18/04/2024 : 11:39 AM
অন্যান্য

e-জিরো পয়েন্ট – বৈশাখী ১৪২৭


|| *** ফিরে দেখা *** ||


বাংলা নতুন বছরের সেকাল–একাল

অজয় কুমার দে


“এসো হে বৈশাখ, এসো, এসো।
তাপস নিশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।”

পহেলা বৈশাখ বাঙালিদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। বাংলা বছরের প্রথম দিনটিকে বাঙালিরা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ হিসেবে পালন করে থাকে। এই নববর্ষ পৃথিবীর বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর একটি প্রাণের উৎসব, যার সাথে জড়িয়ে আছে দেশীয় ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি। বিশ্বের সকল প্রান্তের সকল বাঙালিরা পুরোনো বছরের দুঃখ, জরা, ক্লান্তি, গ্লানি ভুলে নতুনের প্রত্যাশায় নতুন সূর্যকে বরণ করে নেয় নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে। সূচনা হয় একটি নতুন বছরের।

পহেলা বৈশাখ পালন আধুনিক যুগের অবদান নয়। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস যা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে। এর সাথে জড়িয়ে আছে বাংলার অর্থনীতি ব্যবস্থা। প্রাচীনকালে অর্থনীতির প্রধান কেন্দ্র ছিল কৃষি এবং তা ছিল ঋতুধর্মী। কৃষির সকল কর্মকান্ড ছিল প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। তাই নববর্ষও ছিল একটি ঋতুধর্মী অনুষ্ঠান। কৃষির সুবিধার্থেই বাংলা সনের প্রবর্তণ করেন মোঘল সম্রাট জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর। এর কারণ হিসেবে জানা যায় সেই সময় কৃষির খাজনা আদায় করা হতো হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে যা ছিল চন্দ্র পরিক্রমার উপর নির্ভরশীল। আর সেটি ছিল কৃষি ফলনের সাথে অসামঞ্জস্য। তাতে সঠিক সময়ে কৃষকেরা খাজনা প্রদানে ব্যর্থ হতো। দেখা যেত যখন খাজনা দিতে হতো তখন ফসল কাটা শুরুই হয়নি। ফলে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দিত। এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতেই সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন যা সূর্যকেন্দ্রিয় এবং ঋতুর সামঞ্জস্যপূর্ণ। চন্দ্র কেন্দ্রিক তারিখ গণ
নার পরিবর্তে সূর্যকেন্দ্রিক ঋতুভিত্তিক তারিখ গণনার একটি যৌক্তিক ব্যাখ্যা সম্রাট আকবরের মন্ত্রী আবুল ফজল এর আকবর নামায় উল্লেখ আছে।

সম্রাট আকবরের আদেশে তৎকালীন বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেউল্লাহ সিরাজী বাংলা বছর নির্ধারণ করেন। যা ১৫৮৪ সালের মার্চ ১০/১১ মাসে প্রবর্তিত হয় ফসলী সন হিসেবে। যদিও পরে তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়। সাধারণত বাংলা বছরের শেষ মাস অর্থাৎ চৈত্রের শেষ দিন ছিল কৃষকদের খাজনা প্রদানের শেষ দিন। জমিদার বা ভূমি মালিকদের খাজনা দিতে বাংলার কৃষকরা নানা রকম সমস্যায় পড়ত। বিশেষ করে সমস্যার মুখোমুখি হতো বি যাদের ফসলের অবস্থা খারাপ। কেননা, যেহেতু ফসল উৎপাদনে তারা পুরোপুরি প্রকৃতির উপর নির্ভর করত, সেহেতু প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাদের ব্যাপক ফসলহানি ঘটতো। সে কারণে চৈত্রের শেষ দিনটি ছিল গরীব কৃষকদের জন্য অত্যন্ত হৃদয় বিদারক। খাজনা দিতে না পারা কৃষকরা নির্যাতনের মুখোমুখি হতো। এ কারণে এর পর দিন অর্থাৎ বৈশাখের প্রথম দিন বাংলার জমিদার ও ভূমির মালিকরা অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টি মুখ করানো সহ নানান উৎসবের আয়োজন করতো। এর ফলে তারা সকল কিছু ভুলে নতুন করে শুরু করতো জীবন। এসব উৎসবে থাকত নাচ, গান, যাত্রাপালা, মেলা ইত্যাদি। এগুলো ক্রমান্বয়ে আজকের এই বৈশাখী উৎসবে রূপান্তরিত হয়েছে।

কালের বিবর্তনে পহেলা বৈশাখের ধরনের নানা পরিবর্তন হয়েছে। পুরোনো উৎসব বিলুপ্ত হয়ে নতুন উৎসব স্থান দখল করেছে। তবে এর অন্তর্নিহিত বিষয় অর্থনীতি কেন্দ্রিকই রয়ে গেছে। এক সময় বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে হালখাতা অনুষ্ঠান পালিত হতো। হালখাতা হলো এক ধরনের হিসাব-নিকাশের খাতা যা পুরোপুরি অর্থনীতি-কেন্দ্রিক। ব্যবসায়ীরা নতুন বছরের শুরুতে পুরোনো সব হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে নতুন একটি খাতা খুলতেন। পুরোনো বছরের সকল পাওনা আদায় করে নতুন বছরে নতুন করে লেনদেন শুরু করতেন। আর এই হালখাতা উপলক্ষে ক্রেতাদের মিষ্টি খাওয়ানো সহ নানা ধরনের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা থাকতো কয়েকদিন ব্যাপী। বর্তমানে এই হালখাতা প্রথা প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবে এখনো গ্রাম-গঞ্জের বিভিন্ন দোকান বিশেষ করে স্বর্ণের দোকানে হালখাতা অনুষ্ঠান কিছুটা দেখতে পাওয়া যায়।

বর্তমানে শহর, গ্রাম সকল জায়গায় নববর্ষ-কেন্দ্রিক অনুষ্ঠানের পরিবর্তন হয়েছে। এখন খাজনা আদায় পরবর্তী অনুষ্ঠান বা পাওনা আদায় অনুষ্ঠান হিসেবে বৈশাখী আয়োজন না হলেও নববর্ষ ব্যবসায়ীদের ব্যবসার নতুন একটি দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। এখন সারা দেশ জুড়ে নববর্ষ উদযাপনের যে আয়োজন চলছে তাতে অর্থনীতি ব্যাপকভাবে লাভবান হচ্ছে।

বাংলার কৃষিনির্ভর অর্থনীতি কৃষি ছাড়াও শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে এখন বিস্তৃত। বৈশাখ উপলক্ষে যে আয়োজন তাতে আমাদের পোশাক শিল্প, কারুপণ্য, লোক শিল্পজাত পণ্য ও মৃৎশিল্পকে এবং আমাদের দেশীয় খাদ্য উৎপাদন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অর্থনৈতিকভাবে গতিশীল করে তুলেছে।

সারা ভারত ও প্রান্তিক বাংলাদেশে নববর্ষকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বাংলা একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আয়োজন করা হয় নানা কর্মসূচী। যাতে অংশগ্রহণ করে হাজার হাজার মানুষ। নতুন বছরের নতুন সূর্যকে বরণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বর্ষবরণ সংগীত, মঙ্গল শোভাযাত্রা, গান, নাচ, কবিতা, যাত্রা সহ মেলায় অংশগ্রহণ করে নানান খেলার সামগ্রী যার পেছনে মানুষের কোটি কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে।

বৈশাখ উপলক্ষে বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রে থাকছে নানা আয়োজন। রেডিও, টেলিভিশনে বিশেষ অনুষ্ঠান, বিভিন্ন প্রদর্শনী ও মাসব্যাপী চলছে মেলা। এসবের মাধ্যমে একদিকে যেমন আমাদের দেশীয় ঐতিহ্যকে আমরা ধরে রাখতে পারছি অন্যদিকে আমরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছি।

নববর্ষ আমাদের জীবনে নিয়ে আসে অপার সম্ভাবনা। নিজের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ধরে রেখে নববর্ষ-কেন্দ্রিক ব্যবসা এগিয়ে নিতে পারে আমাদের অর্থনৈতিক গতিকে। কৃষির নির্ভরশীলতা কমিয়ে শিল্পের বিভিন্ন খাত যেমন মৃৎশিল্প, কুটিরশিল্প, কারুশিল্পের প্রসার ঘটিয়ে বিদেশে বুকে নিজেদের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিতে নববর্ষ হলো আমাদের প্রধান পদক্ষেপ। তার সাথে আমরা অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হবো। দেশীয় পণ্য ব্যবহার করবো এবং দেশীয় সংস্কৃতি ধরে রাখবো। এ হচ্ছে নববর্ষের প্রার্থনা। তবে করোনা ভাইরাস বছরটি প্রথম দিকে থেকেই গ্রাস করছে। সকল বাঙ্গালীর মনে প্রাণ উজ্জ্বল আনন্দ মালিন করেছে । নতুন বছর প্রাক্তন আনবে । দূর হবে বিষাক্ত ভাইরাসের ত্রাস । সবাই এক সুরে গায়ছে “আমরা করবো জয় , নতুন বছরে করোনা নাই , এই বাংলায় “।

Related posts

অরণ‍্যদেব কথা-২

E Zero Point

দাঁদুড় মান্নাত ফারর্মাস ক্লাবের ইফতার সামগ্রী প্রদান

E Zero Point

রমজানঃ বর্তমানে ঘর থেকে বের না হওয়াটাও এক ধরনের সংযম

E Zero Point

2 মন্তব্য

রজত ঘোষ April 14, 2020 at 7:52 pm

বাঙালির পয়লা বৈশাখের মেজাজ আজ একলা বৈশাখের পণে পরিপূর্ন। সৌজন্যে করোনার দাপাদাপি। স্যানিটাইজার হাতে লক্ষ্মী বার্তা-“ঘরে থাকুন সুস্থ থাকুন” – উনিশের করোনাকে চমকিত করেছে নিশ্চয়। শিল্পীর নিপুন শৈলী অতীব কুশলে করোনা সচেতনতার বার্তা প্রকাশের পাশাপাশি বাংলা নববর্ষের সূচনার সাংকেতিক ও বাঙালির সনাতন ভাবনার রূপদান করেছেন। সম্পাদকীয় তে করোনামুক্ত ভোরের খোঁজে জনসচেতনতার বার্তা স্পন্দিত। স্থিতিশীল উন্নয়নের পাশে বিকশিত হোক মানবিক গুন যা আজকের বর্তমান সময়ে একান্ত কাম্য।

অজয় কুমার দের ” বাংলা নতুন বছরের সেকাল একাল” বাংলা নববর্ষের ঐতিহাসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পেক্ষাপট বর্ণিত হয়েছে। পয়লা বৈশাখ মানে হৃদয় বিদারক চৈত্র পেরিয়ে নতুন জীবনের শুরু। নতুন ভাবে ভাবা শুরু। আজও বাংলার গ্রামাঞ্চল, মফস্বলে নববর্ষ পালিত হয়।

ম্যাগাজিনের তৃতীয় পৃষ্ঠায় দুটি কবিতা স্থান পেয়েছে। শংকর হালদারের “মনে রেখো” কবিতায় কবি নিঃস্ব হৃদয়ের কোনো হিসেব না চেয়ে শুধু মনে রাখার আকুতি করেছেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভালো থাকার কামনা করেছেন। অজস্রতার ভিড়ে একাকী একটা হাত খুঁজেছেন। রজত ঘোষের ” হে একাকীত্ব” কবিতায় বন্ধু একাকীত্ব এর হাত ধরে নির্জন দুপুরে কাঙালের কেমন অনুভূতি কলম কালি নিয়ে খেলতে পারে তার কথা বলা হয়েছে।

কবিরুল লিখিত গল্প ” এক টুকরো ভারতবর্ষ” নেমে এসেছে ঘোষালবাড়িতে। ” বিবিধের মাঝে মিলন মহান” ভারতের এই ভাবধারায় অনুপ্রাণিত ঘোষালকর্তা তাই চড়কের মেলা সবার জন্য উন্মুক্ত করেছেন। পঞ্চম পৃষ্ঠায় ছোট্ট সোনামনির ” ইচ্ছে খুশি” গুলি সুন্দর রূপ দিয়েছেন কবি শম্পা গাঙ্গুলি ঘোষ। মুস্তারি বেগমের লেখনী সত্যিই অনবদ্য যা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে খুবই ভাবায়।
করোনার গ্রাসে যখন ঢুকছে পৃথিবী, তখন সেই পৃথিবীকে বহু অনুরোধ “ওর করোনা ছিল না” ব্যর্থতায় পর্যবেসিত হয়েছে। একরাশ স্তব্ধ আকাশ শুনলো “কুয়া কুয়া কুয়া” আর এই পৃথিবী হারালো এক মা কে। নির্মম বাস্তবধর্মী এই কবিতা।

অগ্নিমিত্র ওরফে ড. সায়ন ভট্টাচার্য্য রচিত” মামা ও করোনা” তে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে মানসিক দূরত্ব কমানোর কথা বলেছেন। কবি রতন নস্কর তার কবিতা “প্রত্যাশা” করোনা মুক্ত পৃথিবীর আশা করছেন। সৈয়দ সেরিনার কবিতা “অন্যরকম বৈশাখ” পয়লা পরিবর্তে একলা বৈশাখ এর গান গেয়েছেন।অসীমা সরকার এর “সার্থক মা” একটি সার্থক ছোটগল্প যার মধ্যে শেষ হয়েও হইলো না শেষের সুর বর্তমান।

শিবব্রত গুহ র “ঘুরে এলাম বাংলাদেশ থেকে” ভ্রমণকাহিনী মূলক লেখায় একখন্ড বাংলাদেশ উঠে এসেছে। লেখার সঙ্গে বেশ কয়েকটি ছবি পাঠকের বিমূর্ত মনন ছবিগুলিকে মূর্ত রূপ দিয়েছে বলে মনে হয়।

ব্রততী ঘোষ আলীর কণ্ঠে আরণ্যক বসুর কবিতা “বিজ্ঞান কখনো ঘুমোয় না” অসাধারণ। কবিতাটি অতীত-বর্তমান, সংস্কার- কুসংস্কার, ধর্ম-বিজ্ঞান, কল্পনা-বাস্তবতার এক অপূর্ব মেলবন্ধন। অতীতের কাল্পনিক জগৎ থেকে বাস্তবের মাটির ক্ষুদ্র শূন্যস্থানগুলিকে দেখিয়ে আগামী দিনে বিজ্ঞানের জয়গান গেয়েছেন। সত্যিই বিজ্ঞান কখনো ঘুমোয় না।

“বৈশাখী-১৪২৭” ই ম্যাগাজিন সাহিত্যের প্রায় সব ক্ষেত্রই স্থান পেয়েছে।
কবিতা, কবিতা আবৃত্তি, গল্প, অনুগল্প, প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনী মেলবন্ধন এই ম্যাগাজিন। এগিয়ে চলুক এই ম্যাগাজিন ও জিরো পয়েন্ট নববর্ষে এই কামনা করি।

উত্তর
উত্তমকুমারখাঁ April 15, 2020 at 7:55 am

মাসিক ই-পত্রিকার প্রকাশনার সিদ্ধান্তটি সময়োপযোগী ও অভিনব। বৈশাখী সংখ্যাটি শেয়ার ক’রলাম। প্রিয় সম্পাদক মহাশয়কে অনেক ধন্যবাদ।

উত্তর

মতামত দিন