26/04/2024 : 9:27 PM
দৈনিক কবিতাসাহিত্য

কবিতাঃ মালাবদল

সুজান মিঠি

জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান

পান্তাভাতের অতীত নিয়ে ছেলেটা আমার কাছে দাঁড়িয়েছিল।
আমার শিফনের ফুরফুরে বাতাস খেতে খেতে
বলেছিল, “এই শাড়ির শরীরে একদিন ঠিক পূর্ণিমা
নেমে আসবে।”
তারপর বলেছিল, “আমি গরম রুটি খাবো ওই একদিন।”
তারপর ছেলেটার মাথায় কোঁকড়ানো চুলে
আমি হাত ডুবিয়ে উদাস হয়ে যেতাম।
কাঠবিড়ালি আমার হাতে খাবার খুঁজতে এসে
কিছু না পেয়ে ওর ছেঁড়া পকেটে মুখ দিয়ে
তুলে আনত সারা রাত্তির ধরে লেখা ওর
এক টুকরো কবিতা, যাকে ও ডিম ভাজা
কিংবা পোড়া ভাগ্যের মত না খেয়ে বাঁচিয়ে
রেখেছিল ঠিক।
আমি সর্বশক্তি দিয়ে কাঠবিড়ালির ঠোঁট থেকে
ছিনিয়ে নিতাম তা।
যত্ন করে গুছিয়ে ভরে দিতাম আবার
ওর হৃদয়ের কাছাকাছি।
ছেলেটা পাহাড়ি বনপথে হারিয়ে যেত।
ওর একলা কুঁড়ে ঘরের ছবি অস্পষ্ট হতো
আমার চোখে একটু একটু করে।
আমার বইয়ের পাতায় নেমে আসতো অমাবস্যা।

এরপর একদিন বনদপ্তরের উঁচু অফিসারের সঙ্গে
আমার বিয়ে দিয়ে দেয় আমার বাবা।
আমি আমার শিফনের শাড়িতে তন্নতন্ন করে
খুঁজেও চাঁদ কিংবা গরম রুটি পাইনি আর।

এখানে বনের ছোট নদীতে জল খায় হরিণ, ভেড়া, হাতি।
একদিন তাদের সঙ্গে এক ঘাটে অন্য শব্দ পেলাম হঠাৎ।
বেরিয়ে এসে পূর্ণিমার রাতে দেখি ঠিক আমার
সেই চেনা শব্দ। চেনা গন্ধ। পান্তা আর পেঁয়াজের গন্ধ।
কিন্তু পরনে সেই ছেঁড়া পকেট নেই। শক্ত লোহার
পোশাক যেন পেঁচিয়ে আছে তার শরীরে।
পিছন থেকে কোমরের কাছে উঁকি মারছে পিস্তল।
আমি চিৎকার করতেই সে ছুটে এসে আমার মুখ
চেপে ধরে। কানের কাছে আলতো ছুঁয়ে বলে,
“আমি তোমায় ভালোবাসি। এ ছাড়া উপায় কী ছিল
বলো।
বড্ড শক্ত ওই কবিতাগুলো। ঘা দগদগে।
ভাত নেই! ঘর নেই! আলো নেই!
ওদের জন্য আমি গাছ হয়েছি এখন।
ভাত,ঘর, আলোর গাছ।”

আমার শিফনে আলমারি ভর্তি হয়ে থাকতো সবসময়।
আমার স্বামী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করতো
“এত কিছু থাকতে কেন শুধুই শিফন?”
বলতো, “একটা বড় দাঁও মরবো কদিনেই
তোমায় একটা নতুন বেনারসি কিনে দেব সঙ্গে সাতনড়ি হার। একটা জঙ্গি সেঁধিয়েছে এই বনে
ধরতে পারলেই…
শোনো তুমি কিন্তু সাবধানে থেকো।”

আমি গরম রুটি আর পেঁয়াজ নিয়ে গেলাম
শিফনের আঁচলে।
পূর্ণিমায় জ্বলজ্বল করছে আকাশ মাটি বন।
দুটো একটা হরিণ এদিক ওদিক ছুটছে খুশিতে।
এই জঙ্গলে একটাও বাঘ সিংহ ভালুক নেই।
আমি পা টিপে টিপে ঘাস মাড়িয়ে
পৌঁছে গেলাম গাছের কোঠরের মত কুঠুরিতে।
আমার পান্তাভাতের অতীত ছেলেটি আমার
শিফনকে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে খুব চুমো খেল।
বললো “দেখো আজ কী ভীষণ স্নিগ্ধ আলো
খেলছে তোমার নীলে, তোমার শিফনে।”
রুটি আর পেঁয়াজে একটা কামড় দিতে গেল
নিশ্চিন্তে।
হঠাৎ চারিদিকে খুব জোরে জোরে সাইরেন
বেজে উঠলো। কত শত আওয়াজ
ঘিরে ফেললো কুঠুরি।
চিৎকার ভেসে এলো ‘সাবধান!’
শূন্যে দুমদাম গুলির শব্দে চিরে গেল আকাশ।
রুটির টুকরোয় জড়ানো পেঁয়াজ আমার হাত
থেকে খাবলে কেড়ে নিল আমার স্বামী।
“ও তুমি! শয়তান মেয়েছেলে! তলে তলে এই?”
তারপর আমি সর্বশক্তি দিয়ে আটকে রাখতে
চাইলাম রুটি আর পেঁয়াজের টুকরোটা।
প্রথম দুটো গুলি বিফল হলেও
তৃতীয়টা ওর বুক পকেটের পাশে যেইখানে
হৃদয় আছে, ও যেখানটা খুলে রেখেছিল
আমার আসার জন্য, সেইখানে গিয়ে লাগলো।
ওর লোহার পোশাক,  পিস্তল
সব মিশে ছিল আমার শিফনের
চাঁদে কিংবা গরম রুটির ধোঁয়ায়।
আমার হাত থেকে রুটির টুকরোটা ঝিনকে নিয়ে পাশ
দিয়ে চলে গেল একটা কাঠবিড়ালি,
জিতে যাওয়ার আনন্দে।
আমার স্বামী আমাকে টানতে টানতে নিয়ে এল
ঘাসের উপর দিয়ে।
আলমারি খুলে সব শিফনদের ছুঁড়ে দিল জঙ্গলে।
বললো, “এরপর তোমায় আমি শিফন দেব না পরতে।”

মাঝরাত্তিরে রান্নাঘরে চাকুম চুকুম পান্তা খাওয়ার
শব্দ পেলাম।
সায়া ব্লাউজ পরে গিয়ে দাঁড়াতেই আমার সারা গা
ঢেকে গেল নীল রঙের শিফনে।
শব্দটা বন্ধ হয়ে বাতাসে ভাসতে লাগলো খুশির গন্ধ।
জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে কেউ যেন বলে গেল
“দেখো তোমার শরীরে পূর্ণিমা নেমে এসেছে গো!
আমি কিন্তু রুটি চাইনা আর।
শুধু তুমি আমার কবিতা হয়ো কেমন?”

শাড়িটা পেঁচিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলতে ঝুলতে
দেখো ও ছেলেটা! কেমন দুলন্ত কবিতা হয়ে গেছি।
তোমার ঠোঁটে পুরে দিচ্ছি শব্দ। তুমি খাচ্ছ
আর আমার শিফনে রং ঢেলে ঢেলে গাঁথছ মালা।
মর্গে একসঙ্গে মালাবদল হবে যে কাল!

Related posts

গল্পঃ হলোধরের মাস্ক – অয়ন চক্রবর্ত্তী

E Zero Point

জিরো পয়েন্ট সাহিত্য আড্ডার নজরুল জয়ন্তী

E Zero Point

প্রকাশিত হলো উৎসর্গ পত্রিকার মোড়ক

E Zero Point

মতামত দিন