পিয়ালী বসু রায় চৌধুরী
“যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো!”
আজ দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর এই পরিস্থিতিতে কবির এই কথাগুলি আমি একটু বেশিই উপলব্ধি করছি।
আমি শিক্ষকতা করি তবু আজও নিজেকে ভুগোলের ছাত্রী বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি, কারণ শেখার তো কোনো শেষ নেই তাই আজীবন ব্যাপী আমরা সবাই ছাত্রছাত্রী বটে।
যাই হোক, স্কুলে যখন পড়াই ভারতের জলবায়ুগত বৈশিষ্ট্য বলতে গিয়ে প্রথমেই যেটা বলি তা হলো ভারতের মূল ভূখণ্ড দক্ষিণে 8°44’North (কন্যাকুমারিকা অন্তরীপ) থেকে উত্তরে 37°6′ North (কাশ্মীরের উত্তর সীমা ইন্দিরা কল) পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ায়, ভারত নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর অন্তর্গত। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে সেই জলবায়ু আমরা কয়েক প্রজন্ম ভুলেই গিয়েছিলাম। আমার ওই ছোট ছোট ছাত্রীরা বই-এর লেখার সাথে প্রকৃত আবহাওয়ার কোন মিল পেত না এতো দিন যাবৎ। বই এর পাতায় তারা পড়ে রাজস্থানের তাপমাত্রা গড় 40 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে 50 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে থাকে। আর এখন বেশ কয়েক বছর তো কলকাতার তাপমাত্রাই ছিল গড় 40 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের বেশি অথচ আমরা মরু অঞ্চলে বাস করি না; আর এই ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ওই সিক্স এর মেয়েদেরও আমাকে গ্লোবাল ওয়ার্মিং সম্পর্কে বলতে হয়, যা তাদের সিলেবাস বহির্ভূত। যাই হোক বিশ্ব আজ কঠিন অসুখে জর্জরিত। আমরা আজ ভীত সন্ত্রস্ত। লাগাম লেগেছে দৈনিক জীবনযাত্রায়, স্তব্ধ এখন জনজীবন। এই ব্যাধির প্রকোপ থেকে বাঁচার অপ্রাণ চেষ্টা করলেও আমাদের দেশের জনসংখ্যার সাপেক্ষে স্বাস্থ্য পরিসেবার পরিকাঠামো যা তাতে আক্রান্তের হার যে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে তা বলাই বাহুল্য। এত অস্থিরতা ও সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আজ আমার মনের গভীরে কোথাও একটা ভালোলাগাও রয়েছে শুধু মাত্র প্রকৃতির কথা ভেবে। যে জলবায়ু আমাদের সম্পদ ও প্রকৃতি নিয়ন্ত্রক, তা ছিল দূষণে বিধ্বস্ত। কিন্তু আজ আমরা নিজেদের তৈরি সংকটে নিজেরাই গৃহবন্দি। কলকারখানা আজ বন্ধ, গাড়ি ঘোড়া আজ স্তব্ধ। বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড সহ গ্রীন হাউস গ্যাসের পরিমাণ কমেছে চোখে পড়ার মতো। ভারতের বড় বড় শহরগুলির আবহাওয়ায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। বাতাসে দূষিত গ্যাস ও ধূলিকণার প্রভাবে চারিপাশ থাকতো ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। কিন্তু স্তব্ধ জনজীবনে আজ প্রকৃতি তার নিজের নিয়মেই আরোগ্য লাভ করেছে। রাজধানী শহর দিল্লি ও অন্যান্য বড় বড় শহরগুলিতে এর ব্যাপক পরিবর্তন চোখে পড়ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা অহরহ দেখছি বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও, যাতে দেখা যাচ্ছে গঙ্গা-যমুনার মতো নদীতেও বইছে আজ টলটলে স্বচ্ছ জল। সাদা ফেনায় মোড়া যমুনা আজ নীল জলরাশিতে পরিপূর্ণ।
শুধু তাই নয় মেহতাব বাগ থেকে তাজ আজ স্পষ্ট দেখা যায়। ইন্ডিয়া গেট আজ ঝকঝকে তকতকে দৃশ্যমান। আকাশ আজ স্বচ্ছ নীল তাতে সাদা মেঘের ভেলা। প্রভাব পড়েছে পশুপাখিদের মধ্যেও। আজ আমরা প্রকৃত অর্থে নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু উপলব্ধি করছি প্রতিমুহূর্তে। এপ্রিল মাসের এই সময় কমবেশি আমাদের সকলের বাড়িতেই পাল্লা দিয়ে চলে ফ্যান, এসি, কুলার কিন্তু বর্তমান দিনের আবহাওয়ার আনুকূল্যে এসি, কুলার তো দূরের কথা ফ্যানের প্রয়োজনীয়তা ও আজ কমেছে। প্রতিদিনের জীবনযাপনে আমরা প্রকৃতিকে করেছি অবহেলা, তার ক্ষমতাকে করেছি অগ্রাহ্য। আর তার পরিণাম আমাদের সামনে। মাতৃসমা প্রকৃতি আজ শাসন করে চলেছে তার অবাধ্য শিশুদের।
আশা রাখি খুব শীঘ্রই এই গৃহবন্দি জীবন থেকে আমরা মুক্তি পাবো। কিন্তু আমাদের কখনোই এটা ভুললে চলবে না প্রযুক্তির উন্নতি, বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও আমাদের জীবনযাত্রায় মনোন্নতির মাঝেও প্রকৃতিকে অসম্মান যেন না করি ।
কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য এর “ছাড়পত্র” কাব্যগ্রন্থের একটি লেখা দিয়ে শেষ করতে পারি-
“জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে।
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি—
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।”
এটাই হোক আমাদের সকলের অঙ্গীকার।
বিঃদ্র- আমার এই লেখা একজন ভুগোলের ছাত্রী হিসাবে বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রকৃতি ও জলবায়ুর পরিবর্তন কেন্দ্রিক; অন্যান্য সমস্যাগুলি অগ্রাহ্য না করেই।
ছবি প্রাপ্তি-Google, ভাবনা সহযোগিতাঃ পার্থ রায় চৌধুরী