28/03/2024 : 7:13 PM
আমার দেশব্যবসা বণিজ্যরাজনৈতিক

সস্তা চীনা পণ্যের রহস্য এবং ভারতের স্বদেশী শিল্পের বিপর্যয়  

সস্তা চীনা পণ্যের রহস্য এক নজরে-
♦ উৎপাদনের বিশাল পরিমাণ
♦ সস্তা শ্রম
♦ ‘হস্তশিল্পে’ স্বল্প হাত
♦ চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা
♦ চীনা ডাম্পিং নীতি  ও অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য বিস্তার
পার্থসারথি তাপস

আমাদের দেশে চীনা জিনিসের জনপ্রিয়তার একটা বড় কারণ হচ্ছে চীনা জিনিসের অপেক্ষাকৃত কম দাম। শুধু আমাদের দেশে কেন, গোটা পৃথিবীতেই তাই। এই সস্তা পণ্য বিক্রী করে গোটা পৃথিবীর বাজার দখল করেছে চীন। অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শস্তায় পণ্য ডাম্পিং করে সেই দেশের দেশীয় শিল্পের শ্বাসরোধ করে দিয়েছে চীন, এমনকি উন্নত দেশগুলোও চীনের এই কৌশলী বাজার দখলের নীতি থেকে রেহাই পায় নি।

চীনের এই বিদেশী বাজার দখলের কৌশলকে বিশ্লেষণ করতে গেলে প্রথমেই যে প্রশ্নটা সবার মনে উঁকি দেয় তা হল, চীন কীভাবে এত সস্তায় জিনিস বিক্রী করে, যেটা প্রথম বিশ্বের অনেক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নত দেশও পারে না?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে প্রথমেই যে উত্তর অনেকে দেন তা হল- সস্তা শ্রম। হ্যাঁ, সস্তা শ্রম অবশ্যই একটা কারণ। কিন্তু সস্তা শ্রম কোনো জিনিসের উৎপাদন খরচের ২০% মাত্র। তাহলে নিশ্চয়ই এর পিছনে আরও একাধিক কারণ রয়েছে। সেগুলি আমরা একে একে দেখব।

১)  উৎপাদনের বিশাল পরিমাণঃ সব থেকে প্রথমেই যেটা বলতে হয়, সেটা হল চীন যে জিনিসগুলি উৎপাদন করে তার  ভলিউম রাখে বিশাল পরিমাণে। সুতরাং এগুলি প্রস্তুত করার জন্য কাঁচামালও কেনে প্রচুর পরিমাণে। ফলে যতটা শস্তা সম্ভব ততটাই শস্তা হয় কাঁচামালের ক্রয়মূল্য। এরপর উৎপাদনের পরিমাণ অনেক বেশি হওয়াতে উৎপাদন খরচও কম হয়। না, এতে কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। নেইও।

২) সস্তা শ্রমঃ  চীনে জনসংখ্যা আমাদের দেশের মতোই বিপুল। এবং এই জনসংখ্যার মধ্যে দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। এই দরিদ্র মানুষেরাই চীনের সস্তা শ্রমের মূল উৎস। চীনে একটি শ্রমিক ইউনিয়ন আছে যার নাম এ.সি.এফ.টি.ইউ (ACFTU- All-China Federation of Trade Unions)। দাবী অনুযায়ী এই ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি। এই ইউনিয়নটির আবার নিয়ন্ত্রক সেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টি যে আবার চীনের সরকার চালায়। কাজেই শ্রমের মজুরি নিয়ে সরকারের সাথে  শ্রমিকের দরাদরি করার সুযোগ অত্যন্ত কম। সস্তায় মাল উৎপাদন করে বিশ্বের বাজার দখলের জন্য যে মজুরী কমিউনিস্ট পার্টি অফ চায়নার সরকার ধার্য্য করে দেবে বিনা বাক্য ব্যয়ে সেই মজুরী মেনে নিতে শ্রমিক ইউনিয়ন তথা সাধারণ শ্রমিক বাধ্য।

এত কিছুর পরেও কিন্তু অত্যন্ত দারিদ্র এবং কষ্টের মধ্যে থাকা শ্রমিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সরকারের বিরুদ্ধে প্রতি সপ্তাহেই অজস্র বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত করছেন। এর ফলে সামান্য কিছুটা মজুরী বেড়েছে গত চার বছরে। কিন্তু এতদ সত্বেও যে দেশ নিজেকে এক উন্নত সুপার পাওয়ার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় পৃথিবীর বুকে সেই কমিউনিস্ট দেশের শ্রমিকের মজুরী অন্যান্য তথাকথিত পুঁজীবাদী দেশ যেমন আমেরিকার তুলনায় অত্যন্ত কম। আপনার কানে যতই  অদ্ভুত শোনাক, বাস্তব এটাই। শ্রমিকের ঘাম রক্ত শুষেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টি বিশ্ব জুড়ে নয়া আর্থিক সাম্রাজ্য বিস্তারের খেলায় নেমেছে।

৩) ‘হস্তশিল্পে’ স্বল্প হাতঃ কিছু মেশিনের ব্যবহার যেগুলি দ্বারা নির্মীত পণ্য মনে হয় হাতে তৈরি উচ্চশ্রম নির্ভর খেলনা, কিন্তু তা বাস্তবে অত্যন্ত কম শ্রমিক নিয়োগ করে বাকিটা অতি দ্রুতগতিতে চলা মেশিনে তৈরি। বেশিরভাগ সফট টয়েজ এইভাবেই তৈরি করে চীনারা।

৪) স্বাস্থ্য, সুরক্ষা পরিবেশে কম ব্যয়ঃ চীনে স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশগত নিয়মকানুনের জন্য ব্যয় অত্যন্ত কম। চীনের বর্তমান আর্থনৈতিক প্রতিযোগী আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে, এই ব্যয়গুলি চীনে অনেকটাই কম।  অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় কমিউনিস্ট চীনা সরকার স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা বা পরিবেশের নিয়মনীতি খুব কম লাগু করেছে। বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে জানতে পারা যাচ্ছে, যদিও চীনের নিজস্ব পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা রয়েছে, তবু পরিবেশ সুরক্ষা আইনগুলি সাধারণত ওখানে উপেক্ষা করা হয় বা প্রয়োগই করা হয় না, বিশেষত স্থানীয় পর্যায়ে। শুধু তাই নয়, চীন তাদের কর্মীদের ক্ষতিপূরণ বীমা সরবরাহ করে না, তাই চাকরিতে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা যখন অক্ষম হয়ে পড়েন বা আহত হন তখন তাঁরা কোনওপ্রকার ক্ষতিপূরণ পান না। নীট ফল, স্বাস্থ্য, সুরক্ষা পরিবেশ সংরক্ষণ বাবদ চীনা কোম্পানির খরচ কম।

৫) চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যাঃ বাজাজ অটো লিমিটেডের জয়েন্ট ম্যানেজিং ডিরেক্টর রাজীবনয়ন আর বাজাজ ২০০৫ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ উল্লেখ করেছেন । তিনি বলেন, চীন তাদের পণ্যের এত  প্রতিযোগিতামূলক দাম ধার্য্য করতে পারে কারণ এটি কিছু নির্দিষ্ট ব্যয় যেমন পণ্যের ইনোভেশন বা উদ্ভাবনের জন্য, গ্রাহকের চাহিদা বোঝার জন্য বা বারে বারে ভুল করার মাধ্যমে শেখার জন্য ব্যয় করে না। এর উপরে চীনে আইপিআর (মেধা সম্পত্তি অধিকার)অনুপস্থিত হওয়ার কারণে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার তৈরি পণ্য দ্রুত এবং সহজেই কপি করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্ববিখ্যাত হোন্ডা সংস্থা অনেক গবেষণা, মেহনত ও খরচ করে যখন বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে একটি পণ্য লঞ্চ করে, চীন বিন্দুমাত্র দেরি না করে সেটির কপি বানিয়ে ফেলে। এছাড়াও কথা খাতায় কলমে ঘোষণার চেয়ে বেশি পরিমাণ উৎপাদন করে চোরাপথে ট্যাক্স বাঁচায় চাইনিজ কোম্পানিগুলি।

৬) রপ্তানিকে কর ছাড়ের সুবিধাঃ  এর পরে, কর এবং শুল্ক রয়েছে। চীনে কিছু পণ্যের জন্য ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স বা ভ্যাটের হার সাধারণত ১৭% , কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে তা ১৩% । এবারে চীনা সংস্থাগুলি রফতানির জন্য উৎপাদিত পণ্যের উপকরণের জন্য সরকারের কাছ থেকে ভ্যাট ফেরত পায়। অর্থাৎ, কর ছাড়া রপ্তানি করো, আর মুনাফার টাকা ঘরে ঢোকাও। আরও মজার ব্যপার হল, চীনে আমেরিকান আমদানিতে ভ্যাট যুক্ত করা হয়, কিন্তু  চীনা পণ্য আমদানিতে আমেরিকায় কোনো ভ্যাট নেই। যাকে বলে সোনায় সোহাগা।

৭) শুল্ক ছাড়ের অসম সুবিধাঃ একটা উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে সুবিধা ভোগ করায়, আমেরিকার মতো কিছু দেশের সঙ্গে ভারসাম্যহীন শুল্ক ব্যবস্থা রয়েছে চীনের। যেমন আমেরিকাতে একটি চীনা গাড়িতে ২.৫% শুল্ক ধার্য্য করা হয়, যেখানে চীনে আসা বিদেশী গাড়ির জন্য ২৫% শুল্ক ধার্য্য করে চীন।

২০১৭ সালের জুলাই মাসে কেন্দ্রীয় এমএসএমই দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী হরিভাই পার্থিভাই চৌধুরী সংসদে একটি প্রশ্নের উত্তরে ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, চীনা পণ্য আমাদের দেশের পণ্যের তুলনায় সস্তা হওয়ার কারণ চীনের অস্বচ্ছ ভর্তুকি ব্যবস্থা এবং দাম নির্ধারণের বিকৃত ধরণ।

চীন একটি অদ্ভুত স্বার্থপর বাণিজ্যনীতি নিয়ে চলে, যাতে রপ্তানিতে প্রচুর উৎসাহ জোগায়, আমদানি ভীষণভাবে নিরুৎসাহীত করা হয় এবং  মুদ্রা ব্যবস্থাকে ভীষণভাবে  নিয়ন্ত্রিত করা হয়।

চীনা মুদ্রার কৃত্রিম অবমূল্যায়ণঃ  সর্বোপরি, বিশেষজ্ঞদের মতানুযায়ী, চীন তাদের মুদ্রা ইউয়ান-এর দর কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তাদের মুদ্রার দাম স্বাভাবিক ভাবে যা হওয়ার কথা তার থেকে ডলারের তুলনায় আনুমানিক ৩০% থেকে ৪০% পর্যন্ত অবমূল্যায়ন করে রাখে। এই কৃত্রিম অবমূল্যায়ণের খেলা চীন নিজের দেশের সংস্থাকে কোনও সম্ভাব্য আমেরিকান বা অন্য দেশের  প্রতিযোগীর তুলনায় এমনিতেই ৩০% থেকে ৪০%  কম দামে পণ্য সরবরাহ করতে সক্ষম করে তোলে।

চীনা ডাম্পিং নীতি  ও অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য বিস্তারঃ  সবশেষে যেটা উল্লেখ না করলেই নয়, চীনের অন্য দেশের বাজারকে সস্তা মালে ভরিয়ে সে দেশের স্বদেশী শিল্পকে পঙ্গু এমনকি পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য একটি জাতীয় নীতি রয়েছে। “ডাম্পিং”। “ডাম্পিং” তাকেই বলা হয় যখন কোনো একটি দেশের ম্যানুফ্যাকচারার বা উৎপাদক তার নিজের দেশে সেই পণ্যের যা দাম তার থেকেও কম দরে অন্য কোনো দেশে বিক্রী করে। এমনকি উৎপাদক সংস্থাটি কোনো কোনো ক্ষেত্রে পণ্যটির দাম রপ্তানিকৃত দেশের বাজারে পণ্যটির প্রকৃত উৎপাদন ব্যয়ের থেকেও কম দরে বিক্রী করে দেয়। “ডাম্পিং”-এর লক্ষ্য হ’ল বিদেশের বাজার দখল করা বা কোনও একটি নির্দিষ্ট পণ্য বা একাধিক পণ্যের জন্য বিদেশী বাজারের প্রতিযোগিতাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা।  এর সাহয্যে গ্রাহকের কাছে চীনা পণ্যের দাম আমদানি করা দেশটির বাজারের অন্যান্য স্বদেশী সংস্থার থেকে অনেকখানি নীচে, এমনকি শুনলে আশ্চর্য হবেন প্রায়শই চীনা কোম্পানিটির নিজের উৎপাদন ব্যয়েরও নীচে নামানো হয়। বাজার ধরার এই কৌশলের সাহায্যে “ডাম্পিং”-এর টার্গেট দেশটির স্বদেশী শিল্প সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেলে সেই দেশের ক্রেতাসাধারণকে চীনা পণ্যের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল বানানোর পর জিনিসের দাম বাড়িয়ে মুনাফা লোটার এক অভূতপুর্ব কৌশল নিয়ে চলে চীনারা।

ভারতে অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে, ২০১৮ সালে বাণিজ্য বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটি সরকারকে দেওয়া একটি রিপোর্টে খোলাখুলি জানায়, ভারতীয় অর্থনীতির চাকাকে রুদ্ধ করেছে চীনা পণ্যের আমদানি। শুধু তাই নয়, ভারতের সঙ্গে যে সমস্ত দেশের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি আছে তাদের বাজারে ঘুর পথে চীনা পণ্য রপ্তানি করে ভারতের রপ্তানির রাস্তা বন্ধ করছে চীন। পার্লামেন্টারি কমিটিটি রিপোর্টে আরও জানায় যে ভারতের মানুষ স্বদেশী পণ্য কিনতে উৎসাহিত না হলে স্বদেশী শিল্পকে বাঁচানো সম্ভব নয়।

সুতরাং, WTOর অন্তর্ভুক্ত এবং GATT চুক্তির মুক্তবাণিজ্যনীতির স্বাক্ষরকারী ভারতের মতো   চীনাপণ্য আমদানিকারী দেশের মানুষ যদি সস্তা চীনা জিনিসের মোহে স্বদেশী পণ্যকে দূরে রাখে এবং সরকার যদি চীনের  চালাকি ও অপকৌশলী বানীজ্যনীতি রোখার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা না নেয়, তবে সস্তা পণ্যের আড়ালে ডাম্পিং এর দ্বারা চীনের নয়া আর্থিক সাম্রাজ্যবাদ স্থাপনের মাধ্যমে আমাদের দেশের শিল্প এবং অর্থনীতির ধ্বংসকে রোখা সম্ভব নয়।

 

তথ্যসূত্রঃ

১) https://www.economist.com/china/2017/08/17/chinas-labour-law-is-no-use-to-those-who-need-it-most

২) https://timesofindia.indiatimes.com/business/india-business/why-chinese-goods-are-cheaper-than-indian-goods/articleshow/59849828.cms

৩) https://www.rediff.com/money/2005/oct/20bspec.htm

৪) https://www.forbes.com/sites/kenrapoza/2018/08/03/trade-war-update-is-china-dumping-products-in-india/#68a228987332

৫) https://www.business-standard.com/article/economy-policy/how-chinese-goods-are-choking-indian-industry-and-economy-the-hard-numbers-118072800622_1.html?fbclid=IwAR2vizBIandhm7SfnQL7Gsj3hootn0FAWgdaknseGT9JeKxJyduj-lKiJTg

 

 

Related posts

করোনার জেরে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের জন্য সকলকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে

E Zero Point

মিউকোরমাইকোসিসের চিকিৎসার জন্য ওষুধ যাতে পাওয়া যায় সরকার তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে

E Zero Point

৮ ডিসেম্বর ভারত বনধঃ ভারত দেখতে চায়, অন্নদাতার পক্ষে কে ?

E Zero Point

মতামত দিন