে। তাই রবীন্দ্রনাথের শৈশবেই এই সব নতুন নতুন আবিষ্কারের সাথে পরিচয় ঘটে। রবীন্দ্রনাথ সাধারণ স্কুলের পড়াশোনায় মনোযোগী ছাত্র ছিলেন না একথা আমাদের জানা। বাড়ির পাঠশালায় গৃহ শিক্ষকদের কাছে গণিত, জ্যামিতি, ইতিহাস, ভূগোল, পদার্থবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যায় পাঠ নিতে হতো ঠাকুরবাড়ির কিশোর বালকদের। তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’তে জানিয়েছেন, কঙ্কাল খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মানবদেহের খুঁটিনাটি শেখাতেন এক পণ্ডিত। লাশকাটার আদ্যোপান্তও দেখতে যেতে হতো ঠাকুরবাড়ির কিশোর বালকদের।
সে সবেই বিজ্ঞানচর্চায় আগ্রহের যোগ হয়েছিল তা আমরা জানতে পারি রবীন্দ্রনাথের কথা থেকেই। তিনি বলেছেন সপ্তাহে একদিন রবিবার ‘সীতানাথ দত্ত (ঘোষ) মহাশয় আসিয়া যন্ত্রতন্ত্রযোগে প্রকৃতি বিজ্ঞান শিক্ষা দিতেন। যে রবিবার সকালে তিনি না আসিতেন, সে রবিবার আমার কাছে রবিবার বলিয়াই মনে হইত না।’ (জীবনস্মৃতি, পৃ-৪১)। বাবার সাথে যখন ডালহৌসি পাহাড়ে বেড়াতে যেতেন সেটা সুধু পাহাড়ে বেড়ানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। প্রতিটি সন্ধ্যা হয়ে উঠতো জ্যোতির্বিদ্যার পাঠশালা। জ্যোতির্বিদ মহর্ষি দেবেন ঠাকুর পুত্রকে পাহাড়ের চূড়া থেকে সন্ধ্যাবেলায় দূরবীক্ষণ যন্ত্রযোগে নক্ষত্রমণ্ডলীর গ্রহ-নক্ষত্রদের চিনিয়ে দিতেন। এছাড়াও তিনি বাবার কাছ থেকে বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কার বিষয়েও পাঠ নিতেন । সেই শিক্ষা থেকে লিখেছিলেন তাঁর বিজ্ঞান বিষয়ক প্রথম রচনা ‘ভারতবর্ষীয় জ্যোতিষশাস্ত্র’ (১৮৭৩) বারো বছর বয়সে। এই লেখাই বালক রবি কে পরিবারে বিজ্ঞানের লেখক হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেয়। যার ফলস্বরূপ ঠাকুরবাড়ি থেকে শিশু কিশোরদের জন্য ‘বালক’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী । রবীন্দ্রনাথ এই পত্রিকায় পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা ও ভূ-বিদ্যা প্রভৃতি বিজ্ঞান বিষয়ে নিয়মিত লেখক হিসাবে মনোনিত হন।বিশ শতকের প্রথম দিকে তিনি বিজ্ঞানের এক প্রবন্ধ লিখে বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু কে চমকে দিয়েছিলেন। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের গবেষণার বিষয় নিয়ে ‘বঙ্গদর্শন’-এ রবীন্দ্রনাথ ‘জড় কি সজীব?’ এই শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন যেটি ১৯০১ ছাপা হয়। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু যা পড়ে বিস্মিত হয়ে বলছিলেন ‘তুমি যদি কবি না হইতে তো শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক হইতে পারিতে’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে আচার্য্যর অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। নতুন যন্ত্র প্রস্তুত করার ব্যাপারে আশ্চর্য দক্ষতা ছিল জগদীশচন্দ্র বসু র। বিজ্ঞানের সঠিক ব্যবহার তিনি যে কোন ব্যাপারেই করতে পারতেন। ১৯০৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজ মেয়ে রেণুকা খুব অসুস্থ। অক্সিজেন দেয়া দরকার। তখন অক্সিজেন সহজলভ্য ছিল না। জগদীশচন্দ্র ভাবলেন আবেশ-কুন্ডলির (induction coil) সাহায্যে অক্সিজেনের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ-চালনা করলে অক্সিজেন আংশিকভাবে ওজোনে (O3) পরিণত হয়। ওজোন মিশ্রিত অক্সিজেন থেকে আয়নিত অবস্থায় যে অক্সিজেন পাওয়া যায় তা শ্বাসকষ্ট দূর করার পক্ষে সহায়ক। জগদীশচন্দ্র এই কাজের জন্য একটা যন্ত্র বানিয়ে রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বৈজ্ঞানিক হতে চাননি ঠিকই বিজ্ঞানচর্চাকে গুরুত্ব দিয়েছেন । তিনি যর্থাথই মনে করতেন বিজ্ঞানের হাত ধরেই পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। ১৯১৬ সালে যখন তিনি জাপান ভ্রমণে যান তখন শিল্পোন্নত জাপান তাকে মুগ্ধ করে, অনাবিল আনন্দ দেয় এবং অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতাও তিনি সঞ্চয় করেন। ‘জাপান-যাত্রী’ প্রবন্ধে বলেন, ‘কাজের শক্তি, কাজের নৈপুণ্য এবং কাজের আনন্দকে এমন পুঞ্জীভূতভাবে একত্র দেখতে পেয়ে আমি মনে মনে বুঝতে পারলুম, এই বৃহৎ জাতির মধ্যে কতখানি ক্ষমতা আছে। এই এতবড় একটা শক্তি যখন আপনার আধুনিক কালের বাহনকে পাবে অর্থাৎ বিজ্ঞান যখন তার আয়ত্ত হবে, তখন পৃথিবীতে তাকে বাধা দিতে পারে এমন কোন শক্তি আছে? তখন তার কর্মের প্রতিভার সঙ্গে তার উপকরণের যোগসাধন হবে।’
অর্থাৎ কর্মের সঙ্গে যন্ত্রশক্তির সফল মিলনই একটি দেশকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাবে।বিজ্ঞানের ক্রম অগ্রগতি তিনি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতেন। ১৯২৬ সালে জার্মানিতে আইনস্টাইনের সাথে সাক্ষাৎ। সেখানে রবীন্দ্রনাথ আইনস্টাইনের কাছে ভারতীয় বিজ্ঞান গবেষক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কথা জানতে পারলেন। ফিরে এসে তিনি সত্যেন বোসকে খুঁজে বের করে তাঁর সঙ্গে
বিজ্ঞানচর্চায় যুক্ত হলেন। আবার দ্বিতীয় বার ১৯৩০ এ জার্মানিতে আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা করেন। তখন বিজ্ঞান চর্চার আরো গভীরে প্রবেশ করে।রবীন্দ্রনাথ তার বিজ্ঞান চেতনাকে পরিণত বয়সে এসে ১৯৩৭-এ ‘বিশ্বপরিচয়’ নামে যে প্রবন্ধ সংকলনটি প্রকাশ করেন সেটি মূলত বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ। এই গ্রন্থের পরমাণুলোক, নক্ষত্রলোক, সৌরজগৎ, গ্রহলোক, ভূলোক – সহজ বাংলায় বিজ্ঞানের অমন কঠিন বিষয়গুলোর পরিচিতি দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানচর্চাকে এগিয়ে নেয়া আজ অত্যাবশ্যক হয়ে পরেছে। পশ্চাদপদ ও ধর্মান্ধ, কুসংস্কারে আবদ্ধ গোষ্ঠী জোট বেঁধে আজ পৃথিবীর
অপশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কারণে নানা উপলক্ষে, যে কোনো আয়োজনে এক বিজ্ঞানপ্রেমী রবীন্দ্রনাথকে উন্মোচন আজ জরুরি হয়ে পড়েছে।


সহায়ক গ্রন্থাবলি

১.রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বপরিচয়

২. শ্রী সুনীল চন্দ্র সরকার, রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন ও সাধনা

৩. আমাদের জগদীশ।-প্রদীপ দে

৪. এছাড়াও ইন্টারনেটে সহায়তা নেওয়া হয়েছে।

Related posts

অনলাইন রবীন্দ্র জয়ন্তী :~ লকডাউনে কবিপ্রণাম: পঞ্চম পর্ব (রাত ১০টা )

E Zero Point

তৃণমূলের উদ্যোগে মেমারি-১ ব্লকের ১০টি পঞ্চায়েতে লকডাউনে হোম ডেলিভারী

E Zero Point

বর্ধমানে সি পি আই (এম) নেতা কে. এল দাস প্রয়াত

E Zero Point

মতামত দিন