30/10/2024 : 4:39 AM
অন্যান্য

করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্যঃ -ডাঃ মহম্মদ মেহবুব এলাহী, গুয়ান্ঝাও সিটি, চীন

বর্ধমান নিবাসী, বর্তমানে চীনের Southern Medical University (Guangzhou, China.) তে কর্মরত ডাঃ মহম্মদ মেহবুব এলাহী

চীনের উহানে প্রথমে শনাক্ত হওয়া নভেল করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে এবং আমেরিকা, স্পেন, ইতালি, জার্মান সহ বিভিন্ন দেশে তা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। । করোনা ভাইরাস এমন একটি ভাইরাস যা নিদুভাইরাস শ্রেণীর একটি সংক্রামক ভাইরাসের প্রজাতি। ১৯৬০ এর দশকের প্রথম করোনা ভাইরাস আবিষ্কৃত হয়।  করোনা ভাইরাস এর যতগুলো প্রজাতি আছে এর মধ্যে  মাত্র ৬টি মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে। তার মধ্যে চীনে ২০০২সালে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া সার্স ভাইরাস (Severe Acute Respiratory Syndrome – SARS) নামে যে ভাইরাসের সংক্রমণে পৃথিবীতে ৭৭৪জনের মৃত্যু হয়েছিল আর ৮০৯৮জন সংক্রমিত হয়েছিল সেই ভাইরাসটিও ছিল এক ধরণের করোনাভাইরাস। আর পরবর্তীতে ২০১২ সালে সৌদি-আরবে আবিষ্কৃত করোনা প্রজাতির মার্স ভাইরাসে (Middle East Respiratory Syndrome – MERS) ৮৫৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল ৷ সর্বশেষ ২০১৯ সাল চীনে ‘নোভেল করোনা ভাইরাস’ পাওয়া যায়। এসকল ভাইরাসের ফলে শ্বাসকষ্টের গুরুতর সংক্রমণ দেখা দেয়। এই নতুন ভাইরাসজনিত রোগটিকে প্রথমদিকে নানা নামে ডাকা হচ্ছিল, যেমন: ‘চায়না ভাইরাস’, ‘করোনাভাইরাস’, ‘২০১৯ এনকভ’, ‘নতুন ভাইরাস’, ‘রহস্য ভাইরাস’ ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন নামে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোগটির আনুষ্ঠানিক নাম ঘোষনা দেয় কোভিড১৯ যা ‘করোনাভাইরাস ডিজিজ ২০১৯’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ।

করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রকাশিত প্রাথমিক লক্ষণ:

  • শরীরে জ্বর থাকবে
  • অবসাদ, ক্লান্তি ভাব থাকবে
  • শুষ্ক কাশি থাকবে
  • শ্বাস কষ্ট দেখা দিবে
  • প্রচন্ড গলা ব্যাথা হবে
  • অনেক ক্ষেত্রে রোগীর উপরোক্ত সকল উপসর্গ দেখা গেলেও জ্বর থাকবে না।

 

সাধারনত জ্বর দিয়ে ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়, তারপর শুকনো কাশি দেখা দেয়। সপ্তাহখানেক পরে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের হালকা ঠাণ্ডা লাগা থেকে শুরু করে অনেক উপসর্গ দেখা দিতে পারে। অধিকাংশ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের হালকা থেকে মাঝারি শ্বাসকষ্ট হয় এবং দুই থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে কোনো  বিশেষ চিকিত্সা ছাড়াই সুস্থ হয়ে ওঠে। তবে বয়স্ক ব্যক্তিরা এবং বিশেষত যারা আগে থেকেই কোন শারীরিক রোগে ভুগছেন যেমন উচ্চ্ রক্তচাপ, হৃদরোগের, ডায়াবেটিস, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগ এবং ক্যান্সারের মতো অন্তর্নিহিত কোনো রোগে ভুগছেন তাদের ক্ষেত্রে গুরুতর অসুস্থতার সম্ভাবনা বেশি।

করোনা ভাইরাস এর উৎপত্তিঃ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(WHO) এর  ধারণা ভাইরাসটির উৎস কোনো প্রাণী হবে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ  প্রথম স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা গত ডিসেম্বর মাসে চীনের উহানে নিশ্চিত করেছিলেন। ধারনা করা হয়ে থাকে, মানুষের করোনা ভাইরাসের আক্রান্ত হবার ঘটনাটি ঘটেছে চীনের উহান শহরের পাইকারি সামুদ্রিক মাছের বাজার থেকে। তবে এটি ঠিক কিভাবে ছড়িয়ে পড়ছে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এবং বিজ্ঞানীরা এখনও সেটা নিশ্চিত করতে পারেন নি। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই এখন করোনা ভাইরাস এর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে।

করোনা ভাইরাস কোন প্রাণী থেকে ছড়াল?

যদি ভাইরাসের উৎস প্রাণীটি শনাক্ত করা একবার সম্ভব হয়, তাহলে এই মহামারি রোগটি মোকাবেলা করা অনেক সহজ হবে।করোনা ভাইরাসের সঙ্গে রিলেটেড আছে চীনের উহানের দক্ষিণ সমুদ্রের খাবারের পাইকারি বাজারের সঙ্গে।

বেশ কয়েক ধরনের সামুদ্রিক প্রাণী নোভেল করোনা ভাইরাস বহন করতে পারে (যেমন বেলুগা তিমি), তাছাড়া ওই বাজারটিতে অনেক জীবন্ত প্রাণীও ছিল, যেমন মুরগি, বাদুর, খরগোশ, সাপ- এসব প্রাণীও করোনা ভাইরাসের উৎস হতে পারে। গবেষকরা আরো সতর্ক করে বলছেন, চীনের হর্সশু নামের একপ্রকার বাদুরের সঙ্গে এই ভাইরাসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে।

 

কিভাবে এই করোনা ভাইরাসে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে?

করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত এক বাক্তি থেকে অন্য বাক্তির মধ্যে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। আক্রান্ত বাক্তির নাক এবং মুখের মাধ্যমে কাশি বা প্রশ্বাস এর সাথে খুদ্র খুদ্র ফোঁটা বা ড্রপলেট বেরহয় যা ব্যক্তিটির চারপাশের বস্তু বা পৃষ্ঠতলের উপর অবতরণ করে।অন্য বাক্তি যদি সেই বস্তুগুলি স্পর্শ করে তাহলে ভাইরাসটি বাক্তির হাত থেকে মুখ, চোখ, নাকের মাধ্যমে কোনও না কোনও ভাবে শরীরের ভিতরে চলে যায়। এছারা কোনও বাক্তি আক্রান্ত বাক্তির কাছা কাছি থাকলে সরাসরি আক্রান্ত বাক্তির প্রশ্বাসের খুদ্র খুদ্র ফোঁটা দ্বিতীয় বাক্তির নিশ্বাসের মাধ্যমে ভিতরে চলে যায়। এজন্য অবশ্যই অসুস্থ ব্যক্তির থেকে অন্তত 1 মিটার (3 ফুট) বেশি দূরে থাকা গুরুত্বপূর্ণ।

ভাইরাসটি কিভাবে প্রতিরোধ করা যেতে পারে?

করোনা ভাইরাস এমন একটি ভাইরাস যা নিজে থেকে বিনষ্ট বা বিলুপ্ত হয়ে যাবে না। ভাইরাসটি প্রতিরোধ করতে এখন পর্যন্ত কোন ভ্যাকসিন বা টিকা  অথবা কোনও অ্যান্টিভাইরাস ঔষধ আবিষ্কৃত হয়নি। বিজ্ঞানীরা ক্লিনিকাল ট্রায়ালের মাধ্যমে  কয়েকটি ভ্যাকসিনের পরীক্ষা করছেন। এখানে আরো আতঙ্কের ব্যাপার হলো, রোগে আক্রান্ত হওয়ার কোন লক্ষণ ছাড়াও কোন ব্যক্তি ভাইরাসটি ছড়িয়ে দিতে পারে। তাই এখন এই রোগ থেকে একমাত্র রক্ষার উপায় হলো অন্যদের মধ্যে ভাইরাসের সংক্রমণ হতে না দেয়া। এমন কিছু গৃহীত সিদ্ধান্ত- যেমন শহরগুলো বন্ধ করে দেয়ার মতো কড়া পদক্ষেপের ফলেই শুধুমাত্র রোগটির বিস্তার অনেকাংশে ঠেকানো যেতে পারে।

যার অর্থ হলো:

  • মানুষজনের স্বাভাবিক চলাচল সীমিত করে দেয়া।
  • দুই হাত ভাল করে ধুতে সবাইকে উৎসাহিত করা।
  • চিকিৎসকেরা প্রতিরক্ষামূলক পোশাক পরে আক্রান্ত রোগীদের আলাদা আলাদা করে চিকিৎসা সেবা দেয়া
  • রোগীদের দেহে এই ভাইরাস রয়েছে কিনা তা জানতে এবং রোগীদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের শনাক্ত করার জন্যও নজরদারি করা প্রয়োজন।

মাস্ক পরে কি ভাইরাস ঠেকানো যায়?

সারাবিশ্বে এখন সংক্রমণ ঠেকানোর একটি জনপ্রিয় ব্যবস্থা হচ্ছে মাস্ক ব্যবহার। বিশেষ করে চীন এই পদ্ধতি সব থেকে বেশি ব্যবহার করে, চীন যেখান থেকে শুরু হয়েছে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা, সেখানেই মানুষ বায়ু দূষণের হাত থেকে বাঁচতে সচরাচর নাক আর মুখ ঢেকে বা মুখোশ পরে ঘুরে বেড়ায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক বায়ুবাহিত ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে যথেষ্ট কাজ করে না। বেশিরভাগ ভাইরাসই বায়ুবাহিত এবং এই মাস্কগুলো এতই ঢিলেঢালা থাকে যে এটা বায়ুকে ঠিকঠাক ফিল্টার করতে পারেনা। তাছাড়া যে ব্যক্তি এই মাস্ক ব্যবহার করছেন, তার চক্ষু উন্মুক্ত থেকে যাচ্ছে। তবে  এই মাস্ক হাঁচি বা কাশি থেকে ভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি কিছুটা দমাতে সাহায্য করতে পারে। আর হাত থেকে মুখের সংক্রমণের ক্ষেত্রেও কিছুটা সুরক্ষা দেয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(WHO) এর  পরামর্শ অনুযায়ী আপনি যদি COVID-19 উপসর্গগুলি (বিশেষত কাশি) নিয়ে অসুস্থ হন বা কারো কাছে যাচ্ছেন অথবা কারো দেখাশোনা করছেন যার মধ্যে  কোভিড -19 এর উপসর্গগুলি আছে কেবলমাত্র তখনই মাস্ক পরুন।

ডিসপোজেবল মাস্ক শুধু মাত্র একবারই ব্যবহার করা যায়। এন৯৫ মাস্ক সার্জিক্যাল মাস্ক বা ডিসপোজেবল মাস্কের থেকে বেশি সুরক্ষা দেয়। ভিড়ের মধ্যে গেলে মাস্ক ব্যবহার করলে অন্যের সংস্পর্শ এড়াতে মাস্ক পরুন যাতে সংক্রমণের ঝুঁকি  অনেকটা কমে যায়।

 

কোয়ারেন্টাইন কী এবং কেন করতে হবে?

করোনা ভাইরাসের কারনে এখন ‘কোয়ারেন্টাইন’ একটি পরিচিত শব্দ যার অর্থ- একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পৃথক থাকা। তবে কোয়ারেন্টাইন অর্থ এই নয় যে, তাকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দেয়া হলো। যদি কারো করোনা ভাইরাসের উপসর্গ দেখা দেয়, তাহলে অবশ্যই তাকে জনবহুল এলাকা থেকে দূরে রাখতে হবে এবং ভাইরাসটির সংক্রমন ঠেকাতে অন্তত ১৪ দিন আলাদা থাকতে বলা হয়। তবে কোয়ারেন্টাইনে থাকার অর্থ  আপনার কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে যাওয়া হবে না। এমনকি প্রতিনিয়ত ব্যবহার্য জিনিসপত্রও কেড়ে নেওয়া হবে না। করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি ১৪ দিনের মধ্যে আক্রান্তের শরীরে পাওয়া যায়। যার জন্য এই ১৪ দিনে উপসর্গ পাওয়া রোগীর সংক্রমণ বাড়ে কিনা তা পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়। করোনার ভাইরাস গুলো ধীরে ধীরে সুস্থ কোষের সঙ্গে মেশে যেতে থাকে। আর এই সময়ের মধ্যে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে নিয়মিতভাবে শরীরের তাপমাত্রা মাপা হয়, আর এ সময়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলা হয় ও জ্বর কমাতে প্রয়োজনীয় ওষুধ গ্রহণসহ ভালো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলা হয়।কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগীদের ব্যবহার করা টাওয়াল, খাবারের পাত্র ও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় ব্যবহৃত জিনিসগুলোর মাধ্যমেও ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়তে পারে।

সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে যেসমস্ত করোনা ভাইরাসে সম্পর্কিত ভুল তথ্যঃ

প্রতিনিয়ত সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে কিছু ভুল তথ্য আপনার কাছে আসছে সেগুলো এড়িয়ে চলুন এবং অপর কে এই ব্যাপারে সচেতন করুন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(WHO) এর  পরামর্শ অনুযায়ী এসময় আপনার শরীরের জন্য  ৩ টি ক্ষতিকারক জিনিস এড়িয়ে চলুন যেগুলি হলো-

১) ধূমপান না করা।

২) একসাথে একের বেশি মাস্ক না পরা।

৩) করোনা ভাইরাসের  সংক্রমণ থেকে বাঁচতে  অযথা এন্টিবায়োটিক না খাওয়া।

এছাড়া যেগুলি আপনাকে করোনা ভাইরাসের  সংক্রমণ থেকে বাঁচতে পারবে না সেগুলো হলো- আগে থেকে কোনও হোমিওপ্যাথি বা আয়ুর্বেদিক অথবা অন্য কোনও ঔষধ খাওয়া, গোমূত্র পানকরা, গোবর দিয়ে স্নান করা, আদা খাওয়া, থানকুনি পাতা খাওয়া।

 

শেষ কথা

ইতিমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) করোনা ভাইরাসকে মহামারী ঘোষনা করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এদিকে করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছে। এর মধ্যে যেমনঃ হাত না ধুয়ে নিজের চোখ, মুখ ও নাক স্পর্শ না করা। আর প্রতিদিন কয়েকবার সাবান বা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড হাত পরিষ্কার করা। এছাড়া বিশ্বের যে জায়গাতেই করোনার উপসর্গযুক্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে, তখনই তাদের কোয়ারেন্টাইনে থাকার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।

Related posts

হায়দ্রাবাদে থাকা বর্ধমানের অভুক্ত শ্রমিকদের কাছে খাবার পৌঁছে দিলো ডি.ওয়াই.এফ.আই

E Zero Point

এক সংকল্প, এক লক্ষ্য – আত্মনির্ভর ভারত : শ্রী অমিত শাহ

E Zero Point

পশ্চিম বর্ধমানের চুরুলিয়ায় জনতার ক্ষোভে পুলিশ আক্রান্ত | গুজব ছড়াবেন না, সচেতন থেকে প্রশাসনের পাশে থাকুনঃ সোনালী কাজী

E Zero Point