28/03/2024 : 6:05 PM
রবিবারের আড্ডাসাহিত্য

জিরো পয়েন্ট রবিবারের আড্ডা ~ রমলা মুখার্জী | মোঃ ইজাজ আহামেদ | গিয়াসুদ্দিন আহমেদ | সুতপা দত্ত | অর্পিতা চ্যাটার্জ্জী | মনোজ কুমার রায় | সৈয়দ রিজাউল ইসলাম | পরিতোষ বর্ম্মন ~

গল্প


 “করোনা – একটা ধন্যবাদ তোমার প্রাপ্য”

✒ সুতপা দত্ত

রোজকার এই এক ঝামেলা ,অসহ্য লাগে । ত্রিশ মিনিটের রাস্তা দেড়ঘণ্টায় , বলতে বলতে চোখে জল এসে গেল রিমির। একে তো বেরোতে দেরী তার উপর এই জ্যাম , কত রাত হয়ে গেল , এর মধ্যে যদি আবার লোডশেডিং হয়ে যায়!! অজানা আশঙ্কায় , ভয়ে কেঁদেই ফেলল রিমি । অটো স্ট্যান্ড থেকে বাড়ির রাস্তা প্রায় মিনিট সাতেক পায়ে হেঁটে , নতুন বসতি গড়ে উঠছে এদিকটায় , তাই বেশ ফাঁকা ফাঁকা । সন্ধ্যা সাতটার পর একা হাঁটতে বেশ অস্বস্তি হয় , আর এখন তো রাত প্রায় ন’টা ।

আর একটা গলি , তারপরই তে-মাথার মোড় , একদৌড়ে বাড়ির সামনে পৌঁছে যাবে । যত ভাবছে , তত একটা ভয় চেপে বসছে মনে , বারবার পিছনে দেখছে আর যতটা সম্ভব জোরে হাঁটার চেষ্টা করছে । কিন্তু কেন জানে না , কাঙ্খিত গতি কিছুতেই পাচ্ছে না , রাস্তা শেষই হচ্ছে না ।

শেষ গলিতে পা দিতেই বুকের ভিতরটা কেমন খালি হয়ে গেল , অজানা ভয়ে পা’দুটো কেঁপে উঠল । যা ভেবেছিল তাই , মাঝামাঝি আসতেই দুটো ছায়া মূর্তির মুখোমুখি হল রিমি , পাশ কাটিয়ে দৌড়াতে যেতেই ধরে ফেলল ওরা , প্রবল হ্যাঁচকা টানে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করল রিমি , পিছনে ততধিক জোরে ওরা । ঐ তো , ঐ তো তে-মাথার মোড় , চিৎকার করে ডাকবে মা’কে , নিশ্চয়ই শুনতে পাবে!
আর পারছে না , আর কিছুতেই পারছে না , সব শক্তি এক জায়গায় এনেও পা’দুটো-কে টানতে পারছে না । উফ্ আজ আর নিষ্কৃতি নেই । সব শেষ হয়ে যাবে সব _ শেষ বারের মতো মনের জোর একত্র করে চিৎকার করে উঠল রিমি। কোথায় কে !! এই সন্ধ্যা রাতেই যেন অনন্ত ঘুমের কোলে গোটা পাড়া । নিশ্চিন্ততা আর নিঃস্তব্ধতা প্রতিটি বাড়ির কোলে , শুধু সে-ই আজ সর্বস্ব খুইয়ে মৃত্যুর মুখে !!

ধরে ফেলল ওরা , সেই মুহুর্তেই উল্টো দিকের গলি থেকে উড়ে এলো গাড়িটা , মুহুর্তে ছুঁড়ে ফেলল ওকে গাড়ির ভিতরে । সেখানে তখন ওর সর্বনাশের অপেক্ষায় মনীশ – অতুল , ইভটিজিং এর প্রতিবাদ স্বরূপ জনবহুল রাস্তায় গালে চড় মেরেছিল রিমি ওদের । সাথে ছিল লেখা আর স্মৃতি-ও , সটকে গিয়েছিল ঠিক সময়ে , অথচ প্রতিবাদটা ওদের জন্যই করেছিল সেদিন রিমি । উত্তপ্ত কথাবার্তার পর চলে তো ওরা গিয়েছিল , তবে ফিরে এসেছিল পরদিনই । হুমকি-টাও মুখোমুখিই দিয়েছিল ওরা -” তুলে নেবে ” ।

আগের দিনের প্ল্যানটা ভেস্তে দিয়েছিল সেদিনের সেই অটো ড্রাইভার মোক্তার চাচা । রিমি বলতেই উনি বুঝতে পেরেছিলেন এরা কোনো মতলবে আছে , তাই সেদিন অটো নিয়ে রিমিকে বাড়ির দরজায় ছেড়ে গিয়েছিলেন। বাবা বলেছিলেন , সেদিনই ওনাকে সারা মাসের জন্য বুক করে নিতে , কিন্তু প্রতি মাসে এতগুলো টাকা কোথা থেকে জোগাবে , তাই আর বলা হয় নি । আজ মনে হচ্ছে -‘ আধ পেটা খেয়েও যদি বুক করে নিত সেদিন ! ’

গাড়িটা মিলিয়ে গেল অন্ধকারে , আর কিছু মনে নেই রিমির । হঠাৎ চোখের উপর জোড়ালো আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে উঠল রিমির। সারা গা ঘামে জবজব করছে , মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে যন্ত্রণায় । কারোর স্পর্শে চমকে উঠে চিৎকার করে উঠল রিমি । মা তখন ওকে জড়িয়ে ধরেছেন চেপে , মায়ের বুকের ওমে সম্বিৎ এলো ধীরে ধীরে । চোখে মুখে জল হাত বুলিয়ে দিয়ে , জল খাওয়ালেন মৃদুলা দেবী , রিমির মা ।

বাবা – তুই চাকরিটা ছেড়ে দে মা । পেনশনের পয়সায় যা জুটবে তাই খাব , তোকে হারাতে পারব না রে মা ।

রিমি জানে – এটা সম্ভব নয় কোনোভাবেই । বাবার ওষুধেই চলে যায় অনেকগুলো টাকা , তারপর সংসার । পুঁজির পয়সা তো বাড়ির পিছনেই প্রায় শেষ। যেটুকু আছে তা দু’দিনেই ফুরিয়ে যাবে । তাছাড়া এত পরিশ্রম , ছোটো থেকে দেখা স্বপ্ন – সব শেষ হয়ে যাবে ! সব ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে বসে থাকবে !! কেন ! এই পৃথিবীটা কি ওদের বাসযোগ্য নয় ! ওদের স্বপ্ন সাকার করার জায়গা নয় ! শুধু পড়ে পড়ে মার খাবে ! আর অপরের ইচ্ছেয় , অন্যের দেখানো ভয়ে ভীত হয়ে প্রতি মুহুর্তে তিল তিল করে মরবে !!

না , বাবা চাকরি ছাড়ার কথা বারবার বললেও চাকরিটা ছাড়ে নি রিমি । বিএসসি-র পর নার্সিং ট্রেনিং নিয়ে বছর দু’য়েক কাজে যোগ দিয়েছে সে , এরই মধ্যে বেশ সুনামও করেছে । পাশাপাশি চলছে স্বপ্ন পূরণের প্রচেষ্টা , ওর খুব শখ নার্সিং কলেজে পড়ানোর । সুচিত্রা ম্যাডাম এই স্বপ্নটা এঁকে দিয়েছিলেন ওর চোখে , তারপর থেকে ঘুমে , জাগরনে কখনও হাতছাড়া করে নি স্বপ্ন-টাকে ।

কিন্তু এই দুঃস্বপ্ন ! তার পরম শান্তির ঘুমকে নষ্ট করে বারবার হানা দিচ্ছে মনের গভীরে । কি ভাবে বেরোবে এই অন্ধকার থেকে! সে তো ভয় পেয়ে বসে নেই । প্রথম এটেম্প্টের পরে পরেই লকডাউন ঘোষণা হয়েছিল , কয়েকদিন ব্যক্তিগত ছুটি নিয়ে বাড়িতে থাকার পরেই জয়েন করেছিল আবার । আজও ডিউটি করে এসেছে । বাড়তি সতর্কতা মেনে আলাদা ঘরে শোয় রিমি , নিজের কোনো জিনিসে হাত দিতে দেয় না মা-বাবা কে । আর আজ তার চিৎকারে মা-বাবা সবাই তারই বিছানায় তারই সাথে ! উফ্ আর ভাবতে পারে না ! কিছু হলে নিজেকে ক্ষমাও করতে পারবে না রিমি ।

অথচ , আজ দু’মাস হয়ে গেছে ,একদিনও কিন্তু ঐ জানোয়ার গুলোকে ওর আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখেনি রিমি । নিজের মনেই হেসে উঠলো ও – ভয় , ভয় । মৃত্যুভয় । ও এখন সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত ওদের কাছে । আসবে কোন সাহসে !! ঠিক এই ভয়টা , এই মৃত্যু ভয়টাই ওদের ভিতরে ঢুকিয়ে দিতে হবে আমৃত্যু । আজ ভাইরাসের ত্রাসে কাঁপতে থাকা প্রতিটি ধর্ষক গর্তের ভিতর মুখ লুকিয়েছে প্রাণের ভয়ে। ধন্যবাদ তো ঐ মৃত্যুদূত “করোনা” – কে দেওয়া উচিত , যার উপস্থিতির জেরে আজ মাসাধিক কাল কত শত রিমি স্বীকার হয় নি ওই পাশবিক অত্যাচারের , খোয়ায় নি প্রাণ , মাথা কুটতে হয় নি মান্ধাতা আমলের ঘুণ ধরা বিচার ব্যবস্থার দোরে দোরে সুবিচারের আশায় , খোয়াতে হয় নি মান দ্বিতীয়বার আবার ঐ কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ।

তবু কি শিখবে কিছু মানুষ , এই পরিস্থিতি থেকে !! বুঝবেন কি সমাজের মাথারা !! ভাববেন কি এমন কোনো শাস্তিভয় এর ব্যাপারে , যা ঐ ধর্ষকদের ভিতর ঢুকিয়ে দেওয়া যায় , যা মৃত্যু ভয়ের সমান !! যে সমাজের অর্ধেক ভার নারীরা একা বহন করে , তাদের সুরক্ষার দায়িত্ব কি সমাজের নয় !! যদি ‘না’-ই হয় উত্তর , তাহলে আজ থেকে প্রতিটি নারী নিজেদের শক্তিরূপিনী করে গড়ে তোলো । মৃত্যুভয় জাগিয়ে তোলো ঐ শয়তানদের মনের ভিতরের কাল কুঠুরিতে , যাতে অত্যাচার করার কথা ভাবতেও কেঁপে উঠবে বারবার । প্রকৃতি শিক্ষা দিচ্ছে , দিশা দেখাচ্ছে , সেই শিক্ষাকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে পারলে তবেই তো হবে জয় । পারব না কি আমরা !! চেষ্টা তো করি প্রাণ দিয়ে !!!♥


রবিবারের আড্ডায় লেখা পাঠাতে হলে zeropointpublication@gmail.com
ইমেইল এড্রেসে টাইপ করে পাঠান। অবশ্যই লেখাটি অপ্রকাশিত হতে হবে।

পাঠকের মতামত লেখক ও প্রকাশকের পাথেয়, তাই অবশ্যই নীচের কমেন্ট বক্সে মন্তব্য করুন ও শেয়ার করুন

Related posts

দৈনিক কবিতাঃ মধ্যবিত্ত

E Zero Point

কবিতাঃ সুরের ঝর্ণাধারা

E Zero Point

দৈনিক কবিতাঃ নিস্তব্ধ কলকাতার বুক – আমিরুল ইসলাম

E Zero Point

মতামত দিন