পেঁয়াজ রসুন দিয়ে কষিয়ে কষিয়ে মাংসটা রান্না করে নীলা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে এক গ্লাস ঠান্ডা জল খেলো। পারুলের এখনও কাজ হয় নি। পারুলের ছ সাত বছরের ছেলেটা একটা পাজেল নিয়ে বারান্দায় বসে বসে খেলছে। প্রথম দিকে ছেলেটা ওদের লিভিং রুমের মেঝেতেই বসতো। নীলা দুয়েক দিন পারুলকে জিজ্ঞেস করেছিলো, “ছেলেটাকে রোজ রোজ সাথে করে নিয়ে নিয়ে ঘোরো কেন? ঘরে রেখে আসতে পারো না? ছোটোর থেকে টৈ টৈ অভ্যেস করাচ্ছো।”
পাঁচ বাড়ি কাজ করে খায়। নানা লোকের নানা উপদেশ শুনতে হয়। পারুল পাত্তাও দেয় না এসব কথা। ওর সুবিধে মতো ও যা করার করবে। লোকের কি? খালি ঘরে বাচ্চা রেখে আসবে নাকি? যে মা পারে পারুক। পারুল পারবে না। সোজা কথা। কামাই নেই। ঝকঝকে কাজ। এবাড়ি ওবাড়ি খবর চালাচালি নেই। হাতটানের স্বভাব নেই। আবার কি? পারুল ছেলে নিয়েই কাজে আসবে। পোষায় তো থাকবে, না পোষায় তো অন্য কাজ দেখে নেবে। এটা দয়া দাক্ষিণ্যের ব্যাপার না, তোমরা আমার সমস্যা বোঝো, আমি তোমাদের সমস্যা বুঝবো, এমনটাই মনে মনে আওড়ায় পারুল।
নীলার শাশুড়ি সেদিন কেমন সুর করে বলছিলো, “তুই পারুল বেঁচে গেছিস। ছেলে। ছেলেকে নিয়ে অত চিন্তা নেই। এই যদি মেয়ে হতো চিন্তা হতো ফাঁকা ঘরে রেখে আসতে। কে কি করে দিতো একা পেয়ে।”
পারুলের মুখে উত্তর গোছানোই থাকে। ” কি কথা বললা এটা মাসী? মেয়েকে লোকে কিছু খারাপ করতে পারে, ছেলেকে পারে না? ছেলেকেও পারে, বদ সঙ্গে পড়লে, বাজে জিনিস দেখতে শিখলে, নেশা করতে শিখলে ,কে দেখবা?”
নীলার শাশুড়ি আর কিছু বলতে যান নি। টেনে কাজটা করে দেয় পারুল। চটিয়ে লাভ নেই।
কিন্তু বাড়ির কেউই যেটা খেয়াল করে নি, পারুলের ছেলে সূর্য আর বাড়ির ভেতরে ঢোকে না। বারান্দায় বসে থাকে। কোনোদিন পাজেল নিয়ে খেলে। কোনোদিন বই নিয়ে আসে। বসে বসে পড়ে। সকাল নটার মধ্যেই পারুলের সব কাজ হয়ে যায়। বাড়ি গিয়ে ছেলেকে চান করিয়ে খাইয়ে স্কুলে পাঠায়। বাড়ি গিয়ে প্রেসারে গরম ভাত করে নেয়। সূর্য তাই খেয়ে স্কুলে যায়। দুপুরে তো স্কুলেই খায়। বেশ যত্ন করে ওকে বড়ো করছে পারুল।
আজ নীলা বারান্দায় এসে বসলো মোবাইলটা নিয়ে। নীলা বারান্দায় আসতেই সূর্য সরে গেটের কাছে চলে গেলো। নীলা বলল, “রোদে যাচ্ছিস কেনো, ভেতরেই বোস।”
সূর্য মাথা নেড়ে ‘না’ বলল।
নীলা বলল, “কষা মাংস দিয়ে দুপিস পাউরুটি খাবি?”
সূর্য হেসে হেসে বলল, “ওসব খাই ই না।”
নীলা অবাক হয়ে বলল, ” বাবা! কোনসব খাস তাহলে?”
সূর্য একটু লাজুক হাসলো শুধু।
পারুল কাজ সেরে সূর্যকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। রাস্তায় বেরিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “দিদি মাংস রুটি খেতে বলছিলো খেলি না কেন?”
সূর্য অত জানে না কেন ও খেতে চাইলো না। বাড়িতে তো মা রান্না করলে ভালোবেসেই খায়। একটু ভেবে বলল, “বাড়ির খাবারটা ওদের খাবারের থেকে বেশি ভালো। ওদেরটা খাইই না।”
ছেলেকে আদর করে কাছে টেনে নিলো পারুল। পারুলের আর চিন্তা নেই। ছেলে একটু একটু করে বড়ো হয়ে উঠছে। যাদের সামান্য কিছুক্ষণ ঘরে বসতে দিতে আপত্তি, তাদের বাড়িতে কিছু খাওয়া মানে সংকুচিত হয়ে খাওয়া। কি দরকার। মনের ভেতর থেকে তাই একটা “না” এসেছে সূর্যর। এত পরিস্কার করে না হলেও একটা কিছু বুঝলো পারুল। কাজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ওকে একটা নীরব অপমান বোধের মধ্যে ফেলতে মন চাইলো না পারুলের।
পরের দিন পারুল ছেলেকে নিয়ে এলো না কাজে। নীলার শাশুড়ি জিজ্ঞেস করল,”কি রে পারুল, ছেলেকে আজ কোথায় রেখে এলি?”
পারুল চটজলদি হাত চালাতে চালাতে বলল,” নিজের বাড়িতে থাকতেই সে ভালোবাসে গো মাসী। নিজের ঘরে হাত পা ছড়িয়ে খেলবে পড়বে থাকবে। আমি বলেছি কেউ আসলেও যেন দরজা না খোলে। ”
নীলার শাশুড়ি হাসলো ,”সেই দেখলি তো। কিছু ভুল বলতাম আমি?”
পারুলের অত কথার সময় নেই। তাও বলল,”হ্যাঁ । ঠিকই বলতে। সে তার সীমানা বুঝেছে। আপনার জন বুঝেছে। কোন ডাকে সাড়া দিতে হয় আর কার ডাকে সাড়া দিতে নেই তাও বুঝেছে। আর তাকে সাথে সাথে নিয়ে ঘুরতে হবে না। বরং আমারে বলল, “তুমি যাও , আমি আজ রান্নার জল তুলে চাল ধুয়ে রেখে দেবো।”
নীলার একটু গায়ে লাগলো কথা গুলো।, আগের দিন মাংসটা রিফিউজ করেছে। পারুল নিজের মনে কাজ করছে। ঘর বারান্দাটা কেমন খালি খালি লাগছে আজ। কেউ আমাকে পছন্দ করে না, কেউ আমাকে চায় না, এইকথাটা ফিল করায় এমন একটা শূন্যতা আছে আগে বোঝে নি।
Image: Alexandros Christofis (1882-1953) Greek painter.