ভাবনা
পিতাই আমার শিক্ষাগুরু
শিলাবৃষ্টি (করকাশ্রী চট্টোপাধ্যায়)
বাবাই আমার জীবনের আদর্শ পুরুষ।
তিনি আমার পিতা,মহাগুরু,শিক্ষাগুরু।
সারাজীবনটাই তিনি মানুষ গড়ার কাজে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন।শিক্ষকতা তাঁর পেশা হলেও আমার মনে হয় — তা নেশা ছিল।
আমাদের ছাত্রী জীবনে কোনদিন প্রাইভেট টিউটর ছিলনা। আজকের ছেলেমেয়েরা এ কথা নাও বিশ্বাস করতে পারে, তবু এটাই সত্যি। বাবার কাছে নিয়মিত রুটিনমাফিক লেখাপড়া করা আমাদের ভাগ্যাকাশে দুর্লভ ছিল । কারণ মানুষটা যে অসম্ভব ব্যস্ত! স্কুল,নারী শিক্ষাকেন্দ্র গঠন, নিজের বিরাট টিউটোরিয়াল ,ছেলে পড়ানো ……এসব সামলে নাওয়া খাওয়ারও সময়ের ঠিক ছিলনা। তবে পরীক্ষার আগে বাবা সমস্ত ব্যস্ততার মাঝেও আমাদের সময় দিতেন— সে মধ্যরাত হলেও । আর বাবার সাজেসান্ হুবহু লেগে যেত।
আমাদের স্কুলের বড়দি হঠাৎ একদিন আমাদের বাড়িতে এলেন,আমি তো ঘাবড়ে গেছি , বাড়িতে বড়দি কেন ? পরে আরো অবাক হলাম……বাবাকে উনি হাতজোড় করে অনুরোধ করছেন বাবা যেন তাঁর ছোট ছেলের লেখাপড়ার দায়িত্ব নেন! বাবার তখন একেবারে সময় ছিলনা । কিন্তু উনিও নাছোড় । উনি শেষে বলেছিলেন –” ঠিক আছে সারাদিনে যেকোন সময়ে এক ঘণ্টা আপনি শুধু আমার ছেলের সামনে
একবার বসবেন ,ওর সাথে কথা বলবেন”
তাহলেই ও মানুষ হবে ।”
আমার বিস্ময়ের সীমা ছিলনা। পরে জানলাম আমাদের বড়দি এবং আরো অনেক দিদিমণি বাবার ছাত্রী ছিলেন।
আসলে বাবা একসাথে সব সাবজেক্ট পড়াতেন। সবাই বলতো মণিবাবু অল্ স্কোয়ার । বাবার সুনাম সারাজেলায় ছড়িয়ে পড়েছিল।
দাদু ছিলেন গোঁড়া ব্রাম্ভণ,জ্যেঠু ছিলেন সংস্কৃত পণ্ডিত– তাই জ্যেড়তুতো বড়দার
বিলেতে ডাকতারি পড়তে যাওয়া নিয়ে অনেক সমস্যা নাকি দেখা দিয়েছিল ,কিন্তু আমার বাবা রাতের অন্ধকারে দাদাকে নিয়ে বেরিয়ে গেছিলেন। বাবার সাহায্য ছাড়া বড়দার আর বিলেত ফেরৎ ডাক্তার হওয়া বোধয়
হতনা । এ ঘটনা আমার জন্মের আগের।
সাহিত্য সংস্কৃতি জগতে বাবার হাত ধরেই পা রেখেছিলাম। বয়েস কত মনে নেই ,পড়তেও জানতামনা। বাবা মুখে মুখে উপনিষদের শ্লোক শিখিয়ে রামকৃষ্ণ মিশনে সর্বসাধারণ গ্রুপে অনেক বাধা অতিক্রম করে প্রতিযোগিতার হলে দাঁড় করালেন । আজো মনে পড়ে আবছা …আমায় বিভিন্ন কারণে বলতে দেওয়া হচ্ছিলনা,থামিয়ে থামিয়ে উচ্চারণের কারণ ব্যাখ্যা করতে বলা হচ্ছিল । বাবার নির্দেশ মনে রেখে আবার আমি প্রথম
থেকে বলছিলাম । আর সবাই ছিল কলেজের ছেলে মেয়ে। পরে জানা গেল আমিই প্রথম । অনেক বড় মঞ্চে আবার আমায় অনুষ্ঠানে বলতে হবে – তাই বাবা তার ‘উমু’ কে অবিকল ভগিনী নিবেদিতার ড্রেস তৈরী করিয়ে দিলেন । এ আমার স্মৃতির সঞ্চয় !
জীবনে প্রচুর যায়গায় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি আমরা বোনেরা ।প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয়েছি ক’ বার মনে পড়েনা।
বাবা মায়ের ছিল প্রবল উৎসাহ আজকের যা কিছু সব তাঁদেরই দান।
প্রচুর লেখালেখি করতেন ,অনেক প্রবন্ধ গচ্ছিত এখনো,অনেক আবার কোথায় হারিয়ে গেছে কেজানে ! নিমপাতার উপকারিতা নিয়ে বাবার বই” ডক্টর নিম্ব “- তখন সাড়া ফেলে দিয়েছিল।
কোনদিন পালিয়ে পরিত্রাণ পাইনি।” কাল করব ” — কোন একটা ব্যাপারে বাবাকে বলেছিলাম , বাবা সাংঘাতিক রেগে গিয়েছিলেন । কাল কথাটা বাবা সহ্য করতেন না ।
” সে আসন শূন্য আজি ” বড় ফাঁকা লাগে
মাঝে মাঝে খোলা ছাদে গিয়ে – রাতের তারাদের মাঝে খুঁজতে চেষ্টা করি …………
……………সবাই বলে ঐ আকাশে
লুকিয়ে আছে খুঁজে নাও ………♦