27/04/2024 : 9:37 AM
ই-ম্যাগাজিনসাহিত্য

e-জিরো পয়েন্ট – জ্যৈষ্ঠ ১৪২৭ (রবীন্দ্র-নজরুল সংখ্যা)

প্রবন্ধ


পত্রিকা-সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ

✒ডঃ রমলা মুখার্জী

প্রস্ফুটিত প্রসূণে পূর্ণ রবি-নন্দনকানন,
সৌরভে বিশ্ব-বাসীর স্পন্দিত তনু-মন।
      রবীন্দ্র প্রতিভার ডালিতে আছে নানা নামী-দামী ফুলের মেলা। তাই শুধু কাব্য সাহিত্যের জগতেই তিনি অনন্য সাধারণ ছিলেন না, আরও নানান বিষয়ে তিনি তাঁর উজ্বল প্রতিভার দীপ্তি ছড়িয়েছেন। তিনি যেন সেই পরশপাথর, যা স্পর্শ করতেন তাই সোনা হয়ে উঠত ।তাঁর বহুরত্নখচিত মুকুটের একটি পালক হল পত্রিকা সম্পাদনা ।বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে পত্রিকা-সম্পাদক রূপেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। ঠাকুরবাড়ির সাহিত্য-সম্পৃক্ত আবহাওয়ায় বড় হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। ঠাকুরবাড়ির শিশুকিশোরদের সাহিত্য চারাগুলিতে জল-সিঞ্চন করার জন্য ঠাকুর পরিবার থেকে ‘বালক’ পত্রিকা প্রকাশ করা হত। এই পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১২৯২ সালে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহধর্মিণী জ্ঞানদানন্দিনীর সম্পাদনায়।রবীন্দ্রনাথ এই ‘বালক’ পত্রিকার কার্যাধক্ষ্য থাকলেও পত্রিকাটির সব দায়িত্বই তাঁকে নিতে হয়েছিল। এক বছর স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে এই পত্রিকা চলে এবং পরবর্তীকালে এই পত্রিকা ভারতী পত্রিকার সাথে যুক্ত হয় ।এই এক বছরের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পঞ্চাশটিরও বেশি লেখা এতে প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর ১২৯৮ সালে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রচেষ্টায় ও কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক ‘হিতবাদী’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য-সম্পাদকরূপে নির্বাচিত হলেন। এই ‘হিতবাদী’ র হাত ধরেই রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের দ্বার উন্মোচিত হল। উত্তরবঙ্গে জমিদারি দেখাশোনা করার সময় তিনি বাংলা ও বাঙালির অনেক কাছাকাছি আসতে পারেন আর তাই তাদের জীবন ও জীবিকা খুব গভীর ভাবে অনুসন্ধানের সুযোগ পান। ফলস্বরূপ রচিত হল নানা সার্থক ছোট গল্প যা তিনি ‘হিতবাদী’ পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন। গল্পগুলোর গভীরতা উপলব্ধি হয় তো সব শ্রেণীরপাঠকের পক্ষে সম্ভব ছিল না তাই রবীন্দ্রনাথের কাছে হাল্কা কাহিনিমূলক গল্প চাওয়া হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ অসন্তুষ্ট হয়ে ‘হিতবাদী’ ছাড়লেন কারণ তিনি হলেন অতল সমুদ্র। সাগর তাই মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিল।
      ‘সাধনা’ পত্রিকা প্রথমে সুধীন্দ্রনাথ ও পরে রবীন্দ্রনাথ সম্পাদনা করেন।এই পত্রিকাটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নতুনত্বের দাবী রাখে।
রবীন্দ্রনাথের ‘সাধনা’ ‌ আসলে নবজীবনের সাধনা, অগ্রগতির সাধনা। তাই এই পত্রিকার প্রতিটি ষান্মাষিক খন্ডের নামপত্রের উল্টোদিকে ছাপা থাকত –
“আগে চল্ আগে চল্, ভাই।
পড়ে থাকা পিছে, মরে থাকা মিছে,
বেঁচে মরে কি বা ফল ভাই,
আগে চল্ আগে চল, ভাই।”
নানা বিষয়ের নানান লেখা এই ‘সাধনা’ পত্রিকাকে সমৃদ্ধ করেছিল। গানের স্বরলিপি, দর্শন, ব্রজবুলি, রাজনীতি, রবীন্দ্রনাথের গদ্য-পদ্য রচনা, অনেক রাজনৈতিক প্রবন্ধ এই পত্রিকাটিতে প্রকাশিত হতো। গ্রাম্য সাহিত্য, গ্রাম্য ছড়া এই সব লোকরচনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংগ্রহ করার জন্য ডাক দিয়েছিলেন আত্মত্যাগী দেশের মানুষকে। সে ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, বলেন্দ্র ঠাকুর, উমেশ চন্দ্র বটব্যাল এবং আরও অনেক গুণিজন এবং তাঁরা সবাই ‘সাধনা’র সাধনাকে অনেকটা পথ এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন।’সাধনা’ পত্রিকায় শুধু সাহিত্য নয়, বিভিন্ন বিষয়ের লেখা স্হান পেত। এমনকি বিজ্ঞানের অনেক প্রবন্ধও এখানে প্রকাশিত হত। জগদানন্দ রায়, জগদীশ চন্দ্র বসু এঁরা ‘সাধনা’ পত্রিকায় বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ লিখে বিজ্ঞানের নানা বিষয় সম্বন্ধে মানুষকে অবহিত করতেন।১২৯৮ সাল থেকে ১৩০২ সাল পর্যন্ত সাধনা পত্রিকাটি চলে। স্বাধীনতা লড়াইয়ের প্রাক্কালে মারাঠা বীরদের সম্বন্ধে বাঙালীদের আগ্রহী করার জন্যে রবীন্দ্রনাথ খুবই সচেষ্ট হয়েছিলেন।তিনি মারাঠা ঐতিহাসিক সখারাম গণেশ দেওস্করকে অনুরোধ করেছিলেন ‘সাধনা’
পত্রিকায় লেখা দেওয়ার জন্য।সখারাম রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন এবং মারাঠা ইতিহাসের বিশেষ বিশেষ পটভূমি রঙে রসে সাজিয়ে বাঙালি পাঠকদের উপহার দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার ব্রতে দীক্ষিত হতে সাহস যুগিয়েছিল এইসব মারাঠা বীরদের কাহিনি।
      ‘সাধনা’র আর একটি নতুন দিগন্ত হল সাহিত্য সমালোচনার ধারা প্রবর্তন। বাংলা সমালোচনার ইতিহাসে এটি একটি যুগান্তকারী সৃষ্টি বলা যেতে পারে। প্রথম এই ধারাটি প্রচলিত হয় ১৩০০ সালের ‘সাধনা’ পত্রিকার চৈত্র সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের ‘রাজসিংহ’ আলোচনার মাধ্যমে। ক্রমশ নানান সাহিত্য সমালোচিত হয় এই পত্রিকায়। নতুন নানা স্বাদের সাহিত্য চিন্তার প্রকাশ আমরা দেখতে পেলাম এই ‘সাধনা’ পত্রিকায়। পত্রিকা সম্পাদকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যকে যে যথেষ্ট সমৃদ্ধ করেছেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকে না।♥

Related posts

রবিবারের আড্ডা : আরণ্যক বসু || আঞ্জু মনোয়ারা আনসারী || তপন কুমার রায়

E Zero Point

আপনি কি লেখক? পাবেন মাসে ৫০ হাজার টাকা বৃত্তি – জেনে নিন কি ভাবে

E Zero Point

পদার্পণের ‘রবীন্দ্র-নজরুল সংখ্যা ১৪২৮’

E Zero Point

1 টি মন্তব্য

রজত ঘোষ May 24, 2020 at 8:45 am

নববর্ষ সংখ্যার পর প্রকাশিত হয়েছে জিরো পয়েন্ট এর মাসিক জৈষ্ঠ্য সংখ্যা “রবীন্দ্র নজরুল সংখ্যা”।
লক ডাউন মাঝে মানুষ যখন গৃহবন্দি তখন রবীন্দ্র নজরুল কে স্মরণ করে জিরো পয়েন্ট এর এই প্রয়াস অতুলনীয়। এই মহান দুই মনীষী দের সম্মান জানানোর পাশাপাশি আমরা এই সংখ্যায় পেলাম অসাধারণ সব সাহিত্য বুনন।

বিশিষ্ট কবি ও বাচিক শিল্পী আরণ্যক বসুর কবিতা সমালোচনা করার মতো ধৃষ্টতা আমার নেই। তাঁর কবিতা মানেই ‘spontaneous overflow of powerful feelings’। ”বৃন্তের দুটি ফুলে” কবিতাটিও ব্যতিক্রম নয়। রবীন্দ্র নজরুল এর পটভূমিকায় তিনি বলেছেন ‘সম্প্রীতি সম্প্রীতি রাখে শান্ত-নিরুদ্বেগ’ ।

শম্পা গাঙ্গুলি ঘোষ এর কবিতা “প্রণমি তোমারে” তে কবিমন রবীন্দ্রময় দৈনন্দিন জীবনের কথা বলেছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘আনন্দময় প্রকাশ’ ‘চিরস্থায়ী’ কবির ‘এ হৃদয় মাঝারে’। আঞ্জু মনোয়ারা আনসারী র কবিতা “প্রেম শাশ্বত” তে পাওয়ার অফ আর্ট এর কথা বলা হয়েছে। মানব জীবনের সমস্যাময় পথে বহু বাধা আসবেই। তবু কবির কাছে
‘চির শাশ্বত কবির অমৃত বাণী’ ‘জন্ম জন্মান্তরের তপস্যা ধন’। সৃষ্টি ও স্রষ্টা এই কবিতায় প্রেমময় ঈশ্বর।

তৃতীয় পৃষ্ঠায় শুভাশিস মল্লিক “রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল” শীর্ষক তথ্যপূর্ণ লেখনীতে তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক সম্পর্কে জানা যায়। বদ্রিনাথ পালের লেখা “এক বৃন্তের ফুল” এ অবিনশ্বর রবি-নজরুল কীর্তির জয়গান গেয়েছেন। ” তোমারই খোঁজে” কবিতায় দিকভ্রান্ত কবি ‘জীবনের জয়গান শোনে তোমার থানে বসে।’

কবিরুল এর ছোটগল্প “চন্ডালিকা” অসাধারণ। বর্তমান সময়ের পটভূমিকায় সমাজের নানান বিষয় খুব সুক্ষ চালে তুলে ধরেছেন তিনি। আজকের সমাজে মনিকার খুব দরকার। গল্প টি পড়তে পড়তে ডিলন টমাস এর “A Refusal to Mourn the Death” কবিতাটির কথা মনে পড়লো। আর এই গল্পের মাধ্যমে লেখক সমাজ সচেতনতার পাঠ দিতে ‘reverse psychology’ ব্যবহার করেছেন বলে মনে হয়।

“আহ্বানে কবি” তে কবি কেতকী মির্জার মননে বিদ্রোহী কবি নজরুলকে ফিরে আসার আর্তি ধরা পড়েছে: ‘ফিরে এসো গো কবি নজরুল/এসো এসো গো তরুন কবি নজরুল’। ডঃ রমলা মুখার্জি র প্রবন্ধ “পত্রিকা সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ” এর বিবরণ পাওয়া যায়। মিরাজুল সেখ “স্মরণে রবীন্দ্রনাথ” ও মুস্তারি বেগমের “অবেলার কবি” কবিতাদুটিতে চিরদার্শনিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জয়গান করেছেন।
বাংলা তথা বাঙালির ‘দমবন্ধ বাতাসে কালবৈশাখী’ হলেন কবিগুরু।

“কবিগুরু কে নিয়ে আমার ভাবনা” যে অসীমা সরকার কবিগুরু কে নিয়ে নানান ভাবনা তুলে ধরেছেন। ‘হিরকখন্ড’ উজ্জ্বল রবি সম্পর্কে তিনি লিখেছেন: “অমৃতলোকে থাকো তুমি, হয়ে চির-ভাস্বর,/আমরা সদাই গাহিবো তোমার প্রেমগাঁথা নিরন্তর।” হাস্নে আরা বেগম “চিরনমস্য” কবিতায় বর্তমান সময়ে নজরুল এর অভাব লক্ষ্য করেছেন। তিনি মনে করেন আজকে নজরুল থাকলে ‘বুঝতো সবাই বিদ্রোহ কাকে বলে?’

দেবপ্রিয়া বারিক এর “রঙের রবীন্দ্রনাথ ” এ চিত্রশিল্পী কবিগুরু কে পাওয়া গেলো এবং সঙ্গে বেশ কয়েকটি ছবি। রতন নস্করের “রবিঠাকুর রবিঠাকুর” ও মঞ্জুশ্রী মন্ডলের “বিদ্রোহী কবি” নামক কবিতা দুটিতে যথাক্রমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নজরুল ইসলাম কে সম্মান জানিয়েছেন। “রবীন্দ্র সাহিত্য ও সমাজচেতনা” ই অগ্নিমিত্র রবীন্দ্র সমাজ ভাবনার দিকটি তুলে ধরেছেন। লক ডাউন এর সময় বন্দি জীবনে ‘তোমার (রবীন্দ্র)বাণী, তোমার (রবীন্দ্র) চিন্তায়/গানে গল্পে কবিতায়, দিন কেটে যায়’ বলেছেন কবি বর্ণালী শেঠ তার “আর্জি” কবিতায়। কবি শিলাবৃষ্টি র “সাম্যবাদী” কবিতায় বিদ্রোহী কবি “নজরুল ভারতের প্রতি প্রান্তরে তুমি চির-বিদ্রোহী বীর !” শেষ পাতায় স্থান পেয়েছে অসাধারণ আবৃতিমালা ও পাণ্ডুলিপির ছবি। সব মিলিয়ে খুব সুন্দর লাগলো জৈষ্ঠ্য ১৪২৭ সংখ্যা।
…রজত ঘোষ, বালিন্দর, কালনা, পূর্ব বর্ধমান।

উত্তর

মতামত দিন