জিরো পয়েন্ট নিউজ – আমিরুল ইসলাম, মালদা, ২৬ মার্চ ২০২৩:
মালদা জেলা হরিশ্চন্দ্রপুরে অফিসের সামনে ৯৩ তম ভগৎ সিং এর শহীদ দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপিত হয়। ভগৎ সিং এর প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করেন অল ইন্ডিয়া ডি ওয়াই ও-র মালদা জেলা ইনচার্য কমরেড উজ্জ্বলেন্দু সরকার, হরিশ্চন্দ্রপুর ইউনিটের পক্ষে প্রশান্ত সাহা ও কৃষ্ণ দাস । ভগৎ সিং কে শ্রদ্ধা জানিয়ে শ্রদ্ধা পাঠ করেন এবং পরে ব্যাখ্যা করেন উজ্জ্বলেন্দু সরকার ।
ভগৎ সিং এমন একটি নাম যেন বিপ্লবের জীবন্ত প্রতীক কতটুকুই বা বয়স মাত্র ২৩। বয়সে নবীন হলেও চিন্তায় চেতনায় ভগৎ সিং ছিলেন অত্যন্ত পরিণত। বিভিন্ন বিষয়ে তার সুচিন্তিত লেখা বক্তব্য পড়লেই বুঝতে পারা যায় তিনি কতটা উন্নত চিন্তার কারবারি ছিলেন। সেটাই বোঝার সামান্য প্রচেষ্টা করছি। স্বাধীনতা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন “স্বাধীনতা হলো মানুষের জন্মগত অধিকার, যা কোনোভাবেই হরণ করা চলে না। কোন মানুষকেই তার পরিশ্রমের ফল ভোগ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার চলে না। যদি কোন সরকার জনগণের এই মৌলিক অধিকার হরণ করে তবে জনগণের অধিকার হলো বলা উচিত জনগণের কর্তব্য হল সেই সরকারকে ধ্বংস করা।” সাম্রাজ্যবাদ কি প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন ” সাম্রাজ্যবাদ হল লঠের উদ্দেশ্যে সংঘটিত এক বিরাট ষড়যন্ত্র। মানুষ কর্তৃক মানুষের, এক জাতির দ্বারা অপর জাতির সূচতুর শোষণের যে প্রক্রিয়া, সাম্রাজ্যবাদ হল তার সর্বোচ্চ এবং শেষ পর্যায়। এই সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের লুণ্ঠনের ষড়যন্ত্রকে আরো ব্যাপক করতে সাম্রাজ্যবাদী আদালতের সাহায্যে আইনসম্মত হত্যাকাণ্ড চালায়। শুধু তাই নয়, অবাধ গণহত্যা ব্যাপক ধ্বংস এমনকি যুদ্ধের মতো হীন অপরাধ তারা ঘটিয়ে চলে। মানুষ যদি তাদের ধ্বংসাত্মক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র নীরবে নত মস্তকে মেনে না নেয়, যদি তাদের অবাধ লুন্ঠনের অধিকার মেনে নিতে অসম্মত হয়, তবে নিরস্ত্র নীরপরাধ জনগণকে গুলি করে হত্যা করতে এদের হাত কাঁপে না। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকর্তা সেজে এরাই শান্তি হরণ করে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে, মানুষ খুন করে, যত রকম অপরাধ সম্ভব সবই এরা ঘটায়।
” ইনকিলাব জিন্দাবাদ সম্পর্কে তিনি বলেছেন ” বিপ্লবের অর্থ সশস্ত্র আন্দোলন হতেই হবে এমন নয়। কখনো কখনো বোমা পিস্তল বিপ্লব সফল করার উপায় মাত্র হতে পারে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, কোন কোন আন্দোলনে বোমা এবং পিস্তল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কিন্তু কেবলমাত্র এই কারণেই বোমা পিস্তল এবং বিপ্লব সমার্থক হতে পারে না। বিদ্রোহকেও বিপ্লব বলা যায় না, যদিও বিদ্রোহ চূড়ান্ত পরিনামে বিপ্লবে পরিণত হতে পারে।” তিনি আরো বলেছেন ভারত সরকারের সর্বোচ্চ গদিতে লর্ড রেডিং- ই থাকুন আর পুরুষোত্তম দাস ঠাকুর- ই থাকুন, লর্ড আরউইনের পরিবর্তে স্যার তেজ বাহাদুর সপ্রুই আসুন, তাতে দেশের শ্রমিক কৃষকের জীবনে কি পরিবর্তন আসবে? আপনাকে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে তাদের( শ্রমিকদের) বোঝাতে হবে বিপ্লবটা তারই বিপ্লব। তারই কল্যাণের জন্য এ বিপ্লব! এ বিপ্লব সর্বহারার স্বার্থে সর্বহারাদের নিজস্ব বিপ্লব।
শ্রমিক কৃষকদের সম্পর্কে তিনি বলেছেন
” উৎপাদন যারা করেন অর্থাৎ শ্রমিক মানব সমাজের পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। অথচ শোষক শ্রেণি তাদের শ্রমের ন্যায্য মূল্য এবং মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। একদিকে সকলের মুখের অন্য উৎপাদন করছে যে কৃষক সে সপরিবারে উপবাসে মরছে, যে তন্তুবায় কাপড় বুনে সারা পৃথিবীর বাজার পূর্ণ করে দিচ্ছে তার ঘরে নিজের এবং শিশুর শরীরটুকু ঢাকা দেবার উপযুক্ত বস্ত্রখন্ড জোটেনা। রাজমিস্ত্রি কর্মকার এবং সূত্রধর অপরূপ প্রাসাদ নির্মাণ করছে কিন্তু তাদের নিজেদের জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে নোংরা বীভৎস বস্তির অন্ধকারে। অন্যদিকে পুঁজিপতি শোষক সমাজে যারা ঘুনপোকার মত বেঁচে আছে তারা নিজেদের লিপসা চরিতার্থ করতে কোটি কোটি টাকার জলের মতো খরচ করছে। এই ভয়ংকর বৈষম্য এবং আত্মবিকাশের অধিকারের ক্ষেত্রে মিথ্যা সমানাধিকারের বাণী সমাজকে এক মাৎস্যন্যায়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি কখনোই চিরস্থায়ী হতে পারেনা।
ভাববাদী চিন্তা এবং ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি বলেছিলেন “মূর্তিপূজা ও ধর্মীয় সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে মানুষকে যেমন একদিন সংগ্রাম পরিচালনা করতে হয়েছে তেমনি ঈশ্বর চিন্তার বিরুদ্ধেও সমাজকে সংগ্রাম করতে হবে। মানুষ যখন নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছে দর্শনগতভাবে বস্তুবাদ আয়ত্ত করেছে তখন তাকে ধর্মীয় বিশ্বাস বিসর্জন দিতে হবে , জীবনের সমস্ত বাধা এবং সমস্যার বিরুদ্ধে মানুষের মতো লড়তে হবে।” তরুণ রাজনৈতিক কর্মীদের প্রতি তিনি বলেছিলেন,” বিপ্লবের জন্য শক্তি সমাবেশ ঘটানো এবং বিপ্লবের জন্য জনগণকে প্রস্তুত করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এজন্য বিপ্লবী কর্মীদের অপরিসীম আত্মত্যাগ প্রয়োজন। আমি খুব স্পষ্টভাবে বলতে চাই আপনি যদি ব্যবসায়ী হন কিংবা সামাজিক প্রতিষ্ঠা এবং পারিবারিক পিছুটান যদি আপনার থাকে তবে এ পথ আপনার জন্য নয়। বিপ্লবী দলের নেতা হওয়ার যোগ্যতা আপনার নেই কিছু ভাষণ দেবার মত নেতা আমাদের অনেক আছে, এসব নেতাদের কোন মূল্যই নেই। লেলিন যাকে বলেছেন ‘জাত বিপ্লবী’ তেমন ধরনের নেতা আমাদের চাই। আমাদের চাই এমন সব সর্বক্ষণের কর্মী, বিপ্লব ছাড়া আর কোন আকাঙ্ক্ষা, বিপ্লবের জন্য কাজ ছাড়া আর কোন কাজ যাদের নেই। দলে এমন ধরনের কর্মী যত বেশি সংখ্যায় পাওয়া যাবে সাফল্যের সম্ভাবনা ততোই বাড়তে থাকবে।” কেন আমি নাস্তিক -এ তিনি বলেছিলেন, যেদিন আমরা তেমন সংখ্যক নারী-পুরুষের সন্ধান পাব , যারা মানবজাতির সেবার জন্য এবং লাঞ্ছিত মানবতার মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না সেই দিনেই আসবে প্রকৃত মুক্তিলগ্ন। শোষণ অত্যাচার উৎপীরনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বেদিমূলে তারা জীবন উৎসর্গ করবে, উজির-নাজির হওয়ার জন্য অথবা ইহজগতে বা মৃত্যুর পর পরজন্মে পুরস্কৃত হওয়ার লোভে নয়। সমগ্র মানবজাতির উপর থেকে দাসত্বের শৃংখল উন্মোচনের মহান উদ্দেশ্যে পৃথিবীর বুকে স্বাধীনতা ও শান্তির স্বর্গ প্রতিষ্ঠার জন্য তারা এ পথের যাত্রী হবে।”
তরুণ রাজনৈতিক কর্মীদের প্রতি তিনি আরো বলেছিলেন” কলকারখানার মজুর আর ক্ষেত খামারের কৃষকরাই এই বিপ্লবী সংগ্রামের প্রকৃত সৈনিক। কিন্তু আমাদের বুর্জোয়া নেতারা শ্রমিক কৃষকদের সংগ্রামে যুক্ত করতে চান না অথবা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাবে বলে ভয় পান। তারা ভাবেন সুপ্ত সিংহকে যদি একবার জাগিয়ে তোলেন তাহলে তা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে । যতটুকু আদায় করে বুর্জোয়া নেতারা থামতে চান আন্দোলনকে সেখানে থামানো কঠিন হয়ে পড়বে।” তিনি মৃত্যুবরণ এর আগে বলেছিলেন “আজ আমি সানন্দে হাসিমুখে এমন ভাবে ফাঁসির রজ্জুকে বরণ করতে চাই যা দেখে ভারতের ঘরে ঘরে মায়েরা প্রার্থনা করবে তাদেরও সন্তান যেন ভগৎ সিং এর মত হয়ে ওঠে। আমার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে দেশের স্বাধীনতার বেদিমূলে আত্মদান করতে এত বিপুল সংখ্যক মানুষ এগিয়ে আসবে যে সাম্রাজ্যবাদ তার সমস্ত দুষ্ট শক্তি প্রয়োগ করেও বিপ্লবের অগ্রগতিকে রুখতে পারবে না।” উপরোক্ত আলোচনা থেকেই আমরা নিঃসন্দেহে বুঝতে পারি যে ভগৎ সিং কতটা উন্নত চিন্তা চেতনার অধিকারী ছিলেন ।তাই তাকে বলা হয় শহীদ-ই আজম। ভগৎ সিং এর উপরোক্ত চিন্তাধারা থেকে শিক্ষা নিয়ে আজকের দিনে পুঁজিবাদ বিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব গড়ে তোলার সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করার মধ্যেই রয়েছে ভগৎ সিং এর প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের প্রকৃত অর্থ। ২৩ শে মার্চ ভগৎ সিং এর শহীদ দিবসে রইল শ্রদ্ধার্ঘ্য।