27/04/2024 : 3:45 AM
রবিবারের আড্ডাসাহিত্য

জিরো পয়েন্ট রবিবারের আড্ডা ~ সুপর্ণা সেনগুপ্ত | রতন নস্কর | ডঃ সায়ন ভট্টাচার্য | মুহাম্মদ ইসমাইল | আব্দুল হিল শেখ

গল্প


জীবন

✒ সুপর্ণা সেনগুপ্ত

মা,কাল তোমাকে মামার কাছে রেখে আসবো।এখন দুমাস ওখানে থাকো।এ বাড়িতে তুমি থাকলে বিপদ বাড়বে।

-তুই বললেই আমি যাবো।কক্ষোনো না।মরতে হলে এখানেই মরবো।নিজের বাড়ি ছেড়ে আমি এই বয়সে কোত্থাও যাবো না।
-এককথা আর ভালো লাগে না মা।তোমার এই জিদ এবার ছাড়ো।নিজের বাড়ি আবার কি।পৃথিবী ছেড়ে যাবার সময় নিজের বাড়ি আগলে থাকবে?
-সে যাই হোক।আমি এখানেই থাকবো।তাছাড়া  তোরা সবাই তো থাকবি।আমাকে কেন আলাদা থাকতে বলছিস।মুমুন,ঝুমুন ও তো রয়েছে।আর বৌমাকেও তো রোজ বেরোতে হবে।ওদের কে দেখবে।
-সে আমরা বুঝে নেব।
– ও। এখন ওরা একটু বড় হয়েছে তো।এখন তো আর মা না হলেও চলে।না,আমি এখানেই থাকব।তোর কথায় সব হবে নাকি। তোদের ঘরের দিকে আমি যাবো না। যাঃ।কেঁদে ফেলে নীলিমা দেবী।
– নির্বোধের মতো আর কথা বোলো না তো। ভালো লাগে না।এতো অবুঝ মানুষকে নিয়ে তো পারা যাবে না।তুমি কি চিরকাল একরকম ই থাকবে। শোন,আমরা কখন কোথায় থাকবো ঠিক নেই।
-সেই জন্য তো আমি আরো থাকবো।বাচ্চা দুটো কোথায় থাকবে? তোকে,বৌমাকে কে দেখবে।?
-সে একটা হবে ।আমি মামাকে বলে দিয়েছি।গাড়ি নিয়ে আসবে।তুমি রেডি হয়ে থেকো।আর আশা মাসি থাকবে এ কদিন ।তোমার বৌমা কথা বলেছে।-
-ও তোরা সব ঠিক করে রেখেছিস।সব pre planned. আমাকে তাড়ানোর জন্য ।আর লোককে দেখাবি -মায়ের কথা কতো ভাবিস।মাকে কতো ভালোবাসিস।
– আচ্ছা মা। তুমি কি চিরকালই এরকম ছেলেমানুষী করবে।।
-হ্যাঁ করবো।তোর বৌমার সঙ্গে কথা হয়ে গেছে।আশাকে আগের থেকে ঠিক করে রেখেছিস মুমুন ঝুমুনের জন্য।  আর মন্টুকে বলেছিস  আমাকে নিয়ে যেতে।অথচ আমায় কিছু বলিস নি।আমি কি মানুষ না।এ বাড়ির কেউ না।আমি তবে তোদের বোঝা? চলে যাবো।একেবারে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেই তোদের ভালো।
-শোন মা।এখন এসবের সময় নেই আমাদের।তুমি ভালো করেই সব জানো।কোন কিছুই আগে  থেকে ঠিক হয়নি ।। এখনই ভাবছি।  তোমার বৌমা বলছিল – নইলে পরে হয়তো আফসোস করতে হবে মায়ের জন্য।আমিও ভেবে দেখলাম ঠিকই । সারা জীবন যা ইচ্ছা করেছো ।নিজের মতে চলেছো।এখন অন্তত কটা দিন একটু শোন।
-না ।আমি শুনবো না।কখনোই যাবো না।হোক আমার অসুখ।কি হবে ।মরবো তো। তোদের ভালো হবে।আমার বাড়ি।আমি এখানেই থাকবো।
– উফ।যা ভালো বোঝ করো। রোজ অশান্তি ভালো লাগে না তোমার সাথে। একটা কথা বলে দিলাম তোমার lungs এর যা অবস্হা এ রোগ হলে আর কেউ  তোমাকে বাঁচাতে পারবেনা ।আর জানো তো এখন ভেন্টিলেশানের   যা অবস্থা– হসপিটালের যা অবস্হা -ventilation aquared Pneumonia কথা তো বাদই দিলাম।
-আমায় ভয় দেখাস না বাবু। আমি কোথাও যাবো না তোদের ছেড়ে।যা হবার হবে।
সুমন গটগট করে বেড়িয়ে যায়।যা বোঝ করো।
-এমনিতে  টেনশনে মাথাটা জ্যাম হয় আছে।ভবিষ্যৎ কিছু জানা নেই।একই প্রফেশনে বিয়ে করা একদম ঠিক না।আজ সুদীপাও যদি  ডক্টর না হতো তবু বাড়িটা সামলাতে পারতো।ন্যাশানাল ডিজাষ্টার আক্ট চালু হয়ে গেছে।কোন health profession বিশেষত ডক্টররা চাকরী ছাড়তে চাইলেও অপারগ। এমনকি অসুস্হতা থাকলেও যেতেই হবে।দেখতে দেখতে পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে সুমনের।আজ্মা টা বংশগত।আজমা তো না COPD-Cronic Obstactive Pulmonary Disease….দিদা,মা,এখন সে।husband wife দুজনে ওরা ICU ডক্টর।কিছু  করার নেই। মুমুন ঝুমুনের যে কি হবে।ওদের কে দেখবে কিছু হলে।আর ভাবতে পারে না সুমন।সুদীপা কাল অনেক চেষ্টা করেছে।Higher official এ অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছে ওদের অবস্থাটা।না।সবই বেকার
একটাই কথা- আপনারা এখন সৈনিক।যুদ্ধে যেতেই হবে।রাষ্ট্রের প্রয়োজন আপনাদের। কিন্তু ডাক্তারী পড়ার সময় সেবাই ধর্ম-শপথ নিতে হয়েছিল বটে। তবে  প্রাণদানের  মতো স্বার্থত্যাগের তো অঙ্গীকার ছিল না।।ছোট্ট সুখী পরিবারটা।কদিনের মধ্যে যেন সব উলোট পালট হয়ে গেল। এই হয়তো সবে শুরু।কতদূর হাঁটতে হবে,কতদিন-হিসেব নেই। এরই মধ্যে গাড়ি ঢুকলো জেলা সদর হাসপাতালের দরজা দিয়ে।ইতি উতি ভিড়। I CU  সামনে একটা জটলা। রোজকার ব্যপার। এখন লকডাউন বলে একটু কম। আজকাল সুমনের নিজেকে কেমন একটা যন্ত্র যণ্ত্র লাগে।যেন দম দেওয়া আছে ।শুধু চলছে আর চলছে  । সুমন      তাড়াতাড়ি dressচেঞ্চ করে নেয়। Hand over  বুঝে নিয়ে ছেড়ে দিতে হবে সম্রাট কে।বেচারা বাচ্চা ছেলে।খুব ভয় পেয়েছে Covid নিয়ে।টানা 12 ঘন্টা ডবল ডিউটি করছে।
বাড়ি যাবো দাদা।মা ভীষন কান্নাকাটি করছে।একটু যাই । দেখা করে আসি।
যাও ,যাও।কে বলতে পারে-কি জানি ক ঘন্টা পাবো এ জীবনটা। খানিকটা হেসে একটু হালকা হওয়ার চেষ্টা করলো দুজনেই।
সুমন তাড়াতাড়ি ওকে রিলিস করে দিল।
সন্ধ্যের দিকে  ইমারজেন্সি থেকে ফোন এলো।একজন পেশেন্ট এসেছে।ক্রিটিকাল ।অক্সিজেন সেচুরেশান বেশ কম।খুব শ্বাস কষ্ট হচ্ছে।
সুমন বললো-কিন্তু এখন তো রেসপিরেটরি প্রবলেম থাকলে আগে আইসোলেশানে নিয়ে গিয়ে সোয়াব টেষ্ট করতে হবে।এভাবে direct IC U তে নেব কি করে।
কিছু করার নেই সুমনদা।সুপার বলেছেন।catch patient।টেস্ট পরে হবে ।আগে ventilate করতে হবে।
তাই বললে কি হয় নাকি।তোমরা protocal follow করবে না?
কিছু শোনার আগেই পেশেন্ট ঢুকে গেল। একজন বয়স্ক মহিলা।ভীষন respuratory distress..সুমন বললো  একটা ABG করুন দিদি ,তাড়াতাড়ি।যা ভেবেছে তাই।ব্লাডে কার্বনডাই অক্সাইড প্রায় 60 এর কাছাকাছি।
এক্ষুনি বাইপ্যাপ দেওয়া উচিত।সুমনের নাকে এখন শুধু একটা সারজিক্যাল মাস্ক,পরনে ICU সাধারণ এপ্রণ। এই অবস্থায় যদি patient covid পজিটিভ হয়ে থাকে তবে কিছুই করার নেই।infection থেকে কেউ আটকাতে পারবে না তাকে।মুমুন ঝুমুনের মুখগুলো ভেসে উঠলো।বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা আঙ্গুল নেড়ে নেড়ে ডাকছেন।chest x ray report টাও এখোনো এলো না।TROP T এখোনো নেগেটিভ। তবে ইকো দেখে মনে হচ্ছে একটা silent MI হয়ে গেছে।
সুমন  ভদ্রমহিলাকে বললেন -কষ্ট হচ্ছে মা খুব।দাঁড়ান কমে যাবে।বৃদ্ধা প্রায় অজ্ঞান ।সুমন ঠিক করলো patient party কে ডেকে বলেই দেবে ventilate করেও লাভ হবে না।   বাইরে বেড়িয়ে  দেখলো এক বয়স্ক ভদ্রলোক।
‘- আরে স্যার আপনি?
– বাবা।চিনতে পেরেছ তাহলে।
-অর্ণব নীচু হতে যায়-
-আরে এখন ওসব নয়।আমার wifeকে বাঁচাও বাবা। তুমি তো জানো ও ছাড়া তোমাদের এই বুড়ো মাষ্টার মশাইয়ের  আর  কেউ নেই।
-কিন্তু স্যার।ওনাকে তো ventilate করা ছাড়া উপায় নেই।মনে হচ্ছে ম্যসিভ আটাক।ওনার কি ডায়বেটিস আছে?
-হা।সে অনেক বছর।কাল থেকে বলছিল একটু শরীরটা ম্যাজম্যাজ।আর কিছুই না,তেমন।
বৃদ্ধ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন নিরুওর।তারপর বললেন 1/ও কি চান্স নেই বাবা।
অর্ণব ডাক্তার।এই শিক্ষকই ছিল তার ডাক্তার হবার প্রধান inspiration.মিথ্যা সে বলবে কি করে।
-সে রকম করে কিছু নিশ্চিত বলা যায় না স্যার।
-শোন ।যদি 1/ ও চান্স থাকে তবে  ventilate করো
অর্ণব আর এ পরিস্থিতে করোনার সংক্রামনের সম্ভবনা,কথা বলে উঠতে পারলো না।
বলতেই পারলো না নিজদের সংক্রামনের সম্ভাবনা। Ventilate করতে গিয়ে রোগীর মুখের কাছে গিয়ে tube পড়ানো এখন কতোটা risky,কোন PPE ছাড়া।
সুমন এগিয়ে গেল বেডের দিকে। সামনে যেন হঠাৎ ভেসে উঠলো মায়ের মুখটা । সেই কোঁচকানো মুখ,ভাঙা সামনের ফোকলা দাঁত। চোখে তলায় ক্লান্তির ছাপ ।  আর কিছু না ভেবে  সুমন হাতে পড়ে নিল গ্লাভস।তারপর ডাক দিল সিস্টারের দিকে চেয়ে-গৌরীদি ,রেডি করুন।patient কে ventilate করব এখনই।♥


রবিবারের আড্ডায় লেখা পাঠাতে হলে zeropointpublication@gmail.com

ইমেইল এড্রেসে টাইপ করে পাঠান। অবশ্যই লেখাটি অপ্রকাশিত হতে হবে।
পাঠকের মতামত লেখক ও প্রকাশকের পাথেয়,
তাই অবশ্যই নীচের কমেন্ট বক্সে মন্তব্য করুন ও শেয়ার করুন

Related posts

ছোটগল্পঃ একাকী

E Zero Point

প্রকাশিত হলো রস-সাহিত্যিক ‘কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়’ স্মারক সংখ্যা

E Zero Point

জিরো পয়েন্ট রবিবারের আড্ডা ~ অগ্নিমিত্র ( ডঃ সায়ন ভট্টাচার্য) | আঞ্জু মনোয়ারা আনসারী | স্বাতী মুখার্জী | মোঃ ইজাজ আহামে | নির্মলেন্দু কুণ্ডুদ

E Zero Point

মতামত দিন