সুতপা দত্ত
ছেলে সৌরভের বিয়ের গাড়িটা জলছবির মত মিলিয়ে গেল দূর থেকে দূরে।খুব অল্পবয়সেই পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত ছেলেটাকে বুকে করে অনেক কষ্টে নীভাদেবী একাই মানুষ করেছেন,কখনও ছেলেকে বাবার অভাব বুঝতে দেননি।সেই দুর্দিনের কথা স্মরণ করে চোখদুটো ভিজে উঠল।
-একি? কাঁদছ কেন?কি অলুক্ষণে ব্যাপার রে বাবা,ছেলে যাচ্ছে বিয়ে করতে মা কাঁদছে।ছেলের বিয়ে যেন কারো হয়না, কি অমঙ্গল যে হবে ছেলেটার কে জানে..
চমকে উঠে নিজেকে সামলে নিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন নীভাদেবী, জানিয়ে দিলেন তাকে যেন কেউ বিরক্ত না করে।
ইসস…সত্যিতো.. এমন ভাবে কেন কাঁদলাম, সত্যি যদি ছেলেটার আগামী জীবনে কিছু অমঙ্গল নেমে আসে?না না এমনটা হবে না,অনেক কষ্টে মানুষ করেছি ওকে। দীর্ঘ দিনের পুরানো স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসলেন নীভাদেবী..
******
ছেলেটা রোজই দৌড়ে এসে বাসে ওঠে , ঠিক ছাড়ার মুহুর্তে , একদিন তো …. , ভাগ্যিস কনডাক্টর কাকু ধরে ফেলেছিলেন। বাস শুদ্ধ লোক হাঁ হাঁ করে উঠেছিল , কয়েকজন তো মারে আর কি !
-এত তাড়া কিসের !
-সময়ে আসা যায় না !
-না পারলে পরের বাস ধরো , তাই বলে সাত সকালে মরবে নাকি !!
একে তো সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরল , তারপর এত লোকের ধমক , মুখচোখ দেখে মনে হচ্ছিল এবার হার্টফেল করবে !! নীভা তাড়াতাড়ি উঠে নিজের জায়গায় বসতে দিয়ে , জলের বোতলটা এগিয়ে দিল। আগে অনেকবার চোখাচোখি হয়েছে , কিন্তু কথা হয়নি কখনও , আজ চোখ তুলে চাইতেও পারল না , খুব অপ্রস্তুত।
পরের দিন বাস ছাড়া অবধি মনে মনে অপেক্ষায় রইল নীভা , এলো না তো ! মনটা জানি না কেন খুব খারাপ হয়ে গেল। এরপর আরও দুটো দিন। আর হয়তো কখনও দেখাই হবে না ! হয়তো সে যাচ্ছে পরের কোনো বাসে ।
পরের দিন সকালে বাস স্টপে পৌঁছেই দেখে ছেলেটি দাঁড়িয়ে , কিছুটা ইতস্ততঃ করেও এগিয়ে গেল নীভা ,
– কেমন আছেন ?
– ভালো।
– এলেন না যে ক’দিন , তাই ভাবলাম …
– ওই একটু জ্বর জ্বর মতো …. , এখন ঠিক আছি , ধন্যবাদ সেদিনের জন্য ।
বাস এসে গেল , উঠে পড়ল দু’জনে । নীভা আগে নামে , ও তখন ক্লাস টুয়েলভ । সিট ছেড়ে উঠে কোনো এক অজানা টানে পিছন ফেরে , আরও দুটো চোখ সে সময় ওরই দিকে চেয়ে, চোখাচোখি হতেই চার চোখ প্রবল লজ্জায় নিজেদের লুকিয়ে ফেলল চট করে ।
এভাবেই শুরু , আস্তে আস্তে আলাপ গড়ালো গভীর প্রেমে।
অর্পণ বছর তিরিশের সুদর্শন যুবক আর নীভা আঠারো বছরের পাহাড়ি নদী , উচ্ছ্বল , প্রাণবন্ত আর তেমনই সৌন্দর্য্য সে নদীর কানায় কানায় , চোখ ফেরানো দায়। অর্পণ তখন একটা ছোটো খাটো প্রাইভেট কম্পানিতে মাত্র বছর দুই হল জয়েন করেছে। বাড়িতে বাবা-মা , ভাই-ভাইবৌ আর ওদের ছয় মাসের পুঁচকে। বাবা রিটায়ার্ড সরকারী কর্মচারী, ভাই একটা বহুজাতিক সংস্থায় । ছিমছাম সুন্দর সাজানো গোছানো সংসার , নিজেদের দো-তলা বড়ো বাড়ি । অর্পণ পড়াশুনা শেষ করে কত যে চাকরির পরীক্ষায় বসেছে , কিন্তু শিকে ছেঁড়ে নি । তাই বাধ্য হয়ে এখন বেসরকারি সংস্থাতেই যোগ দিয়েছে।
সময়ে চাকরি না পাওয়ার কারণেই ছোটো ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেছে আগেই , এখন ওর পালা । একটু গুছিয়ে ওঠার জন্য দু’টো বছর সময় চেয়েছিল অর্পণ। এবার সেই সময় এসেই গেছে , মা বড্ড তাড়া দিচ্ছেন। এখন শুধু মা নয় , ওর মনও নীভাকে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল। বরাবরই খুব মুখচোরা , শান্ত স্বভাবের ছেলে , কোনো সাতে পাঁচে নেই , সবথেকে মুশকিল হল সবসময় প্রতিবাদ-টাও ঠিকঠাক করে উঠতে পারে না ।
ইদানিং অর্পণ ভাবছে, ভেবেই চলেছে কিভাবে নীভার কথাটা বাড়িতে বলবে , প্রথম তো মা-কেই বলবে , কারণ ওই একটাই তার অতি দূর্বল জায়গা । (ক্রমশ)….
4 মন্তব্য