11/12/2024 : 8:37 AM
অন্যান্য

ধারাবাহিক গল্পঃ নীভা থেকে নীভাদেবী হয়ে ওঠার কাহিনী (দ্বিতীয় পর্ব) ~ সুতপা দত্ত

সুতপা দত্ত

প্রথম পর্বঃ ধারাবাহিক গল্পঃ নীভা থেকে নীভাদেবী হয়ে ওঠার কাহিনী (প্রথম পর্ব) ~ সুতপা দত্ত

দ্বিতীয় পর্ব

কিন্তু উপরে বসে যিনি কলকাঠি নাড়ছেন , তাঁর প্ল্যানটা একটু অন্য রকমই ছিল। অর্পণের সব ভাবনায় জল ছিটিয়ে দেওয়ার জন্য হঠাৎ-ই উপস্থিত হলেন ননী জেঠু , বাবার কলিগ। কোনো দিন হয়তো তাদের দেখেছেন একসাথে পথ চলতে , ব্যাস , অভিভাবকদের তো একটা দায়িত্ব আছে , সেটাই পালন করতে অর্পণ-দের বাড়ি হাজির হয়ে গেলেন । যে কথাটা একটু একটু করে গুছিয়ে ধীরে সুস্থে সামনে আনতে চাইছিল অর্পণ, সেটাই এমনভাবে সামনে চলে এলো যে , আর গোছানোর কোনো অবকাশই পেল না ‘ও’। আর আঘাত-টাও করলেন ঠিক মোক্ষম জায়গায় । এ’কথা , ও’কথা র পর বাবাকে বললেন –
– রিটায়ারমেন্ট এর পর কি সমাজসেবায় নাম লেখালে ভায়া ?
– মানে তো বুঝলাম না দাদা , চা খেতে খেতে জানতে চাইলেন বাবা ।
ওনারা বসার ঘরে আর অর্পণরা ডাইনিং টেবিলে ।
– না , বড় ছেলের বিয়ে কি ঠিক করে ফেললে !
কান খাড়া হয়ে গেল অর্পণের , মা আর ভাইও ওরই দিকে চেয়ে ।
– না দাদা চলছে দেখাশোনা , দিন না , একটা ভালো মেয়ের খবর ।
-কি বলছ ভায়া , কিছুই কি খবর রাখো না , নাকি বলতে লজ্জা হচ্ছে।
– বাবা খুব সিরিয়াস হয়ে বললেন , আপনি কি বলতে চাইছেন বলুন তো ?
– হাট পাড়ার টিমটিমে মুদি দোকানের মেয়ের সাথে তো ছেলেকে দেখা যায় প্রায়ই , খোঁজ নিয়ে জানলাম, ঐ শাক-ভাত টাও জোটে না রোজ দিন । তা খাওয়া পড়ার অভাবেই কি মেয়েটা ঘাড়ে চাপতে চাইছে, নাকি ছেলেই পছন্দ করল । আরে মশাই একটা রুচি বলে তো ব্যাপার আছে নাকি ! সে মেয়ে যতই সুশ্রী হোক , বেয়াইয়ের পরিচয় দিতে পারবে তো পরিবার-পরিজনদের কাছে ? ননী জেঠু নিজের অপমানের প্রতিশোধ নিয়ে চলে গেলেন। বছর তিনেক আগে ভাইয়ের জন্য নিজের শালীর মেয়ের কথা বলেছিলেন , ভাই রাজি হয়নি , সেই অপমানটা বোধহয় উনি আজও মনে রেখেছেন ।

এই পরিস্থিতিতে বাবার মুখের উপর ‘ও’ কি বলবে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না ! ছেলেমেয়ে মানুষ করার পর বাবা-মার ইচ্ছে থাকে নিজের হাতে তাদের বিয়ে দেবেন , সেই স্বপ্ন যখন ভেঙে যায় তখন আঘাত তো লাগেই । কিন্তু সেই সাথে ঐ বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে যদি কিছু পাওয়ার ইচ্ছেও থাকে, তাহলে সেই আঘাত বড়ো মারাত্মক হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হল না । ভাইও নিজের পছন্দের মেয়েকেই ঘরে এনেছে , কিন্তু সুবিধেটা হল বড়ো ঘরের মেয়ে , বাবার বড়ো ব্যবসা , প্রভাবশালী লোকেদের সাথে ওঠা-বসা, না চাইতেই ওদের ঘর ভরে যায় জিনিসপত্রে, বিয়ের সময়েও ট্রাক ভরে যৌতুক এসেছে , তাই কোনো সমস্যাই তৈরি হয়নি। সমস্যা যেটা হয়েছে সেটা মনের গভীরে, একজনের জন্য এতকিছু লাভ করার পর অন্য আর এক ছেলের জন্যও প্রায় একই রকম চাহিদা তৈরি হয়ে গেছে মনে মনে । কিন্তু এখানে তো তা কোনোভাবেই সম্ভব নয় ।ঐ ছোট্ট দোকানের উপর পাঁচটা পেট , তিন ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ , তারপরে যৌতুক !! অর্পণ জানে সে অসম্ভব , আর সেই কারণেই বহুবার সরে যেতে চেয়েছিল নীভা । বাড়িতে নিয়ে গিয়েও দেখিয়েছিল ওদের অবস্থা , তবু সরে যেতে পারে নি অর্পণ , কেন যাবে , ‘ও’ তো ভালোবাসে নীভাকে , ওর বাবার পয়সায় ওর কি আসে যায় , ও তো নিজে রোজগার করে এবং সেটা সংসার চালানোর জন্য যথেষ্ট । মানুষ গুলোর সাথে কথা বলে এটুকু বুঝেছিল সৎ আর ভদ্র , লোভী নয় , ভাগ্য বিপর্যয় তো কত জনেরই হয় , অভাবকে হজম করে সৎ পথে থাকার মতো মনোভাব-ই বা ক’জনের হয় ! কেন যে অর্থটাই সমাজের ভালো খারাপের মাপকাঠি হয়ে উঠেছে !! সব থেকেও পয়সার অভাবে এরা ব্রাত্য ।

সেদিনের চরম অপমানের পর বাবাকে কিছু বলার মতো , বোঝানোর মতো ভাষা খুঁজে পায় নি অর্পণ । বাবা বলে দিয়েছিলেন – “এ বাড়িতে থাকতে হলে ঐ মেয়েকে ত্যাগ করতে হবে , নয়তো নিজের রাস্তা দেখে নিও , আমি জানব আমার একটাই ছেলে “।

পরের দিন অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিল অর্পণ , পারে নি । মা সবটা শুনে বলেছিলেন আমার আশীর্বাদ সবসময় থাকবে জেনো , কিন্তু তোমার বাবাকে রাজি করানোর ক্ষমতা আমার নেই, সে তুমি জানো । এখন তো ভাই-ও বেঁকে বসেছে, ওর শশুরের-ও নাকি খুব অসম্মান হবে এতে । চমকে উঠলো অর্পণ , ভাই ও ! ছোটো ভাইয়ের থেকে কটু কথা শোনার মতো মনের জোর আর ওর ছিল না । বাবার অসম্মতির সুযোগ-কে পূর্ণ মাত্রায় কাজে লাগিয়ে পরিস্থিতি-কে দিন দিন আরও বিষিয়ে দিচ্ছিল তার নিজের ভাই আর তার শশুর বাড়ির লোকজন। অনেক ভেবেছে অর্পণ , কিন্তু বাড়ি ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনো রাস্তা দেখতে পায় নি সে , তার ভালো থাকার জন্য একটা মেয়ের এতবড় ক্ষতি সে করতে পারবে না , তাও আবার গরীবের মেয়ে , এদের তো সমাজে ভালো ভাবে বেঁচে থাকারই কোনো অধিকার নেই , সেটাই তো সে বুঝলো এই দু’দিনে ,তার উপর যদি একবার বদনাম হয় তাহলে তো আর কথাই নেই । ভাবলো কয়েকটা মাস হয়তো বাবা রেগে থাকবেন , তারপর নিশ্চয়ই কাছে ডেকে নেবেন।

এ সবই নীভা দেবী শুনেছিলেন বিয়ের অনেক দিন পরে । সব যন্ত্রণা একা হজম করে ভালোবাসায় ভরিয়ে রেখেছিল অর্পণ তাঁকে । জানালার গ্রিলে মাথা রেখে আবারও হারিয়ে গেলেন দূরে ।

ওদের বিয়ের দিন-টাও ছিল বৃহস্পতিবার , বিয়ের আগের দিন হঠাৎ-ই অর্পণ এসে মায়ের হাতে একটা বেনারসি আর কিছু প্রয়োজনীয় সামগ্রী তুলে দিয়ে বলেছিল , তাড়াতাড়ি একজন পুরোহিতের ব্যবস্থা করুন , আমি কালই ওকে বিয়ে করতে চাই , বাকি কথা পরে হবে , আমি এখন আসি।কাউকে কিছু বলতে না দিয়েই বেরিয়ে গিয়েছিল , ফিরল অনেক রাতে । বাবা তখন কাছের লক্ষ্মী-নারায়ণ মন্দিরে ব্যবস্থা করেছেন বিয়ের , আগামীকাল বিকেল পাঁচটায় শুভক্ষণ । এত খুশির খবরে খুশি হয়েছিল শুধু ভাই-বোন দুটো , অত তলিয়ে ভাবার মতো বুদ্ধি হয়নি তো তখনও , বাবা-মা মরে আছেন মরমে , বুঝতে তো পারছেন, তাঁদের সম্পর্কে কি ভাবছেন অর্পণের বাড়ির লোকজন ।
অর্পণের বাবা-মা’র আশীর্বাদ ছাড়াই বিয়ে হয়ে গেল ওদের বিনা আড়ম্বরে , বাবার শত অনুরোধেও ওদের বাড়িতে যেতে দেয়নি অর্পণ, আসলে ‘ও’ জানতো অপমান ছাড়া আর তো কিছু মিলবে না সেখানে । পরের দিন সকালে গিয়েছিল ওরা ও-বাড়িতে , ঢুকতে দেয় নি ভাই-ভাইয়ের বৌ । বাবার সাথে দেখা হওয়া তো দূরের কথা, মা’কেও একটিবার কাছে আসতে দিল না । নীভার হাতটা ধরে বাড়ির গেট পেরোতে গিয়ে কেঁপে উঠলো অর্পণ , কষ্টে অপমানে ওর বুকের ভিতরটা তখন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে , নীভার মনেও এমনই কোনো পরিণতির আশঙ্কা উঁকি দিচ্ছিল, অপরাধী মনটা নিয়ে ভবিষ্যতের আশঙ্কায় আরও জোরে চেপে ধরল অর্পণের হাত দুটো ।

অটোয় উঠে , একবার উপরের বারান্দায় চেয়েছিল ওরা দুজন , আর একটা মানুষও তখন নিজের অর্ধেক হৃৎপিণ্ড বিসর্জন দিয়ে , দাঁড়িয়ে আছেন তাদেরই দিকে চেয়ে , চোখের জলে ঝাপসা দৃষ্টি পরিষ্কার করে আবারও চাইলো ওরা পরস্পরের দিকে , মা আশীর্বাদ করলেন দু’হাত তুলে দূর থেকে। এই মা’কে ছোঁয়ার , তাঁর কাছে আসার অধিকার-টাও হারিয়ে গেলো আজ থেকে । (ক্রমশ)


তৃতীয় পর্ব আগামীকাল

Related posts

ইন্টারনেট পরিষেবা ঠিক রাখার জন্য সোশ্যাল নেটওর্য়াকে লাগাম

E Zero Point

করোনার রিপোর্ট তলব হাইকোর্টের

E Zero Point

দিল্লির তবলিঘ-ই-জামাত থেকে কে কে পশ্চিমবঙ্গে ফিরেছেন? জেলায় জেলায় চলছে খোঁজ

E Zero Point

3 মন্তব্য

মতামত দিন