27/04/2024 : 2:04 AM
আমার বাংলাজীবন শৈলীভ্রমণ

ঘুরে আসুন ঘরের কাছেইঃ বড়শুলের বিস্মৃত অধ্যায়ের একটি ঐতিহাসিক সংগ্রহশালা

জিরো পয়েন্ট প্রতিবেদন

তিয়াসা পাল


গতকাল অর্থাৎ ১৮ এপ্রিল ছিল বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস। ঈশ্বরের ইচ্ছায় দিনটির যথার্থতা সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে ধরা দিল।নিজের এলাকার এমন সোনার টুকরো ইতিহাস কেন যে এতোদিন চোখে পড়েনি তারজন্য ভারী আফসোস হচ্ছে। আমরা কত জায়গায় ছুটে যাই অথচ কবির ভাষায় ঘরের পাশের ক্ষেতে ধানের শীষে থাকা শিশিরবিন্দুটাই দেখা হয়না। জানিনা কেন আমাকে বাইরের নেশা দিনদিন চেপে ধরছে। বাইরে না বেরোলে মন ভরছে না,জানতে ইচ্ছে করছে, জানাতে ইচ্ছে হচ্ছে,কৌতূহল আর প্রশ্নবাণে নিজেকেই জর্জরিত করে ফেলছি। কত অদেখা আছে,কত অজানা আছে,তার কিছুই তো জানিনা আমি। আর সেসব জানতে জানতেই নিজেকে কতটা অজ্ঞ আর নিঃস্ব মনে হয় তা প্রকাশ করতে অপারক আমি।

ইতিহাস জানলে যে শুধু নিজের জ্ঞান বিকশিত হবে তাই নয়, সাথে অহংও নাশ হবে। কেন? কারণ অতীতকে দেখে নিজেরও অনুভূতি হবে যে একদিন প্রত্যেককেই ইতিহাসের কালগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে হবে।তখন কেউ মনে রাখবে,আবার কেউ রাখবেনা, তাই কত ক্ষুদ্র আমরা। ইতিহাস অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ।বিজ্ঞান,ভূগোল একজনকে ভবিষ্যতের সাথে আলাপ করায় আর ইতিহাস আলাপ করাবে সকল উৎসের পটভূমি,প্রাচীনতার সাথে। নিজের অতীত ,শিকড় না জানলে ভবিষ্যতের যতই ভিত্তিপ্রস্তর রচনা করা হোকনা কেন তা নিঃসন্দেহে হবে দুর্বল।হয়তো আমার কাছেও আমার নিজের এলাকা ব্রাত্য ও অজানাই থেকে যেত যদিনা কিছুজন সেই অতীতের পথের দিশা না দেখতো।

বড়শুলের দে বাড়ির কথা কানাঘুঁষো শুনলেও, গতবছর আমার এক বন্ধু প্রথম জানায় বড়শুলের সেই বাড়ির গুরুত্বটা,বাইরের কত মানুষ ওই জায়গাটির তারিফ করেন ও তাদের কাছে এ যেন এক অমূল্য সম্পদের খনি -তার কথা। এছাড়াও দামোদর নদী,প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পুরাতন মন্দির,বিধানচন্দ্ররায়ের স্বপ্নের উন্নয়নীর টানে কত মানুষ এখানে আসেন সেসব কোথাও ধারণাতীত ছিল।অবশেষে আমিও ভাবলাম যে আমি তো সেই ভাগ্যবান যে এসবের মাঝে আছি,তাহলে এসব আমারও জানা অবশ্য উচিৎ।সেইথেকেই শুরু হলো জানা,চেনার অধ্যায়।

গত বছর বন্ধুই প্রথম মিউজিয়ামটি ও ওই বাড়ির পূজো দেখার জন্য হিমাদ্রি জেঠুর সাথে যোগাযোগ করেন কিন্তু করোনার ত্রাসে আসা আর হয়ে ওঠেনি, কিন্তু স্থানীয় বলে কিছুটা ছাড় ছিল আমার জন্য। হঠাৎ করেই পুজোর সময় একাই আমি উপস্থিত হয়ে হয়েছিলাম দে বাড়ির বনেদি পূজো দেখতে। হতাশ করেননি হিমাদ্রি জেঠু, পুজোর ব্যস্ততার মধ্যেও ঠাকুর দালান, পুরোনো ইমারতের গল্প বলেছিলেন ও আশ্বাস দিয়েছিলেন করোনার প্রকোপ কমলে মিউজিয়ামটি ও পূজো সম্পর্কে অনেক তথ্য বিশদে জানাবেন। কিন্তু পরিস্থিতির বরং আরও অবনতি ঘটেছে,তবুও দীর্ঘদিন ধরে যেহেতু জেঠুর কাছে ইচ্ছাপ্রকাশ করছিলাম,সেহেতু জেঠু নিজেই এই রবিবার চলে আসতে বলেন।আর প্রবল উৎসাহে উদগ্রীব হয়ে আমার সাইকেলটি নিয়ে তপ্ত দুপুরে নির্জন রাস্তা দিয়ে 4-4.5 km. দূরে দে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লাম।আর পথের দুইধারের কচি সবুজ রঙের খেত,শাল সেগুনের বন, কৃষ্ণচূড়ার সৌন্দর্য বিমোহিত করলো আমাকে।দুঃখিত,এই লেখার ভূমিকাটি বড় হওয়ার জন্য,তবে এতটুকু না বললেই আমি মনের অজানাকে জানার আনন্দ ও ভাব প্রকাশ করতে পারতাম না।

‌যথারীতি সাড়ে তিনটের সময় উপস্থিত হলাম দে বাড়ির সামনে।এই পাড়াতেই তিন জায়গায় পড়তে যেতাম,অথচ এসবের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিলনা।সত্যি বলতে বড়শুলের ওই একই পাড়ায় থাকা অনেক বাসিন্দা জানেনই না এই সংগ্রহশালা সম্বন্ধে,সকলেই জানেন দে বাড়িতে মিউজিয়াম আছে কিন্তু কোন বাড়িটায় বা সেখানে কী আছে তা অনেকেরই অজানা।

আমার সাথে গিয়েছিল আমার বান্ধবী কুহেলী।জেঠু আমাদের সাদরে ডেকে নিলেন বাড়িতে।উদ্দেশ্য ” স্বর্গীয় শুভেন্দ্রমোহন দে ঐতিহাসিক সংগ্রহশালা” হলেও সমগ্র বাড়িটি যেন এক অতীত কালের সাক্ষী। বাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়লো কাঠের উপর লোহার বল বসানো দরজা,যাতে বহিঃশত্রুর কুড়ুলের আঘাতে যাতে দরজার কোনো ক্ষতি না হয় বা না ভাঙে।এরপরই সিঁড়ির উপর আছে ‘চাপা দরজা’,যা সাধারণ উলম্ব দরজা নয়।বর্গীর লুঠতরাজ কিংবা ডাকাতের আক্রমণের থেকে রক্ষা পেতে এমন দরজা হতো।দরজাটির নীচের সিঁড়িতে দিকে ঢেঁকি ও উপরের সিঁড়িতে ধানেভারী ভারী বস্তা দিয়ে জায়গাটা ব্লক করে দেওয়া হত যাতে কেউ উপরে উঠে আসতে না পারে।এরকম দরজা সত্যিই দুর্লঙ্ঘ‍্য।

এরপর চলে গেলাম সংগ্রহশালাটিতে। বাড়িটা সম্বন্ধে কথা হতে হতে জানতে পারলাম এই সব কাঠের কড়ি বর্গাগুলো তৎকালীন বার্মা থেকে সেগুন কাঠ আনিয়ে নির্মিত।এই সংগ্রহশালাটি পেশায় ব্যবসায়ী হিমাদ্রি জেঠুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় স্থাপিত বিংশ শতাব্দীর একদম শেষ বছরের দিকে।উনি ওনার বাবা অর্থাৎ স্বর্গীয় শুভেন্দুমোহন দের নামেই এটি উৎসর্গ করেছেন।নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে রেজিস্টার খাতায় বিশুদ্ধ বাংলায় নাম,ঠিকানা,পেশা,তারিখ,পৌঁছনোর সময় লিখলাম। এরপর উনি শুরু করলেন প্রতিটি জিনিসের সাথে পরিচয় করাতে। সংগ্রহগুলিকে তিনি দুটি ঘরে ভাগ করে রেখেছেন-একটিতে স্বাধীনতার পূর্বের সামগ্রী ও অপরটিতে স্বাধীনতা উত্তর সামগ্রী যা বর্তমানে আর নেই কিংবা বিলুপ্তির পথে।এখানে দেখা যাবে পুরোনো দিনের হেডলাইট,সাইকেলের ডায়ানামো লাইট, পুরোনো বিশেষ ধরনের রেডিও, একটি জেরক্স মেশিন যা অন্যরকম দেখতে-একদিকে পেনসিনের কুচি রেখে পাশে থাকা নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মুদ্রিত কাগজটি বেড় করা হত,এছাড়াও আছে পুরোনো দিনের সুন্দর নকশা আঁকা,বিস্কুটের কৌটো,ষাটের দশকের সাইক্লোস্টাইল মেশিন,কার্বাইডের স্ট্যান্ড, যার নলের অন্যপ্রান্তে অগ্নি সংযোগ করলে সেটি জ্বলতে থাকতো;আর আছে হরেক কিসিমের ক্যামেরা যেমন Yashica MF 2, Vivitar ইত্যাদি এবং তখনকার সেই বাক্স ক্যামেরা , পেট্রোলের লাইটার,হরেক কিসিমের ধানের প্রজাতি সহ অনেককিছু। এছাড়া রয়েছে বাঁশের তৈরি অদ্ভুত পিপে যা তখন তেল পরিবহনের জন্য ব্যবহার হত।

এরপর চলে এলাম দ্বিতীয় ঘরটিতে যেখানেই থরে থরে সাজানো আছে জীবন্ত ইতিহাসের প্রমান,দলিল ও সামগ্রী। সবথেকে বড় টেবিলটি দেখলে মনে হবে কেউ যেন একবাক্স ভর্তি করে পুরোনো দিনের উজ্জ্বলতাকে উপহার দিচ্ছে।কী নেই সেখানে!ঘরে প্রবেশ করা মাত্রই মনটা অদ্ভুতভাবে খুব আবেগতাড়িত ও পুরোনো দিনের ভাবনায় বুঁদ হয়ে গিয়েছিল।প্রথমেই দেখলাম প্রোটো-বাংলায় লেখা তালপাতার পুঁথি,তুলোটের পুঁথি যেগুলি এখনো পাঠোদ্ধার করা যায়নি,না জানি সেগুলো কত আমলের পুরোনো। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি,তখন লেখার কালি প্রস্তুত হতো বয়রা,হরিতকী,আমলকি,বাকল ইত্যাদির ছাইকে ছাগলের দুধে বেঁটে।যা এতো টেকসই যে এতো কাল পরেও তখন পুঁথির পৃষ্ঠা নষ্ট হবার মুখে তখনও লেখাগুলি স্পষ্ট।এই নিয়ে একটি প্রবাদ বাক্য প্রচলিত ছিল:

‘ভূষা-ত্রিফলা বকুলের ছালা
ছাগদুগ্ধে করি মেলা
তাহাতে হরিতকী ঘষি
ছিড়ি পত্র,না ওঠে মসি।।’

জমিদারদের পাগড়ী আছে, আছে প্রচুর ধরণের ফাউন্টেন পেন, দোয়াতের পেন যেমন জরির পেন,পুঁথির পেন,সোনার নিবওয়ালা পেন ,আরও কত। তার মধ্যে একটি পেন হাতে নিয়ে দেখলাম তার বডিতে লেখা 27 th January,1914,U.S.A আর পেনটির নাম ‘Ruby’।ভাবতেই শিহরণ জাগে যে পেনটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ের।এরপরেই দেখা যাবে শতাধিক বছরের পুরোনো ব্লেড ধার করার যন্ত্র, সুইডেনের স্টেপলার,টেলিগ্রাম মেশিন যা এতোদিন শুধু গল্পকথাতেই শুনতাম।এছাড়াও রয়েছে কড়ির ঝাঁপি, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের কাপ ডিস সহ নানান কাঁচের জিনিস,একটি বেলজিয়ামের আয়না যা শতবর্ষ পেরিয়েও flawless, দেখলাম পুরোনো দিনের ব্রিটেনের সাবান ‘Margerisons:Toilet cream soap’ যা এই বাড়ির এক সদস্যার জন্য আমদানি করা হত।আছে এক সুন্দর বিশেষ আকৃতির কাঁচের পাত্র,যা দিয়ে কেবল চোখ ধোয়া যেত।ওখানে U.S. A তে তৈরি এক আতরের শিশি আছে,একশ কুড়ি-ত্রিশ বছর পেরিয়েও যা এখনও অমলিন এবং সেই আতরের সুগন্ধ নেওয়ার সুযোগ পেয়ে আমি ধন্য,আহা! কী মিঠে সেটির সুবাসে যেনো আমি সেই বনেদিয়ানার গন্ধ পাচ্ছিলাম। আরও কত কী সম্ভার…..

এরপর দেখলাম ‘অন্ত:পুর’ নামক ম্যাগাজিন যা ছিল সেইসময়ের সম্পূর্ণ মহিলা দ্বারা সম্পাদিত,প্রকাশিত ও লিখিত। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন শ্রী সরোজিনী বসু,মহিলা হয়েও যিনি ‘শ্রী’ উপাধি ব্যবহার করতেন। হিমাদ্রি জেঠুর সংগ্রহে 1903 থেকে 1905 সাল পর্যন্ত প্রকাশিত সংখ্যাগুলি আছে।ভারতীয় সিনেমার উপর বেশ কয়েকটি পুরোনো বই আছে, আছে 1918 নাগাদ গোপেন্দ্রকৃষ্ণ দের আইন প্র্যাকটিসের রেকর্ড, 1903 সালের দাশরথী হাজরার লেখা পাঁচালী, কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের “চণ্ডীমঙ্গল” সহ অজস্র সেই আমলের বই। তখনকারদিনে সম্ভ্রান্ত পরিবারের শুভ অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ পত্রে কবিতা লেখা থাকতো,বিভিন্ন রাজবাড়ী ও জমিদার বাড়ি যেমন চকদিঘী থেকে প্রাপ্ত এমন বেশ কয়েকটি বিবাহের অনুষ্ঠান পত্র দেখলাম।

ওখানে আছে হিমাদ্রি জেঠুর পিতামহী নির্মলাসুন্দরী দেবীর নানান হাতের কাজ, মাছের আঁশের তৈরী ফুলসহ ফুলদানি যা 1933 সালে ‘ডিস্ট্রিক্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্ড এগ্রিকালচার এক্সহিবিশনে’ 1st class সার্টিফিকেট পেয়েছিল,সেই শংসাপত্রটিও ওখানে যত্ন সহকারে বাঁধানো আছে।এছাড়াও গোপেন্দ্রকৃষ্ণ দের 1911 সালে ম্যাট্রিক পাশের সার্টিফিকেট, 1915 সালে স্নাতক হওয়ার সার্টিফিকেট যা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত।তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সর্বেসর্বা এবং বোর্ড সিস্টেম তখনও আসেনি।লর্ড ইউলিডেন প্রদত্ত ওখানকার জমিদার বংশের শেষ জমিদার গোপেন্দ্রকৃষ্ণ দের ‘রায় সাহেব’ উপাধি, যার শংসাপত্র ওখানে রাখা আছে সযত্নে বর্ধমান রাজ বিজয় চাঁদ,উদয় চাঁদ,কৃষ্ণনগরের রানী,লর্ড,গভর্নর,M. L. C -Member of Legislative Council সহ প্রমুখ উচ্চ পর্যায়ের মান্যজনের সিলমোহর ও সাক্ষর সম্বলিত চিঠি,যা নিজের চোখে দেখলে বিস্ময় জাগে,এগুলি সব বাঁধানো আছে।এছাড়াও এখানে সের,ছটাক, পাইন্ট, গ্যালন পরিমাপের জন্য অসংখ্য ওজনে ব্যবহৃত সামগ্রী আছে।

এছাড়াও আছে বেড়ি, এতদিন বিশ্ববরেণ্য কবির লেখা কবিতায় ‘ঝাঁঝড়ি কড়া বেড়ি হাতা’ পড়তাম বটে কিন্তু জানতাম না জিনিসটা। একদিকে সাঁড়াশির মত অংশ ও অন্যদিকেও শক্ত সরু সাঁড়াশি ধরণের অংশ থাকে যা দিয়ে তখন ভাতের হাঁড়ি বা ভারী জিনিস তোলা পরা করা হত।ওখানে মাটির নল আছে যা তখনকারদিকে নর্দমার মুখে লাগানো থাকতো, আছে বিশাল অত্যাধিক লোহার তালা ও ছবি,His Master’s Voice কোম্পানির গ্রামোফোন, বড় গৃহস্থের জন্য লোহার তৈরি অতীব বড় তেলের পলা,বিশাল বড় গ্যাস বাতি ও বড় হ্যারিকেন,মাস্টার পিস টাইপরাইটার,ছাদ পেটানো মুগুর,বিদেশি পর্শেলিনের মূর্তি,মহিষের শিঙের তৈরি বাক্স,একটি অসাধারণ সিস্টেমের পানের বাটা,সত্যি প্রকৌশল বটে! সহ নানান সামগ্রী যা কেবল আজ থেকে 100-150 বছর আগেই ব্যবহৃত হয়।

এরপরই ইতিহাসের জ্যান্ত দলিল হিসাবে দেখা মিলবে জর্জ পঞ্চম ও জর্জ ষষ্ঠ প্রেরিত আসল আইনি কাগজপত্র।রবীন্দ্রনাথ যেদিন মারা যান তার পরের দিনের সেই খবরের হেডলাইন সম্বলিত আসল আনন্দবাজার পত্রিকাটি এখনো ওখানে দেখা যাবে। 1940 সালে District Union Board এর হাতের লেখা ভোটার তালিকা,তখনও মেয়েদের ও নীচু জাতির মানুষদের ভোটাধিকার ছিলনা।ওখানে আছে 1938 সালের কলকাতায় অনুষ্ঠিত ভাইসরয় কাপের টিকিট। বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ কতৃক জাপানের বিমানগুলি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল সেগুলি ভারতে এনে বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শন করা হয়েছিল যাতে ভারতীয়দের মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি হয়; এমনই একটি প্রদর্শনী হয়েছিল বর্ধমানে এবং তার লিফলেটও এখানে সংরক্ষিত আছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিভিন্ন দলিল ও দস্তাবেজ এখানে দেখা যাবে।এছাড়া আছে এনসোনিয়া এবং সেন্ট থমাস নামক শতাধিক প্রাচীন বিদেশী ঘড়ি।জমিদারের লেঠেলের ব্যবহৃত লাঠি, বিশাল কম্পাস,চেন ঘড়ি ইত্যাদি।সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো একটি চালের উপর 102 টি অক্ষর সম্বলিত একটি চাল,আতস কাঁচে যা স্পট পড়া যায়,এটিও ব্রিটিশদের উপহার দেওয়া।ইংল্যান্ডে ছাপা এক ইঞ্চি বাই এক ইঞ্চি সাইজের অভিধান। ম্যাগনিফাইন গ্লাস দিয়ে প্রত্যেকটি অক্ষর স্পষ্টভাবে পড়া যায়। এই শব্দকোষটি বর্ধমান রাজপরিবারের সদস্য এস এস নন্দে দান করেছেন।এছাড়াও পোস্ট কার্ডের বিবর্তন সম্বলিত একটি ফাইল আছে, সেই পুরোনো আমল থেকে বর্তমান পর্যন্ত সব পোস্ট কার্ড দেখা যাবে,এছাড়াও কয়েকটি প্রাচীন মুদ্রা ,সাতটি লক সম্বলিত সিন্ধুক,ব্রিটিশদের দেওয়া ট্রাঙ্ক বাক্স ,ডোকরা ও টেরাকোটা কাজের পুরোনো সিঁদুর কৌটো দেখা যাবে।

এই জমিদারিটি বর্ধমানরাজার অধীনে শুরু হয় সনাতন দের আমলে প্রায় ঊনবিংশ শতকে যিনি ছিলেন রামশরণ দের পৌত্র।এখানে বর্ধমান রাজের এস্টেট,চকদিঘী,বড়শুল সহ কয়েকটি জমিদারি এস্টেটের খাজনা আদায়ের জন্য ব্যবহৃত রশিদগুলি দেখা যাবে।সমগ্র সংগ্রহশালাটির বর্ণনা দেওয়া অসাধ্য।তবুও আমি 30% তুলে ধরার চেষ্টা করলাম । সৌভাগ্যক্রমে বেশ কয়েকটি কাগজ পত্র ও সামগ্রী হাতে নিয়ে দেখতে পেরেছি যা হয়তো সব দর্শনার্থীদের জন্য হয়না,এরজন্য জেঠুকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই। উনি যে কতটা প্যাশনেট এই কৃষ্টিকে তুলেধরতে ও বিভিন্ন জিনিস সংগ্রহ করতে তা বোঝা যায় মাত্র কয়েক দশক আগেও ব্যবহৃত টাকা,লাট্টুর সংগ্রহ দেখে।উনি এখনো পর্যন্ত রিজার্ভ ব্যাংকের প্রতিটি গভর্নরের আমলের টাকা সযত্নে তুলে রেখেছেন। এই মিউজিয়ামে কোনো প্রবেশ মূল্য নেই,জেঠুর অভ্যর্থনা ও আগ্রহ যেকোনো ব্যক্তিকে মুগ্ধ করবে।এবং সন্ধ্যের পর বাড়ি পৌঁছে গেছি কিনা সেটাও উনি খোঁজ নিয়েছেন। জেঠু বলেছেন এরপর পালকি দেখাবেন এবং একসাথে সবকিছু তো ব্যাখ্যা করা যায়না পরের দফায় আরও অনেক নতুন তথ্য পরিবেশন করবেন। উনি নিরলস প্রচেষ্টায় এখনো নানান জিনিস সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেছেন এবং মিউজিয়ামটিকে আরো সাজিয়ে তুলছেন। এমন একটি প্রচেষ্টা সকলের সামনে আনা উচিত,ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এসব তুলে ধরতেই উনি সদা চেষ্টা করছেন,এর সাথে ওনার কোনো আর্থিক স্বার্থ জড়িত নেই এটা মাথায় রাখা দরকার।ওনার সংগ্রহে আছে ত্রুটি যুক্ত কয়েকটি নোট,যা ছাপার ভুলে ট্যাকশালেই হয়েছে, এগুলি কিন্তু খুবই বিরল। এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তারা,বিভিন্ন পুরাকীর্তির গবেষকরা ছুটে আসেন এখানে। এটি সত্যিই এক অতুলনীয় গর্ব বড়শুল তথা সমগ্র বাংলার।খুব সীমিত কয়েকটি ছবি আমি সবার সাথে ভাগ করে নিয়েছি,সংগ্রহশালার স্বার্থে সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ ছবি দেওয়া ঠিক নয়।ইতিহাস নিয়ে আগ্রহ থাকলে নিজেরা অন্তত একবার অবশ্যই দেখে যাবেন এটি,করোনার প্রকোপ কমলে।

এরপর বাড়ি আসার সময় রেজিস্টারে departure time লিখে অন্য একটি রেকর্ডে নিজের অভিজ্ঞতা লিখলাম।এতো গুণীজন যে খাতায় নিজেদের সিলমোহর দিয়ে এই মিউজিয়াম সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন সেটিতে নিজের অভিজ্ঞতা লিখতে পেরে সত্যিই ধন্য মনে হচ্ছে। ফেরার পথে দেখা যাবে যাদব নন্দীর নির্মিত 1731 সালের একটি আটচালার শিবমন্দির।যতদূর দেখেছিলাম সেটি টেরাকোটার ছিল যা এখানে খুবই বিরল,কিন্তু বর্তমানে এটিকে নতুন রূপ দেওয়া হয়েছে।

নিজের এলাকার এমন একটি উপেক্ষিত অথচ বিস্ময়কর ও অসাধারণ প্রত্ন সংগ্রহশালা সম্বন্ধে জানতে পেরে খুবই ভালো লাগলো।

পথনির্দেশ:

হাওড়া-বর্ধমান কর্ড বা মেন লাইনের ট্রেনে চড়ে শক্তিগড় নামবেন, স্টেশন চত্বর থেকেই বাসে বা toto করে সোজা বড়শুল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে নামবেন। ওখানে যে কাউকে জিজ্ঞাসা করে বড়শুল লাইব্রেরীর ওখানে চলে আসবেন। তবে আসার আগে একবার জেঠুর সাথে যোগাযোগ করে নেবেন। করোনার কারণে এখন বন্ধ থাকতে পারে।


কৃতজ্ঞতা স্বীকার: হিমাদ্রি শংকর দে,’স্বর্গীয় শুভেন্দুমোহন দে সংগ্রহশালা’র স্থাপক ও অধিকর্তা
এবং শুভজিৎ দত্তকে যিনি প্রথম এই তথ্য সংগ্রহের কাজে উৎসাহিত করেছেন,আমার এলাকা হলেও এসব আমার নাহলে অজানাই থেকে যেত।

Related posts

জানেন কি বর্ধমানে কোথায় আছে ৩০০ বছরের রথের দড়ি?

E Zero Point

কাটোয়ায় মুট পুজো

E Zero Point

রেল হকাদের বিক্ষোভ সমাবেশ কালনায়

E Zero Point

মতামত দিন