লোকাচার মতে, দিনটা ছিল আর পাঁচটা ষষ্ঠীর মতোই। যেদিন সন্তানের মঙ্গলকামনায় মায়েরা ঘটা করে মা ষষ্ঠীর পুজো করতেন, ব্রত পালন করতেন। কোত্থেকে যেন এই জষ্ঠি মাসের ষষ্ঠীতে সন্তানের সঙ্গে জুড়ে গেলেন জামাইরা ও! আর ধীরে-ধীরে এই ষষ্ঠীর নামই পালটে গেল জামাই ষষ্ঠী তে।
জামাই ষষ্ঠী একেবারেই বাঙালি পার্বন। ওপার বাংলার সন্তান ষষ্ঠী এবার বাংলায় খুব বেশি করে জামাইদের খুশি করার পরব। তবে ধর্মীয় ভাবে এই দিনটি বেশি পালিত হয় অরণ্যষষ্ঠী হিসেবে। তবে মনে রাখতে হবে ষষ্ঠী দেবী শুধু বাঙালির পূজ্যা নন, তিনি সর্বভারতীয়।
ষষ্ঠীদেবী বা ষষ্ঠীঠাকুর হলেন বঙ্গীয় ও বহির বঙ্গীয় সনাতন (হিন্দু )ধর্মাবলম্বী এক পৌরাণিক দেবী। ইনি মূলতঃ সন্তানদাত্রী ও তাহার রক্ষাকর্ত্রী দেবী; তার কৃপায় নিঃসন্তান দম্পতিদের সন্তান লাভ হয় এবং তিনিই সন্তানের রক্ষাকর্ত্রী, পুরাণ মতে যেহেতু তিনি আদিপ্রকৃতির ষষ্ঠাঙ্গ অংশভুতা তাই তাহার নাম ষষ্ঠী দেবী । সম্পূর্ণ বঙ্গ ও ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ষষ্ঠী দেবীর নামে বহু কঠিনতঃ ও সরল দুই প্রকারেই ব্রত প্রচলিত আছে। বিহার সীমান্ত উত্তরপ্রদেশ কিছু অঞ্চল সম্পূর্ণ বিহার ও মিথিলাঞ্চলে এই ষষ্ঠীদেবী ও সূর্য্যদেবতারই উদ্দেশ্যে চৈত্র ও কার্তিক শুক্লা ষষ্ঠী তে ছট্-পূজা অনুষ্ঠিত হয়। সেইখানের লোক ভাষাতে দেবীকে ছঠী-মাই বলে সম্বোধিত করা হয়। এই ব্রত বিহার ও মিথিলাঞ্চলের গৃহস্থদের সবথেকে কঠিনতম ব্রতের মধ্যে অন্যতম।
যাই হোক অনেকই ভাবেন, জামাই ষষ্ঠী মানে শুধুই জামাই বাবাজিদের জন্য অনুষ্ঠান। আদতে কিন্তু তা নয়। শাস্ত্র মতে এই দিনটা মোটেই জামাইদের নয়। বরং বলা যেতে পারে বিবাহিত মহিলাদের কাছ থেকে এক প্রকার হাইজ্যাক করে এই দিনটিকে নিজেদের বানিয়ে ফেলেছেন জামাইয়েরা।
আগে এই দিনটিতে সন্তান লাভের আশায় বিবাহিত মহিলারা মা বিন্ধ্যবাসিনী স্কন্দ ষষ্ঠীর পুজো করতেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে শুরু হত উপোস। এরপরে পাঁচ ধরনের ফল, মিষ্টি এবং ১০৮ টা দুর্বাবাঁধা আঁটি নিবেদন করে হত পুজো। মাকে নিবেদন করা হত ধান এবং আমের পল্লবও। পুজো শেষে প্রসাদ খেয়ে উপোস ভাঙা হত। সেই প্রথা আজও আছে। জামাই ষষ্ঠীর দিন অনেকেই এই সব নিয়ম মেনে মা ষষ্ঠীর পুজো করে থাকেন। সঙ্গে সমান তালে চলে জামাই নিয়ে জামাই ষষ্ঠী উদযাপনও!
ষষ্ঠী পুজোয় জামাইরা ভাগ বসালেন কীভাবে?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ফিরে যেতে হবে সেই সময়ে, যখন মেয়েরা একা-একা বাড়ি থেকে বেরতেন না। বাপের বাড়ি যেতে গেলেও সেই নিয়মই প্রযোজ্য ছিল। ষষ্ঠীর দিন মেয়ের কল্যাণের আশায় তাকে পাখার বাতাস করবেন বলে মায়েরা উদগ্রীব হয়ে থাকতেন, তখন মেয়েদের সঙ্গে করে পৌঁছতে আসতেন জামাইরাই! প্রসঙ্গত, আরও অনেকরকম ষষ্ঠীব্রত বাংলায় আছে বটে, কিন্তু সেগুলি সন্তানের অসাক্ষাতেও পালন করা চলে। শুধু এই ষষ্ঠীতেই সন্তানকে পাখার হাওয়া দেওয়া নিয়ম। বোধ করি, দিনটি তৈরিই হয়েছিল হয়তো মেয়েরা যাতে আরও একটি বেশিদিন বাপের বাড়ি যাওয়ার সুযোগ পান, সেজন্যেই!
যাই হোক, মেয়েকে পৌঁছে দিতে স্বয়ং জামাইও যখন বাড়িতে আসছেন, তখন তাঁকে একটু আদর আপ্যায়ন না করলে চলে। তাই ষষ্ঠীর দিনে শাশুড়ি মায়েরা জামাইদের পাত পেড়ে খাওয়াতেন। তাতে মা-মেয়ে মিলে ষষ্ঠীর পুজো যেমন করতে পারতেন, তেমনই জামাইকে একটু তোষামোদ করারও সুযোগ মিলত। সেই থেকেই শুরু হল ষষ্ঠীর দিন জামাই আদর। এবার তা হলে বুঝতেই পারছেন কীভাবে সাধারণ স্বন্দ ষষ্ঠী বদলে গেল জামাই ষষ্ঠীতে!
জামাই ষষ্ঠী নিয়ে অবশ্য আর একটা গল্পেরও হদিশ মেলে। তখনকার দিনে মেয়েদের যতদিন না সন্তান হত, ততদিন নাকি তাঁর মুখ দেখতে পারতেন না বাবা-মায়েরা! ফলে অনেক সময় দীর্ঘদিন ধরে মেয়ের মুখ না দেখেই কাটাতে হত তাঁদের। তার সমাধানেই সমাজের বিধানদাতারা জৈষ্ঠ মাসের শুক্লা ষষ্ঠীকে বেছে নিলেন মা বিন্ধ্যবাসিনী স্কন্দ ষষ্ঠীর পুজোর দিন হিসেবে। যেদিন পুজো উপলক্ষে জামাই এবং মেয়েকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। যা পরবর্তী সময় শুধুমাত্র জামাই ষষ্ঠী হিসেবেই পরিচিতি পায়। আর এখন তো অনেকেই মা ষষ্ঠীর পুজো করেন না, কিন্তু তাঁরাও জামাই ষষ্ঠী পালন করেন বেশ ধুমধাম করে।
লোকাচার বিষয়ক গবেষকদের দাবি, আঠারো-উনিশ শতকে বাংলায় বাল্যবিবাহ এবং বহুবিবাহের ব্যাপক প্রচলন ছিল। বালবিধবা সমস্যা তখন মারাত্মক। এই অবস্থায় জামাই ও স্বামীর দীর্ঘ জীবনের প্রার্থনা বাঙালি মা এবং মেয়ের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আর তার থেকেই অরণ্য ষষ্ঠী হয়ে ওঠে জামাইকে আপ্যায়নের পরব।
বর্তমানে জামাই ষষ্ঠী মানে পাত পেড়ে খাওয়া। আর বাঙালি জামাই ষষ্ঠীর মেনু যেখানে খাদ্যরসিক, সেখানে শাশুড়ি মায়েরা পঞ্চব্যঞ্জনের আয়োজন করবেন না, তা কখনও হয়! এদিন মূলত দুপুরেই ভুরিভোজের আয়োজন করা হয়।
তথ্য ও ছবিঃ ইন্টারনেট