বিশেষ প্রতিবেদনঃ রোজা হলো নৈতিক শক্তি ও চারিত্রিক দৃঢ়তার পরম শিক্ষা। রমজানে রোজা অবস্থায় দিনের বেলায় রোজাদার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সব ধরনের বৈধ পানাহার ও যৌনসম্ভোগ থেকে বিরত থাকেন। নির্জন নিরালায়, দরজা–জানালা বন্ধ ঘরে গোপন স্থানে অতি সংগোপনেও রোজাদার পানাহার তথা রোজার পরিপন্থী কোনো কাজ করেন না। নিজে নিজের কাছে জবাবদিহিতে পরিচ্ছন্ন থাকেন।মানবীয় যেসব গুণ বা বৈশিষ্ট্য মানুষের জ্ঞানকে বাধাগ্রস্ত করে, তাদের বলা হয় রিপু বা শত্রু। এরা মূলত জ্ঞানের শত্রু; এগুলো মানব প্রবৃত্তিরই অংশ। এই ষড়রিপু হলো: কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ, মাৎসর্য। এগুলো মানুষের মানবীয় সদ্গুণাবলির শত্রু। এসবের সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মানুষকে সুসভ্য ও উন্নততর করে। এগুলোর যথেচ্ছ ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মানুষকে পশুরও অধম করে দেয়। অধঃপতনের অতলে নিমজ্জিত করে ফেলে। তাকওয়ার মাস রমজান। তাকওয়া মানে আত্মরক্ষা। রমজানের উদ্দেশ্য হলো ষড়্রিপুর ওপর নিয়ন্ত্রণ লাভের নৈতিক শক্তি অর্জন করা।
মানুষ জ্ঞান দ্বারা পরিচালিত হয়। জ্ঞানের উৎস হলো তথ্য, তথ্য লাভের বা জ্ঞানপ্রাপ্তির মাধ্যম হলো পঞ্চ ইন্দ্রিয়। পঞ্চ ইন্দ্রিয় তথা পাঁচটি অনুভূতি গ্রহণযন্ত্র হলো চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিব ও ত্বক। রমজানে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সঠিক সংযমী ব্যবহার নিশ্চিত করাই হলো নৈতিকতা। সঙ্গে সঙ্গে আজীবন এগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখার সক্ষতা অর্জন করা হলো রোজার সফলতা।
রমজান কৃচ্ছ্রসাধনের মাস, রমজান ইবাদত–বন্দেগির মাস। যারা রমজান মাসেও নীতিনৈতিকতার ধার ধারে না; অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও অসামাজিক ক্রিয়াকলাপে জড়িত, তারা রমজানের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়। যাঁরা রমজান মাসকে ব্যবসার উপলক্ষ হিসেবে গ্রহণ করেন, যাঁরা রমজানের ইবাদতকে কাটছাঁট করে বেশি ব্যবসায় অধিক মুনাফাখোরিতে মনোনিবেশ করেন, যাঁরা রমজানে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সারা বছর প্রস্তুতি নিতে থাকেন, যাঁরা রমজানের ঈদের রাতে কোথায় কোথায় ঘুরবেন এবং ঈদের দিন কোথায় কোথায় অযথা সময় কাটাবেন, সেই ছক কষতে থাকেন পবিত্র রমজানেই, যাঁদের মহিমান্বিত ইবাদতের রজনী ঈদের রাত (চাঁদরাত) ও অনর্থক
দুনিয়াবি বেহুদা কাজে কেটে যায়; পবিত্র রমজান মাসেও যাঁরা এ ধরনের অনৈতিক ও অসৎ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত, তাঁদের জন্য তাকওয়ার শিক্ষা অসার, তাঁরা হতভাগ্য মহাপাতকী বলে বিবেচিত।
হালাল ও বৈধ সম্পদ উপার্জন এবং হালাল খাদ্য গ্রহণ সব ইবাদত কবুল হওয়ার শর্ত। হালাল উপার্জিত সম্পদের সঙ্গে হারাম বা অবৈধ সম্পদ যুক্ত হলে পুরো সম্পদই অপবিত্র বা হারাম হয়ে যায়। হিসাবমতো জাকাত প্রদান না করলে সম্পদ পবিত্র হয় না। এ সম্পদ তার মালিকের জন্য হালাল থাকে না। যেসব ব্যবসায়ী রমজান মাসেও ব্যবসায় লেনদেনে মিথ্যার বা ছলচাতুরীর আশ্রয় নেন; খাদ্যে ভেজাল মেশান, ওজনে বা মাপে কম দেন; এক নম্বর জিনিস বলে দু–তিন নম্বর জিনিস ধরিয়ে দেন; কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করেন; তাঁদের আয়–উপার্জনও হালাল হবে না, তাঁদের রোজা–নামাজও কবুল হবে না; তাঁরা রমজানের শিক্ষা ও দীক্ষা থেকেও বঞ্চিত থাকবেন। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ধোঁকা দেয়, সে আমার উম্মত নয়।’ (মুসলিম)।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংকটকালে মজুতদারি ও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি ও অনৈতিক মুনাফাবাজি ব্যবসার সব রীতিনীতির পরিপন্থী। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘সত্যবাদী ও সৎ ব্যবসায়ীদের হাশর হবে নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও সালেহীনগণের সঙ্গে।’ (মুসলিম)।
ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নাতের খেলাপ যেকোনো কাজ সব সময়ই নিষেধ; বরং তা রমজানের ইবাদতের মাসে আরও বেশি ক্ষতির কারণ। রমজানে রোজা অবস্থায় কোনো প্রকার ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নাতের বরখেলাপ কোনো কাজ অবশ্যই নিষিদ্ধ ও অধিক নিন্দনীয়। অনেককে দেখা যায় রমজানে দিনের বেলায় যে গুনাহের কাজটি করছেন না, রাতের বেলায় অবলীলায় তা করছেন; এটি মূর্খতা ছাড়া কিছু নয়। এটাও নৈতিকতাবিরুদ্ধ ও বিবেকবিবর্জিত কর্ম। রোজার নৈতিক শিক্ষা হলো জীবনটাকে রোজার মতো সুনিয়ন্ত্রিত করা।