25/04/2024 : 9:01 AM
রবিবারের আড্ডাসাহিত্য

জিরো পয়েন্ট রবিবারের আড্ডা ~ রমলা মুখার্জী | মোঃ ইজাজ আহামেদ | গিয়াসুদ্দিন আহমেদ | সুতপা দত্ত | অর্পিতা চ্যাটার্জ্জী | মনোজ কুমার রায় | সৈয়দ রিজাউল ইসলাম | পরিতোষ বর্ম্মন ~

প্রবন্ধ


কাজী নজরুল রচিত শ্যামা সঙ্গীত


 ✒ কলাশ্রী পরিতোষ বর্ম্মন

উনবিংশ শতাব্দীর মধ্য ও বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভকালকে ভারতবর্ষের সুবর্ণযোগ বলা যেতে পারে। সেই সময়ে বহু সমাজ সংস্কারক, দেশ প্রেমিক ও সাহিত্যিক, কবি ও গীতিকার তাদের অকৃপণ সেবা ও স্বীয় সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে গৌরবের সাক্ষর রেখে গেছেন। তাদের মধ্যে সাম্যবাদী- নীপিড়িত-শোষিত মানুষদের কবি কাজী নজরুল রাত্রি শেষের শুকতারার মতো হঠাত করে ভারতবর্ষের সংস্কারার্থে বাংলা মাতৃভাষার কাব্যাকাশে উদয় হয়েছিলেন ধূমকেতুর মতো। স্বল্প পরিসরে যে অভূতপূর্ব কাব্যপ্রতিভা বিশেষ করে অনিন্দ্যসুন্দর সুরভৈববের ডালা সাজিয়ে দিয়ে গেছেন, তা অকল্পনীয়।
নজরুল সাহিত্য তথা সাঙ্গীতিক চর্চ্চা করতে গিয়ে জানতে পারি যে কাজী নজরুল ইসলামই সর্ব্ব প্রথম বাংলা প্রেম সঙ্গীত (গজল গান)-কে প্রাচ্যের সঙ্গীতাকাশ হতে আমন্ত্রিত করে বাংলা গানের জগতে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। প্রেমসঙ্গীতে এমন বলিষ্ঠতা ও নির্মল আনন্দের প্রকাশ নজরুল সঙ্গীত ছাড়া আর কোনও বাংলা গানে শোনা যায় না। নজরুলের সৃষ্ট প্রেমসঙ্গীত বা গজল গানে প্রেমের বিভিন্ন অবস্থা- বিরহ-ব্যর্থতা, আশা-নিরাশা, মিলন-অভিসার এবং মানবিক প্রেমের মধূর জটিলতা তার গানে এক অনিন্দ্য সুন্দর রূপে দেখা দিয়েছে। সেই দিক দিয়ে নজরুলের প্রেমসঙ্গীতকে স্রষ্ঠার অনবদ্য সৃষ্ঠি বলা যায়। তবে ক্ষেত্র বিশেষে ভাষা ও সুরের চাপল্যতা মনকে মাঝে মাঝে ঈষত পীড়া দেয়।
রবীন্দ্র সৃষ্ঠ প্রেম পর্যায়ের গান নৈসর্গিক প্রেমাভিসার থেকে মুক্তি পেয়ে পূজার শূচীতায় ভাস্বর। আর কবি নজরুলের প্রেম সঙ্গীত তার জীবনের রুদ্র বীণার ঝঙ্কারে স্বর্গীয় প্রেমচিন্তা অণুরণিত হয়ে এক দুর্লভ অপার্থিব সুরধূনীর সৃষ্টি করে মর্ত্ত্যলোককে করেছে তীর্থবতী। অতৃপ্ত চাওয়া পাওয়ার কামনা বাসনার দহণ জ্বালা পরমে উতসর্গীত হয়ে মুক্ত এবং তা পূজারই রূপান্তর বলা যায়।

নজরুল সৃষ্টিকে অনুধাবন করলে দেখা যায়– বিগত ত্রিশ দশকের শুরু থেকে ১৯৪২ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই প্রচূর পরিমাণে ভক্তি সঙ্গীত সৃষ্টি করেছেন। কবির ভক্তি সঙ্গীত অঙ্কণে ভক্তের ভক্তির চন্দনচর্চ্চিত পুষ্পের সুগন্ধ ও মননশীলতা স্বকীয়গুণে প্রতিভাত হয়ে আধ্যাত্মলোকের স্পন্দনে সদা জাগ্রত। দু:খই মানুষের জীবনরূপী ধূপকে জ্বালিয়ে চিরজাগ্রত সত্ত্বা ও সত্যের পথ দেখাতে সক্ষম, কবির জীবনের বাস্তব প্রতিফলন এই ভক্তি সঙ্গীত, নিশ্চিত।
প্রাণাধিক পুত্র বুলবুলের অকাল মৃত্যু এবং সহধর্মিণী প্রমীলা দেবীর পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ফলে যে চরম অন্তর্দাহ কবিমনকে মথিত করেছিল; তারই ফলে কবিমনে ভগবত চিন্তার উন্মেষ ঘটে। সেই সময় ঘটনাচক্রে গৃহীযোগী বরদাওচরণের সান্নিধ্যে আসেন ও তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তদপশ্চাত কবি রুদ্ধকক্ষে কালীমূর্ত্তির সম্মূখে বসে যোগসাধনায় নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন। বস্তুত: তখন থেকেই কবির ভক্তিসঙ্গীতের সৃষ্টি হয়। এবং বৈষ্ণব- শাক্ত ও ইসলাম ধর্ম্মভিত্তিতে সঙ্গীত রচনা করেন। এমন সঙ্গীত সুধা একান্তে নিবেদিত ভক্তমনের ভক্তিরসসিক্ত এক অনবৈদ্য নৈবেদ্য স্বরূপ, দু:খভরা জীবনধূপের সুগন্ধ ও অন্তর-বীণাতন্ত্রের আত্মনিবেদিত সমর্পণের মূর্চ্ছনায় অণুরণিত তার এই ভক্তি সঙ্গীত গুলো যে কোনও সাধক প্রাণ সাধু-সন্তদের চিন্তার সমতূল্য। কবির সকলদিক অনুধাবনে দেখা যায়– শেষ জীবনে সমাজবাদী, সাম্যবাদী কবির ক্ষুরধার লেখনী অসি থেকে বাঁশীতে রূপান্তরিত হয়ে যে অভাবিত ভক্তি রসের জোয়ার এবেছিল; তা ভক্ত রামপ্রসাদ সেনের পর আর কোনও ভক্তের দ্বারা সম্ভব হয়নি বলেই আমার বিশ্বাস।
কবির আত্ম সমর্পিত রসোত্তীর্ণ ভাবরূপে, ঐহিক চাওয়া পাওয়ার নিগঢ়ে বন্দী না হয়ে চিরজাগ্রত সত্য সুন্দর রূপসায়রের উদ্দেশ্যে ধাবমান। ভক্তের ভক্তি নিবেদিত মনোলোকের স্পন্দনে স্পন্দিত শ্যামাসঙ্গীত গুলো মাতৃরূপী কালী-করালীর মৃন্ময়ী রূপ চিদানন্দ চিন্ময়ী রূপে প্রতিভাত হয়ে ভক্তিরস রূপাঙ্কনে উদ্ভাসিত,যা ভক্তমনের ভক্তি তন্ময়তার এক অভিনব অনিন্দ্যসুন্দর রূপায়ণে ভাস্বর।
সাধক রামপ্রসাদের পরবর্ত্তীকালে ভক্তিরস, ভাব ও সুরবৈচিত্র‍্যে আপ্লুত, স্বকীয়তায় প্রাঞ্জল এমন শ্যামা সঙ্গীত কবি নজরুল ছাড়া আর কেউ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন কি না; তা যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রাখে। এমন সৃষ্টি ভক্তের সাথে ভক্তির মিলনেই একমাত্র সম্ভব। জীবন বেলার পরম লগ্নে জবারূপী রাঙা মন, চরম- পরম সত্ত্বার জাগ্রত স্পন্দন, ঐশী প্রেরণার ফলশ্রুতি নজরুল সৃষ্ট শ্যামা সঙ্গীত।

কাজী নজরুল ইসলাম মূলত: শক্তির উপাসক। তার জীবনে এই অন্তর্নিহিত শক্তির উতস নানান খাতে প্রবাহিত হয়ে জন্ম দিয়েছে স্বাধীনতা কামী মানুষের মন্ত্র,যা দেশপ্রেমিক কবির দেশাত্মবোধক গানের মধ্যে সম্পৃক্ত।
শ্রীশ্রীশ্রীচণ্ডীতে বর্ণিত আদ্যাশক্তির মূল তিনটি রূপ- মধূ-কৈটভনাশী, দনুজ-দলনী শ্রীশ্রী মহাকালী ও ক্রোধবহ্নি অপসারিকা শান্তির প্রতীক শ্রীশ্রী মহালক্ষ্মী এবং সরস্বতী, যিনি প্রজ্ঞার আলোকে অসুন্দরকে বিধৌত করে সুন্দরের প্রতিষ্টাত্রী। উক্ত রূপগুলো কবির রচিত শ্যামা সঙ্গীতে প্রতিভাত হয়ে এক অবিস্মরণীয় ভক্তমনের ভক্তির অর্ঘ্যস্বরূপ বিভিন্ন রসপ্রস্রবণ এবং বৈভবে সিক্ত। অসাধারণ। কাজী নজরুল শ্যামাওসঙ্গীতের নতুন সুরের স্রষ্টা কিম্বা দ্রষ্টা নন, তিনি তার গানে হৃদয়ের দরদ এমনি করে মিশ্রণ ঘটিয়েছেন যে, রসের নিবিড়তায় তার গান ও রামপ্রসাদের গান প্রায় একাত্ম হয়ে গেছে। চিন্ময়ী সচ্চিদানন্দময়ী কুল কুণ্ডলিণী রূপে কালী মহিমা কীর্ত্তন করতে গিয়ে একদিকে মহাকালীকে লোলরসনা রণরঙ্গিণী মূর্ত্তিতে আহ্বান করেছেন। অন্যদিকে তাকেই স্নেহময়ী জননী, প্রেমময়ী মূর্ত্তিরূপে দেখেছেন। কবির কাছে কালী ও রাসবিহারী শ্যামে তফাত নেই। কখনো তিনি দনুজদলনী দল প্রহরণধারিণী, কখনো বা শ্বেতদল বাসিনী বিদ্যার অধিষ্টাত্রী দেবী।
কবির এ জাতীয় ভক্তি সঙ্গীতকে যদি আমরা চার ভাগে বিভাজিত করতে পারি—১) মহীমা কীর্ত্তন, ২)রণসঙ্গীত। ৩)সংসার ও বৈরাগ্য, ৪)করুণাভিক্ষা ও আত্মনিবেদন।
শ্যামসঙ্গীত রচনায় সাধক-গীতিকার নজরুলের যেন একটি সহজ স্ফূর্ত্তি ছিল, যা তার প্রত্যেক গানকে একাধারে মর্মস্পর্শী এবং রসোত্তীর্ণ করেছে। উপলব্ধির গভীরতায়,সহজ সাবলীল প্রকাশ ভঙ্গীর বৈশিষ্ট্যতায়, প্রেম-ভক্তির স্বতস্ফূর্ততায়, সমর্পিত হৃদয়ের ব্যকুলতায় কবি সৃষ্ট ভক্তি সঙ্গীত সাধক রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত প্রভৃতির গানের মতোই কালোত্তীর্ণ। এক কথায় মাতৃ সঙ্গীতের ক্ষেত্রে কাজী অজরুলকে সাধক রামরসাদ, কমলাকান্তের উত্তরসাধক বললে অত্যুক্তি হবে না।।


রবিবারের আড্ডায় লেখা পাঠাতে হলে zeropointpublication@gmail.com
ইমেইল এড্রেসে টাইপ করে পাঠান। অবশ্যই লেখাটি অপ্রকাশিত হতে হবে।

পাঠকের মতামত লেখক ও প্রকাশকের পাথেয়, তাই অবশ্যই নীচের কমেন্ট বক্সে মন্তব্য করুন ও শেয়ার করুন


বিশেষ কারণ বশত গত রবিবার, রবিবারের আড্ডা প্রকাশিত করা সম্ভব হয়নি।

 

Related posts

দৈনিক কবিতাঃ প্রকৃত বন্ধু

E Zero Point

নতুন বছরের শুরুতে পুরুলিয়ায় বৃত্তি প্রদান ও পত্রিকা প্রকাশ অনুষ্ঠান

E Zero Point

স্মৃতির আলোয়-১ : সুরতে খুবসুরত বাঙালি – অশোক মৈত্র

E Zero Point

মতামত দিন