সুতপা দত্ত
প্রথম পর্বঃ ধারাবাহিক গল্পঃ নীভা থেকে নীভাদেবী হয়ে ওঠার কাহিনী (প্রথম পর্ব) ~ সুতপা দত্ত
দ্বিতীয় পর্বঃ ধারাবাহিক গল্পঃ নীভা থেকে নীভাদেবী হয়ে ওঠার কাহিনী (দ্বিতীয় পর্ব) ~ সুতপা দত্ত
তৃতীয় পর্ব
তাদের ভাড়া বাড়িতে একটাই ঘর , ছোটো একটা রান্নাঘর, মাঝে খানিকটা ড্রইং ডাইনিং,আর একটা লম্বা বারান্দা, এই তাদের নতুন সংসার । অবাক হয়ে দেখেছিল নীভা, প্রয়োজনীয় সামগ্রীর প্রায় সবটাই গুছিয়ে রাখা , তার মানে অর্পণ প্রস্তুতি নিচ্ছিল অনেক আগে থেকেই। ঐ ঘরেই হয়েছিল ওদের বাসর সজ্জা । ভাই-বোন দুটো খুব আনন্দ করেছিল ওদেরকে ঘিরে। সেদিন রাতে অর্পণ বলেছিল,
-তোমার মতো আমিও এসেছি সব ছেড়ে তোমার কাছে , আমরা একে অপরকে জড়িয়েই বাঁচব নীভা , হারিয়ে যেও না কখনও আমার জীবন থেকে ।
ভাবতে ভাবতেই এগিয়ে গেলেন আলমারি-টার দিকে , চাবি ঘুরিয়ে আলমারি থেকে বের করে আনলেন বিয়ের বেনারসি-টা , নাকের সামনে এনে প্রাণ ভরে ঘ্রাণ নিলেন, যেন এখনও সেখানে লেগে আছে নতুন বিয়ের গন্ধ, অর্পণের ছোঁয়া , বুকে চেপে ধরে চোখের জলে ভেসে গেলেন নীভা দেবী ।
ঐ রাজপ্রাসাদে অল্পদিনে সুখ পেয়েছিল প্রচুর । অর্পণ সব কষ্ট দুঃখ দূরে সরিয়ে রেখে , সবসময় চেষ্টা করেছে ওকে ভালো রাখার। দু’বছরের মধ্যেই বাপাই এলো ওদের জীবনে , মা-বাবা , শশুর-শাশুড়ি সকলের ভূমিকাই নিপুণ ভাবে পালন করেছিল অর্পণ , একটা মানুষ এতোও ভালো বাসতে পারে !! কিন্তু সে যে বড্ড অভাগা , সইলো না এত সুখ তার কপালে। অর্পণ বলেছিল ,
-ছেলে হলে নাম রাখব সৌরভ , আর মেয়ে হলে সুরভী , আমাদের ভালোবাসার সুগন্ধে ঘর ভরে থাকবে , খুব যত্নে মানুষ করব ওদের ।
সেই ছেলের জীবন থেকেও মুছে গেলো পিতৃ প্রেম এক নিমেষে। হারিয়ে গেলো তার বাবা , হারিয়ে গেলো চিরদিনের জন্যে । ছেলের জন্য টেডি কিনে বাসে ওঠার আগেই বাইকের ধাক্কা , টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গিয়েছিল, কোথাও লাগে নি , কোনো কাঁটা ছেড়া নেই , শুধু মাথার পিছনটা জোরে ঠুকে গিয়েছিল পাশের পোলে।
-এইটুকু আঘাতে কি মানুষ মরে যায় !
-বলো , এইটুকু আঘাতে কি কেউ চলে যায় চিরতরে !
-ছেলে , তোমার ছেলেকে কে দেখবে !
-আমি ! আমার কি হবে !
-আমি কার কাছে থাকব ! সেদিন সারা রাত এই কথাগুলো আউরে চলেছিল নীভা , পাগলের মতো ঝাঁকিয়ে চলেছিল নিথর দেহটা-কে , ভাবছিল এই বুঝি উঠে বসে বুকে জড়িয়ে বলবে , ‘কিছু হয়নি আমার তুমি চুপ করো ‘।
সারা রাতের বুক ফাটা কান্নাতেও উঠে বসে নি অর্পণ । মৃতপ্রায় নীভাকে বাড়ি ফিরিয়ে এনেছিল আত্মীয় স্বজন, বডি চলে গিয়েছিল পোস্ট মর্টমে, ছেলেকে জড়িয়ে ধরে জ্ঞান হারিয়েছিল নীভা।
পরের দিন শশ্মানে যাওয়ার আগে এসেছিল অর্পণের বাড়ির লোকজন । অহং মানুষ কে বড্ড অমানুষ করে তোলে , বাপ-মার স্নেহ ভালোবাসাও হেরে যায় ঐ অহং – এরই কাছে । তাই সেদিন ঐ শোকের মধ্যেও ওরা নীভাকেই গালি গালাজ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল ,
-ঐ অলুক্ষণে মেয়েই দায়ী আজকের পরিস্থিতির জন্য। তাদের কথা যদি একটিবার শুনতো তাহলে তাদের ছেলে আজ বেঁচে থাকত । যেন বাঁচা- মরা টাও মানুষেরই হাতে !!
পাঁচ বছরের জন্মদিনের আগেই বাবাকে হারালো বাপাই , জন্মদিনে একটা সাদা বড়ো টেডি চেয়েছিল বাপাই, হসপিটালের বেডের পাশে রাখা ছিল ধূলো মাখা টেডিটা , পরে শুনেছিল তার মা ওটা তুলে এনে ধুয়ে মুছে বাপাইকে দিয়েছিলেন , ভাগ্যিস মা তুলে এনেছিলেন তাই তো বাপাই আজও বাবার শেষ স্মৃতি , তাকে দেওয়া বাবার শেষ উপহার হিসেবে যত্ন করে নিজের কাছে রাখতে পেরেছে । ছোটো বেলায় ওকে আর একপাশে রেখে জড়িয়ে শুতো , বলতো- ‘বাবিন আছে এর ভিতরে’। আজও রওনা দেওয়ার আগে ওর সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল । সেদিন ওরা নীভার তো নয়ই বাপাইয়েরও মুখে আগুনটুকু দেওয়ার অধিকার নেই বলে জানিয়ে দিয়েছিল। অনেক অশান্তির পর , অফিসের লোকজন, পাড়া-প্রতিবেশী আর পুরোহিত কাকার হস্তক্ষেপে ছেলের হাতের ছোঁয়া পেয়েছিল অর্পণ চিরদিনের মতো ভস্মীভূত হয়ে যাওয়ার আগে।
কাজ মিটতে না মিটতেই আবারও হাজির হয়েছিল ওরা ঐ ভাড়া বাড়িতে – শশুর , দেওর আর দেওরের শশুর মিলে, বংশধরের অধিকার নিতে । ওনার ছোটো ছেলে নাকি দত্তক নিয়ে মানুষ করতে চায় সৌরভ-কে । সিঁদুর মুছেছে এক সপ্তাহও হয় নি , এরই মধ্যে অসভ্য, সুবিধেবাদী মহিলার বদনামও জুটে গেল অচিরেই , আর ঠিক এই কারণেই তারা চায় তাদের বংশধরকে নিয়ে যেতে , যে বংশধরের মুখ পাঁচ বছরে একবারও দেখতে ইচ্ছে হয় নি । সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে , একটা দিনও মিলছে না নিজেকে সামলানোর , একটার পর একটা চাবুক এসে পড়ছে সজোরে। যখন ছেলেকে কি করে নিজের কাছে ধরে রাখবে সেই চিন্তায় পাগল , ঠিক তখনই আর এক খাঁড়া নেমে এসেছিল ওর উপরে। বাড়িওয়ালা বলে দিল – বাড়ি ছাড়তে । শত অনুরোধেও বরফ গললো না এতটুকু। তাঁর অকাট্য যুক্তি , তিনি নিশ্চিত – এই অল্প বয়সী মেয়ে একদিন না একদিন কাউকে ঘরে এনে ঢোকাবেই , তাই অকারণ ঝামেলা তিনি চান না , এটা ভদ্রলোকের বাড়ি।
কি অদ্ভুত তাই না ! কত সহজ মানুষের বিচার। যে ফ্যামিলিটা আজ সাত বছর ধরে এই বাড়িতে সংসার করছে , যাদের নিজের হাতের তালুর মতো চেনেন ওনারা , যারা তাদের প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ছুটে গেছে এক ডাকে , সেই মানুষ দু’টোর মধ্যে একটা মানুষের অনুপস্থিতি অন্য মানুষটাকে এতটাই কি অচেনা করে তোলে , যাকে আর এতটুকুও বিশ্বাস করা যায় না ! নাকি সেই মানুষটা শুধুমাত্র মহিলা বলেই তার সাথে এমন বিচার করা হয় !! আজ যদি অন্যদের মতো তার বাপ-ভাইয়েরও পয়সার জোর থাকত , তাহলে হয়তো কিছু বলার আগে দু’বার ভাবতো । কিন্তু তার যে সে উপায়ও নেই । ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে , বোন আছে , অসুস্থ বাবা , নিজেদেরই থাকার জায়গা নেই , তো ওর ভার কি করে নেবে ! ভাইটা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে , সাধ্যমতো করছে তো , আর কি-ই বা বলে।
অফিসের লোকজনও তো কম করে নি । অর্পণের বস-ও এসে দেখা করেছেন , আশ্বাস দিয়েছেন টাকা পয়সার জন্য কোনো দৌড় ঝাঁপের প্রয়োজন নেই , উনি ব্যবস্থা করে দেবেন। আর কি-ই বা করবেন , ওর নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা যে টুয়েলভেই থেমে গিয়েছিল , তাই চাকরির কোনো ব্যবস্থা করা ঐ অফিসে সম্ভবই ছিল না। (ক্রমশ)
চতুর্থ পর্ব আগামীকাল