29/03/2024 : 3:24 PM
পুস্তক পর্যালোচনাসাহিত্য

পুস্তক পর্যালোচনাঃ নিমো গ্রামের গল্প (লেখকঃ সুকান্ত ঘোষ)

আলোচনাঃ
সম্বিৎ বসু, ক্যালিফোর্নিয়া

নিমো বর্ধমান জেলার এক গ্রাম। বর্ধমান শহরের কাছেই। কিন্তু কজনই বা তার নাম জানেন! তার এত ফুটেজ খাওয়ার কথা ছিলনা। কিন্তু খেয়ে গেল। কৃতিত্ব যার, সে হল সুকান্ত।

সুকান্ত ঘোষ নিমোর ছেলে। গুরুচন্ডা৯তে সুকান্তর লেখা পড়ি আজ থেকে বছর দশেক আগে। গ্রামের গল্প নিয়ে দীর্ঘ লেখা। আর তার পরতে পরতে বুনে দেওয়া কবিতার লাইন। সে কবিতাও পড়িনি, অধিকাংশ কবির নামও শুনিনি। অথচ লাইনগুলো ব্যবহারের মুন্সিয়ানায় হৃদয়ে গেঁথে যায়। সেই সঙ্গে ছিল নিজের লেখা কবিতা। ওই লেখা থেকেই আমরা পাঠকরা বুঝে যাই, ইনি কোন সৌখীন কবিতাবিলাসী নন। কবিতায় মজ্জা বাঁধা দেওয়া আছে। ইনি গ্রামকে চেনেন একেবারে নিজের করে। সেই সঙ্গে রসে ভরা গদ্যের হাত এনার পাকা। ক্রমশঃ পরিচিত হতে থাকি সুকান্তর গদ্যর সঙ্গে। মূলতঃ সবই ব্যক্তিগত আখ্যান। কিন্তু সেই ব্যক্তি দৃঢ়ভাবে প্রোথিত আছে নিমোর মাটিতে।

নিমোর গল্প লিখতে গিয়ে সুকান্ত তার ভাষা বদলে ফেলল। কবিতার সুগন্ধী দেওয়া ভাষা থেকে চলে গেল টানা প্রোজেইক গদ্যে। ভাষার এই পরিবর্তনটা জরুরি ছিল। কারণ সুকান্ত যাদের গল্প বলেছে, তারা কবিতার চর্চা করেনা, তারা দেশ-বিদেশ ঘোরেনি। তাদের জন্মকর্ম নিমোতেই। ঘটনাচক্রে তারা সুকান্তর আত্মীয়-পরিজন, ছেলেবেলার বন্ধু, পড়শী বা গ্রাম-সম্পর্কিত কাকা। এই পরিবর্তিত ভাষায় তাদের প্রত্যক্ষ করা যায়। অনুভব করা যায় তাদের সম্পর্কের উষ্ণতা। এ ভাষা অনেক ডিরেক্ট। একেবারেই পাড়ার ঠেকে বন্ধুদের সামনে গল্প বলা। এও বলে রাখা ভাল, এই ঠেক একান্তভাবে ছেলেছোকরাদের ঠেক। নারীচরিত্রবর্জিত। তার ফলে ঠেকের লব্জ, তথাকথিত আনপার্লামেন্টারি শব্দ উঠে এসেছে হুবহু। ওই লব্জ, ওই শব্দ না থাকলে মেকি মনে হত। আমার মতন যারা যৌবনের একটা বড় অংশ ঠেকে অতিবাহিত করেছে, তারা এ নিমোর গল্প পড়ে খুবই অন্তরঙ্গ বোধ করবে। আমি জানতে আগ্রহী ঠেকের রীতিনীতি, আদবকায়দা, শব্দভাষার সঙ্গে খুব পরিচিত নন, এমন পাঠকরা কীরকমভাবে এই লেখা নেন। ইনক্লুডিং, মহিলা পাঠক। গুরুচন্ডা৯তে, জানি, সুকান্তর পাঠিকার সংখ্যা কম নয়। কাজেই ধরে নেওয়া যেতে পারে এই গল্প-রসিকতাগুলো আস্বাদনের দিক দিয়ে লিঙ্গনিরপেক্ষ।

এ লেখা যার-তার কর্ম নয়। সুকান্তর মতন লোকই পারে এ লেখা লিখতে। কারণ, গ্রামের এই গল্প যাদের জন্যে লেখা তারা মূলতঃ শহুরে মানুষ। শুধু শহরে থাকার কথা বলছি না। শহুরে সেন্সিবিলিটির কথা বলছি। কাজেই সেই সেন্সিবিলিটিতে লেখককে পাঠকের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে গেলে তাকে শহর-গ্রাম এই দু নৌকোয় পা দিয়ে চলতে হবে। দু নৌকোয় পা না দিয়ে চলতে পারার কারণে বাংলা ভাষায় দিস্তে দিস্তে গ্রামের গল্প ইশতেহার হয়ে রয়ে গেছে। তারিয়ে তারিয়ে পড়ার গল্প হয়ে ওঠেনি।

সুকান্ত মেধাবী ও কৃতী পুরুষ। গ্রাম ছেড়েছে কলকাতায় – বলা ভাল হাওড়ায় – ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যাবার সময়ে। তারপরে কানপুরে উচ্চশিক্ষা, বিলেতে আরও বেশি উচ্চশিক্ষা। কর্মসূত্রে ঘুরেছে ‘কঁহা কঁহা মুলুক’ – আমস্টারডামের ফুলের বাজার থেকে ব্রুনেইয়ের মাছের বাজার। দুনিয়া দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে অল্পবয়েসে। অথচ লেখা পড়লেই ঠাহর হয় তার হৃদয়ের আর মগজের একটা অংশের সঙ্গে নিমোর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আছে। আর আছে তার চোখ। এরকম তো হতে পারেনা যে বিশ্বের যাবতীয় ক্যাওড়া-কাটিং ও আকর্ষণীয় ঘটনা নিমোতেই ঘটে বা নিমোতে যা ঘটে তাইই আকর্ষণীয়! আসলে ঘটনা থেকে রস বের করা একান্তই সুকান্তর কীর্তি। একটা ঘটনাও বানানো নয়। কিন্তু সাধারণ ঘটনাকে অসাধারণ করে উপস্থাপনা করার যে লুপ্তপ্রায় আর্ট প্রাচীন মনীষী যথা মুজতবা আলীরা জানতেন, তার অনেকটাই ঘোষজায় বর্তেছে। এর চেয়ে বড় প্রশংসা জানিনা।

এটা হয়ত ঠিক যে, যে গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও করার কথা ছিল, কার্যত শহর গিয়েই সেই গ্রামকে গ্রাস করে ফেলছে। টিভি, মোবাইল, ইন্টারনেট বেয়ে গ্রামে গ্রামে ঢুকে পড়েছে শহর। আর সেই সূত্রে ওলোট-পালোট করে দিচ্ছে সাবেকি রীতিনীতি, সামাজিক বুনোট। সেরকমটাই শুনছি। পন্ডিতরা সেরকমই বোঝাচ্ছেন। কিন্তু যাদের নিয়ে এই পন্ডিতি, তাদের স্বর কি পৌঁচচ্ছে আমাদের কাছে? সুকান্তর নিমোর গল্পগুলো পড়ার আগে বুঝিনি, কিন্তু এখন জানি যে সেই স্বরগুলো, অন্ততঃ আমার কাছে, পৌঁচচ্ছিল না। সুকান্তর স্বর পন্ডিতির নয়। এমনকি ‘আসুন গ্রাম দেখে যান’ – এমন লোক-জড়ো-করা প্রদর্শনীও নয়। স্রেফ নিজের দৈনন্দিকতাকে লেখায় ধরা। এর মধ্যে কোন উচ্চকিত পরিকল্পনা নেই। সময়-বিভাজন, পরম্পরা – মানে বেশ গুরুগম্ভীর বই করতে গেলে যেসব রীতি-টিতি মানতে হয় বলে শুনে এসেছি – তার কোন চিহ্নমাত্রই নেই। ভাগ্যিস।

সেই লেখা থেকেই বুঝছি, গ্রামের সামাজিক স্ট্রাকচার ভেঙে যাবার যেসব রোমহর্ষক কাহিনী শুনে আসছি তার অনেকটাই গল্পকথা। হয়ত অনেকদিন পরে কখনও এই সময়ের ইতিহাস লেখা হবে। তখন এই বই প্রাইমারি সোর্স হিসেবে ঐতিহাসিকদের কাজে আসবে।

লেখার সময়ে বারবার খেয়াল রাখতে হচ্ছে, ভূমিকা যেন বইয়ের রিভিউ না হয়ে যায়। এমনিতেই বইয়ের ভূমিকা অধ্যাপক, সমালোচক আর কিছু ভোঁপসা-মুখো-ভ্যাঁপাটে ছাড়া কেউ পড়েন না। তার ওপর যদি সে লেখা রিভিউ হয়ে যায়, তাহলে আর রইল কী? অতএব, হে পাঠিকা, হে পাঠক, আইস সুখপাঠ্য গ্রামের ইতিহাস পড়া যাক।

বইয়ের নামঃ নিমো গ্রামের গল্প
লেখকঃ সুকান্ত ঘোষ
প্রকাশকঃ গুরুচন্ডালি
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৩০০
মুদ্রিত মূল্যঃ ৩৩০ টাকা

অন লাইনে বইটি অর্ডার করা যাবে এখান থেকেঃ
https://www.collegestreet.net/Nimo_Graamer_Golpo

বইটি সংগ্রহ করতে বা খোঁজখবরের জন্য কল (WhatsApp) করুন +91 93303 08043

আর মেমারীর আশেপাশে স্থানীয় ভাবে বইটি পাওয়া যাচ্ছে নিমো বটতলার ধারে ‘ইষ্টো ইঞ্জিনিয়ারিং’, সুমন কুমার-এর (রাজুর) কারখানায়। সকাল সাতটা থেকে সন্ধ্যে সাতটার মধ্যে বিশেষ ছাড়ে বইটি সংগ্রহ করা যাবে রাজুর কারখানা থেকে।


নিমো স্টেশনের ছবি সৌজন্য – সোমনাথ চন্দ (মেমারি লাইভ ফেসবুক পেজ থেকে)

জিরো পয়েন্ট এ পুস্তক পর্যালোচনার জন্য যোগাযোগ করুন 9375434824 

Related posts

জিরো পয়েন্ট রবিবারের আড্ডা ~ রমলা মুখার্জী | মোঃ ইজাজ আহামেদ | গিয়াসুদ্দিন আহমেদ | সুতপা দত্ত | অর্পিতা চ্যাটার্জ্জী | মনোজ কুমার রায় | সৈয়দ রিজাউল ইসলাম | পরিতোষ বর্ম্মন ~

E Zero Point

দৈনিক কবিতাঃ ধ্বংসের নাম যুদ্ধ

E Zero Point

দৈনিক কবিতাঃ চিমটি কেটে দাও

E Zero Point

মতামত দিন