শ্রীমন্ত ঘোষ
(শিক্ষক ও সামাজিক চিন্তাবিদ্, পূর্ব বর্ধমান)
শিক্ষাটা আজও আমাদের দেশে ঐচ্ছিক, আবশ্যিক নয়। আর নয় বলেই, সবকিছু নিয়ে চিন্তাভাবনা হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলি খোলার বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা করা হচ্ছেনা। আজ প্রায় ৫০০ দিনের বেশি যাবৎ সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। এই দিনগুলিতে অনেককিছু হয়ে গেছে আমাদের রাজ্যে।
গনতন্ত্রকে মাটির ছ ফুট নীচে ঢুকিয়ে দিয়ে নির্বাচনের খেলা হয়েছে, বিভিন্ন ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুষ্ঠান উদযাপন হয়েছে, মানুষের একঘেয়েমি কাটানোর জন্য IPL এর মতো বানিজ্যিক মোরগ লড়াই হয়েছে। এখন তো কিছু শতাংশ কর্মী নিয়ে অফিস আদালত গুলোও খোলা হচ্ছে। এগুলো সব বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ মেনে করা হচ্ছে, কারণ সমাজের কাছে এগুলো আবশ্যিক।
এগুলো ছাড়া জীবনের কোনো অর্থ নেই। খাতায় কলমে পঞ্চাশ জন অতিথি নিয়ে বিবাহ অনুষ্ঠান উদযাপন করার ছাড়পত্রও দিয়ে দিয়েছে প্রশাসন, অথচ পঞ্চাশ জন ছাত্র ছাত্রী নিয়ে ক্লাস চালু করা যাচ্ছেনা। বেঁচে থাকার জন্য আবশ্যিক হিসেবে আরও যেগুলোকে গন্য করা হয়েছে, সেগুলো হলো সিনেমা হল, মাল্টিপ্লেক্স, শপিং মল, রেস্তোরাঁ, ক্যাফেটেরিয়া, পাব, জিম সেন্টার, সুইমিং পুল ইত্যাদি ইত্যাদি।
নিজেদের ক্লাসরুমে না যেতে পারা ছাত্রছাত্রীরা, নির্দ্বিধায় যাচ্ছে এই জায়গা গুলিতে, অভিভাবকদের সাথে। দূর্ভাগ্যবশতঃ আইন করেও শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে পারিনি আমরা মানসিকভাবে। আমরা অপেক্ষা করে বসে আছি, কবে এই শামুকের গতিতে এগিয়ে চলা টিকাকরণ কর্মসূচি দিয়ে দেশের একশো শতাংশ মানুষের টিকাকরণ সুসম্পন্ন হবে, তারপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলিকে খোলা হবে। আজ যারা আমাদের তৃতীয় ঢেউয়ের জুজু দেখাচ্ছে, তারা যে ভবিষ্যতে চতুর্থ বা পঞ্চম ঢেউয়ের জুজু দেখাবে না এমন নিশ্চয়তা আমার কাছে অন্তত নেই।
আজও আমার দেশের ৬৫% বাচ্ছাকে তাদের বাবা মা অনিচ্ছার সত্বেও স্কুলে পাঠায়। সেইকারনেই ‘মিড ডে মিল’ ‘কন্যাশ্রী’ বা ‘সবুজ সাথী’-র এর মতো প্রকল্পগুলো প্রাসঙ্গিক, অন্তত আমাদের রাজ্যে। জানিনা এই ৫০০ দিনে তাদের মধ্যে কতজন শিশুশ্রমিক হয়ে গেছে, তাদের মধ্যে কতজনের বাল্যবিবাহ হয়ে গেছে। তবে একথা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, আগামীকাল থেকেই যদি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয় তাহলেও অন্তত ১০% ছাত্র ছাত্রী আর ফিরে আসবেনা তাদের ক্লাসরুমে।
যে সকল শিক্ষক শিক্ষিকারা এই ছাত্রছাত্রীদের মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন এবং এই কাজের মাধ্যমেই নিজেদের দেশপ্রেমের প্রমাণ দিতে চেয়েছিলেন, তাদের আক্ষেপ হয় বইকি। অথচ তাঁরা হাটে বাজারে দাম যাচাই করতে গেলেই “দু বছর ধরে বসে বসে মাইনে” পাওয়ার শ্লেষ শুনে বাড়ি ফিরছেন।
শুনুন সরকার বাহাদুর, এইভাবে যে “অনুগত জনপিন্ড” তৈরি করছেন আপনারা, তারা অবশ্যই একদিন হয়ে ফিরে আসবে আপনাদেরই সামনে। সেদিন হয়তো আপনাদের লোভের সাম্রাজ্য ধ্বংস হবে, এবং সেইসঙ্গে সমগ্র মানব সভ্যতার বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে। এখনো সময় আছে, ভাবুন। সভ্যতার জন্য না হোক, অন্তত নিজেদের চরম পরিনতির কথা চিন্তা করে ভাবুন।