জিরো পয়েন্ট প্রতিবেদন
অতনু প্রজ্ঞান
সিপিএমের হারে বহু লোকজন পলিটব্যুরোর ওপরে ক্ষেপে গেছে। ক্ষেপারই কথা। চিরশত্রু কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাধা কোনো সৎ বাম আদর্শের মানুষ মেনে নিতে পারবেনা। এটা ধান্ধাবাজী। আব্বাসের মতো উগ্র ধার্মিক মানুষের হাত ধরাটা আরেকটা বিরক্তিকর সিদ্ধান্ত। ভোটের রেজাল্টই বলে দিচ্ছে এসব সুবিধেবাদের পরিণতি। একা লড়াই তো ভালো ছিল। লড়াই এর আদর্শটা অন্তত থাকত।
ভুলগুলো মেনে নিন কমরেড। ভুল স্বীকার করাটাই নতুন করে লড়াইয়ের পাথেয়। পলিশড শিক্ষিত হাসিহাসি মুখে মিডিয়ায় বসে বাম আমলের সবই ভালো ছিল, এগুলো শুনতে হাস্যকর লাগে। খোলামেলা সৎ হলেই বরং অনেক বেশি গ্রহনযোগ্য হয়। হারাবার তো কিছুই নেই আর।
এদিকে সিপিএম হেরে গেছে বলে বহু বাম মনস্করা আশাহত হয়ে বলছেন সব “সোশাল সার্ভিস” বন্ধ করে দাও। যারা গত একবছর ধরে করোণার ভয়ে বাড়িতে না থেকে রাস্তায় নেমে খাটছেন, রিটার্ণে মানুষের এই তীব্র রিজেকশনে তাদের গায়ে লাগাটাই স্বাভাবিক। তাদের বয়সও বেশি নয়। কিছু শিল্প সংস্কৃতি জগতের মানুষও তাদের পাশে আছে। বাম আদর্শটাকে ভালোবাসে। তারা চায় বাম একটু একটু করে শাসনে ফিরুক। খুব বোকা রকমের আদর্শবাদী না হলে বামেদের হয়ে কেউ কাজ করবেনা এইমূহূর্তে।
যেখানে দলবদলের হিড়িক চলে, টাকাতেই বিক্রি হয়ে যায় সিট, সেখানে তৃনমূলে শিফট হয়ে বা আরেকধাপ এগিয়ে বিজেপিতে গেলেই লাইফের পার্থিব অনেক কিছুই আদায় করা যেত, বেকার ছেলেটার চাকরির সুরাহা হতে পারত, ক্লাব করলে দুলাখ টাকার ভাগ পেত, বাম ছাপের জন্য টলি পাড়ার অনেকেই সরকারি রোষের শিকার হতো না, তবে কেন বোকামিটা করছে তারা? ওই যে আদর্শ নামক একটা কুটকুটানি আছে! সব দলেই এমন বোকা লোকেরা থাকে, যারা বিপদের সময়েও দলেই থাকে, শুধু “কামাবার” জন্য লাভ খোঁজেনা। সবাই রুদ্রমীল হয়না।
এরা নিজেদের নাটকের দলের ছেলে মেয়েদের নিয়ে গ্যাঁটের কড়ি খরচা করে প্রচার করেছে ভোটের আগে। গান বেঁধেছে। লেখালেখি করেছে। আবার, সোজা অঙ্কে বিশ্বাস করেছিল যে মানুষের জন্য খাটলে মানুষ তাদের ভোট দেবে। এই প্রত্যাশাটা নিয়ে কোনো লজ্জা বা কুন্ঠা থাকার কথা নয়। কিন্তু ভন্ডামিও করাটা একেবারেই অনুচিত। পার্টির ওপরে ভরসা ফিরিয়ে আসতে কেউ যদি করোণাকে ভয় না পেয়ে রাত বিরেতে মানুষের পাশে দৌড়ে যায়, গরীব মানুষকে খাওয়াতে পারে লকডাউনে, সেটাও অনেক বড় কাজ। কিন্ত তার জন্য বার বার আমরা ৭% তাও মানুষের পাশেই থাকি, আমরা এমনি এমনি “সেবা” করছি, এইটা বোকা বোকা লাগছে, এগুলো বলা বন্ধ করুন প্লিজ।
আরেকটা ব্যাপার, গত একবছরে খারাপ লেগেছে সিপিএম ও লিবেরালদের মতানৈক্য। বাম মনস্করা এই বিশ্বে এমনিতেই সংখ্যালঘু। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ যেখানে ভোগবাদ, অন্য মানুষকে শোষন করে নিজে রসে বশে থাকার কালচারে দৌড়চ্ছে মানুষের স্বাভাবিক প্রবনতা মেনেই, সেখানে যারা অন্যের অধিকারের জন্য ভাবছে, ক্যাপিটালিস্টিক সিস্টেমের ফাঁকগুলো নিয়ে ভাবছে, অনায্য কিছু দেখলে প্রতিবাদ করছে তাদের প্রতি শাসক কোনোদিনই সুনজরে দেখবেনা। কিন্তু বামেদের মধ্যেও এত দ্বন্দ কেন?
লিবেরালরা আজ কেন অভিমান করেছেন? কেন তৃনমূলের দিকে ঝুঁকেছে? নকশালরা কেন আজ আলাদা? এই উত্তরগুলো খুঁজতেই হবে বামেদের।
বাম মানে শুধু সিপিএম নয়। বাম মানে একটি মনন। সিপিএমের সমালোচনা করলেই দেখলাম তাদের শিক্ষিত তরুণেরা রে রে করে তেড়ে আসছে। লাইভ করে লিবেরালদের নিন্দে করছে। মিম হিসেবে এগুলো ঠিক আছে ইয়ার্কিচ্ছলে, কিন্তু এগুলোকে সিরিয়াসলি ভাবলে তো পলিটব্যুরোরে যে ভুল ভ্রান্তি গুলো হয়েছিল সেই একই মানসিকতা ট্র্যান্সফার হবে নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বেও। কম বয়েস অথচ পলি”বুড়োমি”!! সে বড় সাংঘাতিক। এসব কিন্তু চলবেনা আগামীতে। ঘোষিত সিপিএম না হলে বিশুদ্ধ বাম নয় এমন বালখিল্য মানসিকতা ছাড়তেই হবে। সমস্ত সোশালিস্টিক মননের দলগুলোকে ইন্টিগ্রেটেড হতেই এই অসম লড়াইয়ে। সেটা খুব কঠিন, কিন্তু সেইটাই বিপ্লব। নাহলে গনসঙ্গীত গেয়ে বা বিপ্লবের কথা মুখে বলে কিছু হবে না।
ভুল পর্যালোচনা করুন কমরেড, মেনে নিতে শিখুন, এটা আপনাদের একটা দুর্বলতা। ভুল স্বীকার করাটাই লড়াই এর শুরু। … যেন তেমন প্রকারেণ ক্ষমতা দখলই সব নয়। ক্ষমতার স্বাদ ৩৪ বছর তো পেয়েই গেছিলেন। তখন অনেক সঠিক কাজ করেছেন, আবার অনেক ভুল ভ্রান্তিও করেছেন। সেসব মেনে নিন কমরেড। আবার ক্ষমতা পাওয়ার জন্য তিল তিল করে নিজেদের উপযুক্ত করাটাই তো আসল জার্ণি। মানুষের পাশে ভনিতা হীন ভাবে দাঁড়ান, উচ্চশিক্ষার, সংস্কৃতির অহঙ্কার ছেড়ে দিয়ে দাঁড়ান, তাত্ত্বিক কচকচি ছুঁড়ে ফেলে মানুষের পাশে দাঁড়ান। মানুষ বড় অসহায়, শুধু নিজেরটাই বোঝে। যদি সে দেখে আপনি শ্রমিক, কৃষক, কর্মচারী, উদ্যোগপতি সবার অধিকারের পাশেই আছেন, মানুষের ন্যায্য অধিকারের জন্য লড়াই করতে চাইছেন, মানুষ বুঝবেই, মানুষ কারো লয়াল নয় পারমানেন্টলি।
ভেঙে পড়লে চলবেনা কমরেড। নতুন করে আবার শুরু হোক পথ চলা…