02/05/2024 : 12:02 PM
জীবন শৈলীধর্ম -আধ্যাত্মিকতা

হজরত মোহাম্মদঃ ইসলাম ধর্ম বিশ্বজনীন সাম্যের এক ফলিত রূপ

জিরো পয়েন্ট বিশেষ প্রতিবেদন, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩:

মহম্মদ ইব্রাহিম


হজরত মোহাম্মদ (দঃ) 570 খ্রিষ্টাব্দে এই রবিউল আউয়াল মাসে পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত হন । তিনি কয়েকটি অনুষ্ঠান সমন্বিত কোনও ধর্মের প্রচারক ছিলেন না। তাঁর প্রচারিত ইসলাম ধর্ম বিশ্বজনীন সাম্যের এক ফলিত রূপ।তিনি হলেন সর্বকালের সফলতম সমাজ সংস্কারক। তাঁর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল তিনি যা বলেছেন তা প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন। তিনি সমগ্র মানবমণ্ডলীকে এক জাতি মনে করতেন।প্রথম মানুষ আদম(আঃ) থেকে শুরু করে নুহ(আঃ) , দাউদ(আঃ) , সুলায়মান(আঃ) , ইব্রাহিম(আঃ), ইসমাইল(আঃ) ,ইসাহক(আঃ) , ইয়াকুব(আঃ) , আইউব(আঃ) , ইউসুফ(আঃ) , মুসা(আঃ) , হারুন(আঃ) , যাকারিয়া(আঃ) , ইয়াহিয়া(আঃ) , ইলিয়াস(আঃ) , ইয়াসা(আঃ) , ইউনুস(আঃ) , লুত(আঃ) , যিশু (আঃ) সমস্ত নবী- রসুলদের প্রতি তিনি সম্মান জানিয়েছেন এবং ইসলাম ধর্মের মানুষদের নির্দেশ দিয়েছেন তাঁদের প্রতি সম্মান ও সালাম জানাতে। তাই কোনও নবীর নাম বলা বা শোনার সাথে সাথে প্রত্যেক মুসলিম মৃদুস্বরে “আলাইহি সালাম” বলে আজও সম্মান জানান প্রতিদিন। নবীগণ কোন দেশের বা কোন ধর্মের প্রচারক ছিলেন তা বিচার্য নয়, বিচার্য বিষয় হল তাঁরা মহাপুরুষ ছিলেন। এ ছিল তাঁর সকল ধর্মের প্রতি সহনশীলতার পরম নিদর্শন। কোনও মানুষকে ঘৃণা বা তাচ্ছিল্য করাকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন তিনি । মানুষের প্রতি মানুষের ঘৃণা বা অবজ্ঞা থেকেই বিকৃত নাম উচ্চারিত হয়, প্রেম থেকে নয়। তাই মানুষের গঠন, আকার, গাত্রবর্ণ , ধর্ম, শারীরিক বা মানসিক বিকলাঙ্গতা প্রভৃতির উল্লেখ করে ব্যঙ্গ করাকে হজরত মোহাম্মদ (দঃ) এক সমুদ্র জলকে বিষাক্ত করার সাথে তুলনা করেছেন।

সপ্তম শতাব্দীতে তিনি “বিকলাঙ্গ” শব্দ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন, একবিংশ শতাব্দীতে তার পরিবর্তে “বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন” শব্দ ব্যবহার করে সম্মান করা হয় মানুষকে। তিনি নারী জাতিকে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন এবং সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা করেছেন 623 খ্রিষ্টাব্দে বিধবা বিবাহ প্রচলন করে। তিনি অসাধারণ বিপ্লব ঘটিয়েছেন নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করে। সভ্যতার ইতিহাসে তিনিই প্রথম 624 খ্রিষ্টাব্দে নারীর সম্পত্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। পিতামাতার এবং স্বামীর সম্পত্তির অধিকার সুনির্দিষ্ট করে দেন যেই যুগে, যখন পৃথিবীর কোথাও নারীদের সম্পত্তির কোনও অধিকার ছিল না।নিজের ধর্মকে ভালবাসা অপর ধর্মকে ঘৃণা করার যেন শর্ত না হয়। “কোনও ধর্মের প্রতি আনুগত্য যেন ন্যায় বিচারে বাধা সৃষ্টি না করে”, – কোরানের এই নির্দেশ তিনি নিজে প্রয়োগ করেন মদিনা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে বিচারকের ভূমিকায় বসে।তাঁর নেতৃত্বে মদিনা রাষ্ট্র গঠিত হলে তিনি ইহুদি খ্রিষ্টান মুসলিম অমুসলিম সকল ধর্মের নাগরিকের নিরাপত্তা, সমান অধিকার এবং তাঁদের প্রতি ন্যায় বিচার নিশ্চিত করেন। অমুসলিমদের একটিও ধর্মস্থানের ক্ষতি করা হয়নি বরং ধর্মস্থানগুলি পবিত্র ঘোষণা করে সুরক্ষিত রাখা হয়।

এই মর্মে 628 খ্রিষ্টাব্দে একটি লিখিত দলিল ঘোষণা করা হয় ।বর্ণ বৈষম্য,গোষ্ঠী সংঘর্ষ, দরিদ্র নিপীড়ন,নারী নির্যাতন,শিশুকন্যা হত্যা,লুন্ঠন, শঠতা, মদ্যপান, অন্যায় অবিচার প্রভৃতি অমানবিক ক্রিয়াকলাপের বিরুদ্ধে ছিল তাঁর প্রতিবাদ।এক আল্লাহ ছাড়া উপাস্য নেই – এই ছিল তাঁর মন্ত্র। ।স্বার্থান্বেষী এবং প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলি এই প্রতিবাদের বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকে। মাত্র তেইশ বছরের নবুয়তি জীবনে হজরত মোহাম্মদ (দঃ)ছোটো বড় চল্লিশটিরও বেশি যুদ্ধ করতে বাধ্য হন। কিন্তু তাঁর প্রত্যেকটি যুদ্ধ ছিল রক্ষণাত্মক। যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি 622 খ্রিষ্টাব্দে সেপ্টেম্বরের এক গভীর রাতের অন্ধকারে গোপনে জন্মস্থান মক্কা থেকে দুশো মাইল উত্তরে মদিনা শহরে বিষণ্ণ হৃদয়ে চলে যেতে বাধ্য হন ।কিন্তু শত্রুর দল তাঁর পিছু ছাড়েনি । পালিয়ে যাওয়ার এক বছর পরই মদিনার কাছে বদর প্রান্তরে মক্কার কোরেশ বাহিনীর সাথে তাঁকে যুদ্ধ করতে হয় ।পরবর্তী বছরগুলিতে প্রায় সমস্ত যুদ্ধগুলি ঘটে মদিনা শহরের আশেপাশে।অর্থাৎ মক্কা থেকে শত্রুবাহিনী মদিনা আক্রমণ করতে যেত।

বদর, ওহুদ ,খন্দক, হোদাইবিয়া, খাইবার সব ঐতিহাসিক যুদ্ধগুলি সংঘটিত হয় শত্রুদের প্রতিহত করতে। তাই তিনি কখনও পরিখা খনন করে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করেন(খাইবার যুদ্ধ 627 খ্রিষ্টাব্দে ), কখনও সন্ধি স্থাপন করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন (হোদাইবিয়ার সন্ধি 628 খ্রিষ্টাব্দে )। হজরত মোহাম্মদ (দঃ) যুদ্ধক্ষেত্রকে প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধের স্থান হিসাবে ব্যবহার করেননি,ব্যবহার করেছিলেন অন্যায় প্রতিরোধ করতে। তিনি এক তরফা যুদ্ধ নীতি ঘোষণা করেন। কোনও যুদ্ধে নারী শিশু বৃদ্ধকে হত্যা করা হত না।বিজিতদের নরনারীদের দাসদাসীতে পরিণত করা হয়নি কখনও ।শত্রু পক্ষের ফসল বা সম্পদ ধ্বংস করা হত না, যুদ্ধবন্দিদের হত্যা করা হত না। যুদ্ধবন্দিদের সম্মানজনক শর্তে মুক্তি দেওয়া হত।এমন যুদ্ধ নীতি মানুষ আজও গ্রহণ করতে পারেনি ।হজরত মোহাম্মদ (দঃ)মানুষের মধ্যে অস্পৃশ্যতাকে অভিশাপ বলে মনে করতেন। তাই তিনি ইসলাম ধর্মে অস্পৃশ্যতাকে রোজ কেয়ামত পর্যন্ত একেবারে মুছে দিয়েছেন। ইসলামে পৃথিবীর কোনও একজন মানুষও অস্পৃশ্য নয়। বরং প্রত্যেকটি মানুষ পবিত্র। মসজিদে প্রবেশ সবার জন্য অবারিত।

ভারতীয় অভারতীয়, ধনীনির্ধন, সাদাকালো, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী, সবল দুর্বল সকলেই একে অপরের পাশে প্রেমের স্পর্শে মসজিদে ,ঈদগাহে বা জানাজার ময়দানে নামাজে অংশ গ্রহণ করেন। শিক্ষা এবং জ্ঞানের যোগ্যতার নিরিখে নামাজ পরিচালনায় ইমাম নির্বাচন করা হয়, সম্পদশালী ,প্রভাবশালী বা গোষ্ঠীদলপতিকে নয়। যতই রাজনৈতিক ক্ষমতাবান ব্যক্তি হন না কেন, তাঁকে জ্ঞানী ইমামের পিছনে, হয় তো বা ইমাম দরিদ্র, তবু ক্ষমতাবানকে ওই ইমামের পিছনে নামাজ পড়তে হয়।সাম্যের এমন নিদর্শন আর কোনও সমাজ ব্যবস্থায় নেই । হজরত মোহাম্মদের(দঃ)জীবনে একটিই আক্রমণাত্মক যুদ্ধ ছিল। তা ছিল তাঁর মক্কা বিজয় 630 খ্রিষ্টাব্দে 16 ফেব্রুয়ারি।আট বছর পর প্রিয় জন্মস্থান মক্কা শহরে ফিরতে চেয়েছেন বিজয়ের বেশে। সহস্রাধিক সাহাবি বা অনুগামীসহ মদিনা থেকে মাথা উঁচু করে গেছেন মক্কার উদ্দেশ্য, কিন্তু মাথা নিচু করে বিনম্রে প্রবেশ করলেন প্রিয় মক্কা শহরে। একটিও প্রাণহানি হয়নি।

একবিন্দু রক্ত ঝরেনি।বিনা রক্তপাতে মক্কা জয় করলেন।মক্কা শহর থেকে যারা তাঁকে একদিন বিতারিত করেছিল তাদের সকলকে তিনি প্রেমের আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নেন। তাঁর সন্তানসম্ভবা কন্যা যয়নাবকে 623 খ্রিষ্টাব্দে যে হিবার-বিন আসওয়াদ খুন করেছিল তাকেও তিনি ক্ষমা করে দেন। তাঁর আপন চাচা আমির হামজাকে হত্যা করে তাঁর হৃৎপিণ্ড ভক্ষণ করেছিল যে নারী আবু সুফিয়ানের স্ত্রী এবং মাবিয়ার মা হিন্দা, তাকেও তিনি ক্ষমা করে দেন। মহাশত্রু আবু জেহেলের পুত্র ইকরামা ও সাফওয়ানকে তিনি ক্ষমা করে দেন। হজরত মোহাম্মদ (দঃ ) জীবনে কখনও কাউকে অভিশাপ দেননি ,দোষারোপ করেননি ।তিনি ভালবেসে গিয়েছেন, ক্ষমা করে গিয়েছেন ।তিনি যে “বিশ্ব জগতের আশিস রূপেই প্রেরিত হয়েছিলেন।”- কোরান (21:107 )।

Related posts

মেমারিতে মনসা পুজো

E Zero Point

রান্নাঘরঃ ম‍্যাংগো হানি কুলফি

E Zero Point

পুরীতে জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রা, আক্ষেপ-মন খারাপ অসংখ্য ভক্তদের

E Zero Point

মতামত দিন