|| *** গল্প *** ||
এক টুকরো ভারতবর্ষ
রণজিৎ মল্লিক (কবিরুল)
” গামলার বাসনগুলো তাড়াতাড়ি ধুয়ে ফেলিস ছবি। আগামীকাল চড়কপুজো আছে। তার পরের দিনও পয়লা বৈশাখ। এই দুদিন একটু তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করিস। ” চা খেতে খেতে ঘোষাল বাড়ির বড় বৌ কথাগুলো বলল।
” আগামীকাল বৌদি ছেলে মেয়েদের নিয়ে ঠিক করেছি একটু চড়কের মেলাতে যাব। ওদের দুজনের এখন স্কুল কদিন ছুটি। ওরাও সেইভাবে কোথাও বেরোতে পারে না ।”
” ঠিক আছে। তবে কাল সকাল সকাল আসবি। অনেক কাজ আছে। আর এই দুইদিন বাড়িতে রান্না করার দরকার নেই। এখানেই খেয়ে নিস। ” কথাগুলো বলেই ঘোষাল গিন্নী চা আর বিস্কুট ছবির দিকে এগিয়ে দিল।
চড়কের মেলাতে অনেক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান , প্রতিযোগিতা হয়। ছবির ছেলে আর মেয়ে এবারে প্রতিযোগিতাতে নামবে। ওদের দুজনের একজন কবিতা আবৃত্তি করবে।আর একজন নাচ করবে। ছবি তাই সুস্মিতা বৌদির কাছে ছেলে মেয়েকে ভাল করে তালিম নিতে বলেছে। উনি নাচ আর গান দুটোতেই সমান পারদর্শী।
ছবি আদিবাসী। নীচু জাত। তাছাড়া আদিবাসীদের মধ্যেও ওরা সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া আর নিন্মশ্রেণীর । সমাজে কোণঠাসা। তাই ছেলেমেয়েদের লেখা পড়া শিখিয়ে মানুষ করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। সুস্মিতাবৌদিই ছবিকে সব সময় ছেলে মেয়েকে মানুষ করার কথা বলেন। ভাল ভাল পরামর্শ দেন।
আজ অনেকদিন ধরে বৌদির এখানে কাজ করছে। সুস্মিতাবৌদি স্কুল টিচার। অনেক ভাল ভাল ছাত্র তৈরী করেছেন। সমাজের অনেক মানুষ উনার কথার মান্যতা দেয়।
বৌদির বাড়িতে ঢুকেই বৌদির গলা উপর থেকে শুনতে পাচ্ছে। বৌদি ছাত্র ছাত্রীদের নাচের ক্লাস নিচ্ছেন। আর পাশের ঘরে চলছে কবিতা আবৃত্তির ক্লাস।
” অনুপম মনে আছে তো কবিতাটা কি ভাবে আবৃত্তি করতে হবে। মনের ভাবটা ঠিক মত ফুটিয়ে তুলতে হবে। “
” হ্যাঁ দিদিমণি মনে আছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনেকবার প্র্যাকটিস করেছি। “
” গুড ।”
” পুনম , নাচটা ঠিকঠাক তোলা হল ?
আগামীকাল মেলাতে কিন্তু ফাইনাল পারফর্ম করতে হবে। হাতে আজকের সন্ধ্যেটে শুধু পাচ্ছ। মনে থাকে যেন।”
” সব ঠিক আছে। তবে শেষের দিকে পা মেলাতে একটু অসুবিধা হচ্ছে। ডান পা বাঁ পা গুলিয়ে যাচ্ছে। “
” কোন অসুবিধা হবেনা। ভিডিওটা ভাল করে দেখ। তারপর স্টেপিংগুলো ঠিক কর। “
আজ চড়ক পুজো। ঘোষালবাড়ির কাজ কর্ম অনেক আগেই শেষ করে ফেলেছে। আজ এ বাড়িতে অনেক লোকের পাত পড়বে। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বহু মানুষ সমেবেত হয়ে ভজন গান করবে। তারপর সকলে প্রসাদ খেয়ে ফিরবে। বহু দূর থেকে , আশেপাশের গ্রাম থেকেও অনেক লোক আসেন। দেবতার চরণ ধুলি নিয়ে খুশী মনে সকলে আবার চলে যান।
এই দিনটা ছবির খুব ভাল লাগে। এইদিন সকলে মিলে হৈ হুল্লোড় অনেক আনন্দ হয়। এই দিনটাতে সকলে সমান। এইদিন উঁচু নীচুর কোন ভেদাভেদ থাকেনা। সকলে একসাথে বসে খায়। শ্মশানের পাশে ডোমদের বাস। ওরাও এইদিন হাজির হয়। পেটপুরে খাবার পর রাতের খাবার সাথে করে নিয়ে যায়।
এইসব ঘোষাল কর্তার অবদান। উনিই সবাইকে নিয়ে চলতে শিখিয়েছেন। একতার সুতোতে সকলকে বেঁধেছেন। মানুষকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিয়েছেন। উনি জানেন এই দেশটির নাম ভারতবর্ষ। এখানে অনেক ধর্ম , অনেক জাতি। সেই সাথে আছে বিভিন্ন সম্প্রদায় , জাতের চোখ রাঙ্গানি।
এই বাড়িতে আসলে তাই শ্রদ্ধায় মাথা নীচু করতে হয়। এমএলএ বা মন্ত্রীর নীল বাতি গাড়ি , হুটারের শব্দ এখানে পাত্তা পায়না। পাশের গলির মসজিদ পাড়ার মৌলবীরাও এখানে আসেন। মুসলিম পাড়া , দর্জি পাড়ার মা বোনেরাও আসে। পুজোর কাজে হাত লাগায়। এই ঘোষাল বাড়ি সেই অর্থে মহামানবের মিলন ক্ষেত্র।
ঘোষালবাড়ির কাজ পর্ব সব মিটিয়ে ছবি চড়কের মেলাতে আসল। একটু দেরী হয়ে গেছে। ছেলেটা আগেই এসে পৌঁছেছে। চড়কের মেলাতে বেশ ভিড় হয়েছে। এখানেও সব বর্ণের সব ধর্মের মানুষের সমাগম হয়। একটা সময় ঘোষাল কর্তা এই মেলা কমিটির সেক্রেটারী ছিলেন। উনিই মেলার দ্বার সব সম্প্রদায়ের জন্য উন্মুক্ত করেন। সেই থেকে সব শ্রেণীর মানুষ এখানে পুজো দিতে পারে। দেবতাকে ফুল মালা অর্পণ করতে পারে। যেটা আগে ছিল না। এই চড়কের মেলা এই অঞ্চলের তো বটেই আশেপাশের অনেক গ্রাম শহরের মানুষের কাছেও একটা পরম প্রাপ্তি। এখানেও একটা একতার সুর ভেসে ওঠে সব সময়। রবি ঠাকুর ঠিক বলেছেন , ” বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। ” এই মেলাতে আসলে সকলের মন ভাল হয়ে যায়।
আজ যেমন চৈত্র সংক্রান্তি তেমনি আজ বাবা সাহেব আম্বেদকরের জন্মদিন। অনুপম আম্বেদকরের উপর একটি সুন্দর স্পীচ বলেছে। স্পীচটি বহুলভাবে প্রশংসিত হয়েছে। পুনমও খুব ভাল নাচ করেছে। ওরা দুজনেই অনেক প্রাইজ নিয়ে ফিরেছে। ছবির পিচুটি – পরা চোখ উপচে পড়ছে চোখের জলে।
অনুষ্ঠানের শেষ লগ্নে অনুপম রবীন্দ্রনাথের ” ভারত তীর্থ ” কবিতাটি পাঠ করেছে। কবিতাটিতে কবিগুরু স্পষ্টই বলেছেন যে ভারতবর্ষ হল মহামানবের মিলন ক্ষেত্র। মেলার ক্ষেত্রে বর্তমান দেশের পরিপ্রেক্ষিতে কবিতাটি ভীষণ ভীশণ প্রাসঙ্গিক।
ছেলে মেয়ে দুজনেই আজ খুব আনন্দ করেছে। অনেক জিনিসও কিনেছে। ঘোষালবাড়ির বড় গিন্নী , আর সুস্মিতা ম্যামের জন্যে ওরা সুন্দর সুন্দর পুতুল কিনেছে।
পয়লা বৈশাখের দিন ছবি একটু আগেই ঢুকল। আজও এখানে অনেক লোক বসে খাবে। বাড়ি গমগম করছে।
বড় গিন্নী উনার জন্যে আনা পুতুলটি পেয়ে খুব খুশী। তরমুজের শরবতটা বাড়িয়ে দিয়ে অনুপমকে জিজ্ঞাসা করল ,
” হ্যাঁ রে অপু কাল মেলাতে কি কবিতা আবৃত্তি করলি ? একবার শোনাবি না ? “
” জেম্মা , কাল রবি ঠাকুরের ” ভারত তীর্থ ” কবিতাটি আবৃত্তি করেছি। সেখানে কবিগুরু একতার বাণী সাম্যের কথা বলেছেন। তুমি কবিতাটা শোনো নি ? “
” না রে আমার কবিতাটা পড়া হয়নি। “
” আমি যদি বলি তুমি পড়েছ। শুনেছ এই কবিতা। অনেক দিন আগে থেকেই এই কবিতা তোমার এখানে পাঠ হয়ে আসছে। ” কথা গুলো বলেই অনুপম গিন্নীমার হাত ধরে টানতে টানতে উনাকে ঘোষাল বাড়ির দুর্গা দালানের সামনে এনে হাজির করল। সেখানে গতকাল পুজো হয়েছে। এখনও আজকেও পুজো পাঠ ভজন , চলছে। সব ধর্মের মানুষ এসে হাজির হয়েছে। সবাই মনোযোগ সহকারে ভক্তি সুধা আস্বাদন করছেন।
বড় গিন্নী উপলব্ধি করলেন অপু ঠিক কথায় বলেছে। এ যেন রবীন্দ্রনাথের ” ভারত তীর্থ ” কবিতার মহামানবের মিলন ক্ষেত্র । সমগ্র দেশ যেন একতার সুরে আবদ্ধ। হাসছে। আনন্দ করছে।
ক্লাস ফাইবের পুচকে অনুপম আজ গিন্নীমার চোখ খুলে দিয়েছে। সাদা কালো শব্দের বাইরেও যে একটা কবিতা আছে , সুর ছন্দ , আছে সেটা তিনি বুঝলেন।
বড় গিন্নির চোখ চলছল করে উঠল। এক টুকরো ছোট ভারতবর্ষ উনার সামনে আজ উঁকি মারল। যে ভারতবর্ষ একতার ভারতবর্ষ , মিলনের ভারতবর্ষ , সম্প্রীতির ভারতবর্ষ।
পূর্ববর্তী পোস্ট
2 মন্তব্য
বাঙালির পয়লা বৈশাখের মেজাজ আজ একলা বৈশাখের পণে পরিপূর্ন। সৌজন্যে করোনার দাপাদাপি। স্যানিটাইজার হাতে লক্ষ্মী বার্তা-“ঘরে থাকুন সুস্থ থাকুন” – উনিশের করোনাকে চমকিত করেছে নিশ্চয়। শিল্পীর নিপুন শৈলী অতীব কুশলে করোনা সচেতনতার বার্তা প্রকাশের পাশাপাশি বাংলা নববর্ষের সূচনার সাংকেতিক ও বাঙালির সনাতন ভাবনার রূপদান করেছেন। সম্পাদকীয় তে করোনামুক্ত ভোরের খোঁজে জনসচেতনতার বার্তা স্পন্দিত। স্থিতিশীল উন্নয়নের পাশে বিকশিত হোক মানবিক গুন যা আজকের বর্তমান সময়ে একান্ত কাম্য।
অজয় কুমার দের ” বাংলা নতুন বছরের সেকাল একাল” বাংলা নববর্ষের ঐতিহাসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পেক্ষাপট বর্ণিত হয়েছে। পয়লা বৈশাখ মানে হৃদয় বিদারক চৈত্র পেরিয়ে নতুন জীবনের শুরু। নতুন ভাবে ভাবা শুরু। আজও বাংলার গ্রামাঞ্চল, মফস্বলে নববর্ষ পালিত হয়।
ম্যাগাজিনের তৃতীয় পৃষ্ঠায় দুটি কবিতা স্থান পেয়েছে। শংকর হালদারের “মনে রেখো” কবিতায় কবি নিঃস্ব হৃদয়ের কোনো হিসেব না চেয়ে শুধু মনে রাখার আকুতি করেছেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভালো থাকার কামনা করেছেন। অজস্রতার ভিড়ে একাকী একটা হাত খুঁজেছেন। রজত ঘোষের ” হে একাকীত্ব” কবিতায় বন্ধু একাকীত্ব এর হাত ধরে নির্জন দুপুরে কাঙালের কেমন অনুভূতি কলম কালি নিয়ে খেলতে পারে তার কথা বলা হয়েছে।
কবিরুল লিখিত গল্প ” এক টুকরো ভারতবর্ষ” নেমে এসেছে ঘোষালবাড়িতে। ” বিবিধের মাঝে মিলন মহান” ভারতের এই ভাবধারায় অনুপ্রাণিত ঘোষালকর্তা তাই চড়কের মেলা সবার জন্য উন্মুক্ত করেছেন। পঞ্চম পৃষ্ঠায় ছোট্ট সোনামনির ” ইচ্ছে খুশি” গুলি সুন্দর রূপ দিয়েছেন কবি শম্পা গাঙ্গুলি ঘোষ। মুস্তারি বেগমের লেখনী সত্যিই অনবদ্য যা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে খুবই ভাবায়।
করোনার গ্রাসে যখন ঢুকছে পৃথিবী, তখন সেই পৃথিবীকে বহু অনুরোধ “ওর করোনা ছিল না” ব্যর্থতায় পর্যবেসিত হয়েছে। একরাশ স্তব্ধ আকাশ শুনলো “কুয়া কুয়া কুয়া” আর এই পৃথিবী হারালো এক মা কে। নির্মম বাস্তবধর্মী এই কবিতা।
অগ্নিমিত্র ওরফে ড. সায়ন ভট্টাচার্য্য রচিত” মামা ও করোনা” তে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে মানসিক দূরত্ব কমানোর কথা বলেছেন। কবি রতন নস্কর তার কবিতা “প্রত্যাশা” করোনা মুক্ত পৃথিবীর আশা করছেন। সৈয়দ সেরিনার কবিতা “অন্যরকম বৈশাখ” পয়লা পরিবর্তে একলা বৈশাখ এর গান গেয়েছেন।অসীমা সরকার এর “সার্থক মা” একটি সার্থক ছোটগল্প যার মধ্যে শেষ হয়েও হইলো না শেষের সুর বর্তমান।
শিবব্রত গুহ র “ঘুরে এলাম বাংলাদেশ থেকে” ভ্রমণকাহিনী মূলক লেখায় একখন্ড বাংলাদেশ উঠে এসেছে। লেখার সঙ্গে বেশ কয়েকটি ছবি পাঠকের বিমূর্ত মনন ছবিগুলিকে মূর্ত রূপ দিয়েছে বলে মনে হয়।
ব্রততী ঘোষ আলীর কণ্ঠে আরণ্যক বসুর কবিতা “বিজ্ঞান কখনো ঘুমোয় না” অসাধারণ। কবিতাটি অতীত-বর্তমান, সংস্কার- কুসংস্কার, ধর্ম-বিজ্ঞান, কল্পনা-বাস্তবতার এক অপূর্ব মেলবন্ধন। অতীতের কাল্পনিক জগৎ থেকে বাস্তবের মাটির ক্ষুদ্র শূন্যস্থানগুলিকে দেখিয়ে আগামী দিনে বিজ্ঞানের জয়গান গেয়েছেন। সত্যিই বিজ্ঞান কখনো ঘুমোয় না।
“বৈশাখী-১৪২৭” ই ম্যাগাজিন সাহিত্যের প্রায় সব ক্ষেত্রই স্থান পেয়েছে।
কবিতা, কবিতা আবৃত্তি, গল্প, অনুগল্প, প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনী মেলবন্ধন এই ম্যাগাজিন। এগিয়ে চলুক এই ম্যাগাজিন ও জিরো পয়েন্ট নববর্ষে এই কামনা করি।
মাসিক ই-পত্রিকার প্রকাশনার সিদ্ধান্তটি সময়োপযোগী ও অভিনব। বৈশাখী সংখ্যাটি শেয়ার ক’রলাম। প্রিয় সম্পাদক মহাশয়কে অনেক ধন্যবাদ।