25/04/2024 : 11:09 PM
ট্রেন্ডিং নিউজ

বাংলা মায়ের বীর সন্তান কানাই লাল দত্ত

সুব্রত দে

যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত। অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ ॥ পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্ ।ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে ॥

বিশ্বে যখনই অধর্ম মাথাতুলেছে তাকে ধ্বংস করতে ভগবান কৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটেছে।ঠিক তেমনই ব্রিটিশ অত্যাচার থেকে দেশবাসীকে মুক্ত করতে জন্ম নেয় বাংলার বীর সন্তান চন্দননগরের এক তরুণ বিপ্লবী কানাই লাল দত্ত।১৮৮৮ সালের ৩০ আগস্ট জন্ম।সেদিন জন্মাষ্টমী।বাবা মা আদর করে নাম রাখলেন কানাই লাল।জন্ম থেকেই অসুস্থ, দুর্বল।কিন্তু অদম্য তাঁর মনের জোর।তাঁর স্থির নির্ভীক দুই চোখ প্রমাণ করে তাঁর মানসিক দৃঢ়তা।চন্দননগরের ডুপ্লে স্কুলে( বর্তমানে কানাইলাল বিদ্যামন্দির ) পড়ার সময় থেকেই দেশের প্রতি তাঁর অনন্ত টান।একটাই চিন্তা কিভাবে দেশমাতার মুক্তি আনা যায়।মহসিন কলেজে পড়ার সময় যুগান্তর দলের সদস্য অধ্যাপক চারুচন্দ্র রায়ের সান্নিধ্যে এসে বিপ্লবী দলে যোগ দেন।অস্ত্র চালনা শিক্ষা করেন।দেশি পিস্তলে ছিলো তাঁর অব্যর্থ লক্ষ্য।চারু বাবু এক এক করে টার্গেট দেন,আর অবলীলায় তাকে ভেদ করেন কানাই। আর তেমনি ছিলো সাহস।পুলিশের সামনে দিয়ে স্বদেশী দ্রব্য,বিপ্লবী পুস্তিকা পাচার করতেন।ব্রিটিশ বিরোধী বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সদস্য কানাইলাল। পুলিশ বুঝতেই পারতো না মুখ দেখে।মানুষকে বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন তিনি। মাতৃ ভূমির মুক্তি তে নিবেদিত প্রাণ।
গোন্দল পাড়া গোষ্ঠীর সদস্য হলেন তিনি।ডাক পড়লো কলকাতায়।গুরু দায়িত্ব দেওয়া হলো।কিংসফোর্ড হত্যা।তিনি তখন টগবগ করে ফুটছেন।কিন্তু শেষ মুহূর্তে তাঁর সাংগঠনিক পারদর্শিতা দেখে তাঁকে মজোফফরপুর না পাঠিয়ে কলকাতায় রেখে দেওয়া হলো দল গঠনের কাজে।দলের শৃঙ্খলা মানতেই হবে।সিদ্ধান্ত মেনে নতুন ছেলেদের অস্ত্র শিক্ষা,বিপ্লবী আদর্শে উদ্বুদ্ধ করার কাজে লাগলেন।সেখানেই নরেন গোঁসাই এর সাথে আলাপ বন্ধুত্ব।


১৯০৮ এর ৩০ শে এপ্রিল। কিংসফোর্ডকে বোমা মারার ব্যর্থ চেষ্টা করে ১ লা মে ধরা পড়লেন ক্ষুদিরাম।সেই সূত্র ধরে কলকাতার অরবিন্দ ঘোষের বাগান বাড়ি তল্লাশি করে অরবিন্দ,বারিন্দ্র সহ বহু বিপ্লবীকে ধরলো পুলিশ। নরেন আর কানাইলাল ছিলেন তাদের মধ্যে।হাজতে চললো অকথ্য অত্যাচার। পুলিশের কাছে প্রত্যক্ষ প্রমান নেই।তাই কথা বার করতে হবে।এদের বাইরে আর কে কে জড়িত তার স্বীকারোক্তি করাতে হবে।বড়লাট স্বয়ং নির্দেশ দিয়েছেন বিপ্লবীদের পুরোপুরি বিনাশ করতে হবে।পুলিশ তাই কয়েক মাস ধরে অমানুষিক অত্যাচার যেমন করলো,নখের নিচে উত্তপ্ত আলপিন ঢুকিয়ে দেওয়া, উল্টো করে ঝুলিয়ে প্রচন্ড প্রহার,তেমনি লোভ দেখলো রাজসাক্ষী হলেই মুক্তি। দুইয়ের ফাঁদে ধরা দিল নরেন। পুলিশকে জানালো সে রাজসাক্ষী হতে প্রস্তুত।

সেটা শোনার পর বিপ্লবীরা স্তম্ভিত।বহু ধনী ব্যক্তি সাহায্য করেন আড়াল থেকে,বহু পরিবার গোপনে তাদের আশ্রয় দেয়।অস্ত্র লুকিয়ে রাখে বহু বাড়ির মেয়েরা।সব ফাঁস করে দেবে নরেন।তাই আদালতে তোলার আগেই তাকে শেষ করতে হবে।কিন্তু তাকে পাবে কোথায়?সে রয়েছে আলাদা সেলে, নিশ্চিদ্র প্রহরায়।চলল পরিকল্পনা।দায়িত্ব নিলেন কানাইলাল দত্ত,আর সত্যেন বোস।
বিরাট ঝুঁকি নিলেন মতিলাল রায় আর শ্রীশচন্দ্র ঘোষ। অত্যন্ত সাবধানে সমস্ত পুলিশি প্রহরা তল্লাশি এড়িয়ে দুটি পিস্তল পৌঁছে দিলেন সত্যেন বোস, কানাইলাল দত্তের কাছে।এরপর ফাইনাল প্ল্যানিং শুরু।কদিন ধরে হাঁপানিতে প্রচণ্ড কষ্ট পাচ্ছেন সত্যেন বোস।এতো টান শুরু হলো যে,জেল হাসপাতালে ভর্তি করতে হলো।হাসপাতালের বেডে শুয়ে ধুঁকছেন তিনি।এমন সময় পাশের বেডে আনা হলো কানাইলালকে। প্রচন্ড পেটের যন্ত্রনায় তিনি অচৈতন্য।ভর্তি হয়ে রইলেন কদিন। ৩০ শে আগস্ট, কানাইলাল এর জন্মদিন।পুলিশকে বললেন, আর পারছিনা এই কষ্ট সহ্য করতে,দুজনেই রাজসাক্ষী হবো।তবে আগে জানতে চাই নরেন রাজসাক্ষী হয়ে কেমন আছে।ভালো খেতে পরতে পাচ্ছে?পুলিশ তো হাতে চাঁদ পেল।পরদিনই আনবে নরেন গোঁসাই কে।
পরদিন সকাল ১১ টা।বেডে শুয়ে দুই বিপ্লবী দেখলেন পুলিশের গাড়ি এসে থামলো। চারজন বন্দুকধারী প্রহরী নরেন কে নিয়ে উঠে আসছেন।এতদিনের অসুস্থতার অভিনয় এই দিনটার জন্যই।আজ এসেছে সুযোগ।ঝটিতি দুই বিপ্লবী সিঁড়িতে দাঁড়ালেন।যেন স্বাগত জানাতে এসেছেন। নরেন আসতেই মুহূর্তে দুজনের হাতে উঠে এলো পিস্তল।ফায়ার করলেন কানাইলাল।


তাঁর কাছে একটিই গুলি আছে।নরেন তখন সত্যেন বসুর দিকে ফিরে। পিঠের দিকে গুলি ভেদ করলো তাকে।ড্রেনের মধ্যে গিয়ে পড়লেন নরেন। বিশ্বাসঘাতকের উপযুক্ত স্থান।আচমকা আক্রমণে দিশেহারা পুলিশরা লুকালো বেঞ্চের তলায়।বিপ্লবী দুজন পালালেন না।তারা তৃপ্ত কন্ঠে চিৎকার করে উঠলেন বন্দেমাতরম।ধরা দিলেন পুলিশের কাছে।
তারপর ইংরেজ দ্রুত বিচার করলো।সহায়তা করলেন কানাইলাল।প্রাণভিক্ষার আবেদন দূরের কথা।বাঁচার চেষ্টাই করলেন না।শুধু বলে গেলেন আমার মৃত্যুর পর কোনো ঈশ্বরের নাম নিও না, পারলে বন্দেমাতরম ধ্বনি দিও।১০ নভেম্বর ১৯০৮ আলিপুর জেলে ফাঁসি হলো তাঁর।ক্ষুদিরামের পর দ্বিতীয় বিপ্লবী যিনি ফাঁসিতে প্রাণ দিলেন।বয়স তখন তাঁর মাত্র ২০।কিন্তু বিচার চলা থেকে ফাঁসি কাঠে ওঠা পর্যন্ত তাঁর ভাবলেশহীন প্রশান্ত মুখ অবাক করেছিল ইংরেজদের। কী দিয়ে তৈরি এসব ছেলে!! এক বিপ্লবীকে ইংরেজরা জিজ্ঞাসা করেছিলো এমন ছেলে আর কত আছে দলে?বিপ্লবী কানাই লাল দত্ত ছিলেন সেই বাঙালি বিপ্লবী যিনি ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন,’আমার মুখ কালো করবেন না ‘দাবি মতো তাঁর মুখ ঢাকা হয় নি।নিজের ফাঁসির দড়ি নিজেই ঠিকঠাক করে গলায় বসিয়েছিলেন।মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়েছিলেন শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। তাঁর মরদেহ নিয়ে শোভাযাত্রায় যে ভাবে জনজোয়ার সৃষ্টি হয়, তাঁর চিতার ওপর মুঠো মুঠো ফুল ছড়িয়ে দেয় যুবকের দল,তাতে বোঝা যায় কানাইলালরা মরেন না, বেঁচে থাকেন আবেগে,আদর্শে, ভালোবাসায়।যা থেকে জন্ম নেয় এইরকম আরও বহু কানাইলাল।লক্ষ লক্ষ মানুষ তারা একে অপরকে ধাক্কা দিয়ে এক বারের জন্য হলেও শববাহী খাটটি ছুঁতে চায়। সর্বত্র ‘জয় কানাই’ ধ্বনিতে আন্দোলিত।শহীদের শেষ যাত্রায় এতো জনসমাগম আগে কোনদিন দেখেনি কলকাতা।কেওড়াতলা শ্মশানে দাহকার্যের পর কানাইলালের ‘চিতাভস্ম’ কেনার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু হয়।আধ ছটাক চিতাভস্মের জন্য কোনও কোনও অত্যুৎসাহী সেই আমলে পাঁচ টাকা পর্যন্ত দিয়েছিলেন!

Related posts

অফবিটঃ সাংবাদিকতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা

E Zero Point

RAMADAN2023: ছোট্ট শিশুর অবুঝ মনের প্রশ্ন – রমজানে রোজা কেন রাখা হয়?

E Zero Point

এক নজরেঃ কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন

E Zero Point

মতামত দিন