প্রবন্ধ
আমার শিক্ষক
ডঃ রমলা মুখার্জী
পৃথিবীতে আসার পর আমার প্রথম শিক্ষক-শিক্ষিকা হলেন আমার বাবা-মা। মায়ের কোলে বসেই আমি আমার মাতৃভাষা বাংলাকে চিনেছি। বাবার কাছে পড়াশোনা শিক্ষার সাথে সাথে পেয়েছি আবৃত্তির শিক্ষা। স্কুলে ভর্তি হয়ে পেয়েছি শিক্ষকদের অসীম ভালোবাসা যা আমার জীবনের পাথেয় হয়ে আছে। তাঁদের আন্তরিকতার সাথে পাঠদান ও সহানুভূতিপূর্ণ ব্যবহার আমার পথচলাকে মসৃণ করেছে, আমার জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্নকে সফল করেছে।
স্কুল-জীবনের গন্ডি পার হয়েও স্কুলের শিক্ষকদের ভালোবাসা পাওয়ার সৌভাগ্য কজনের হয় জানিনা, তবে সেই দুর্লভ সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এই প্রসঙ্গে সব শিক্ষকদের কাহিনি বলতে গেলে বিশাল হয়ে যাবে তবে প্রধান দু-তিন জনের কথা বলার খুব প্রয়োজন মনে করছি এই শিক্ষকদিবসের প্রাক্কালে। প্রথমেই যাঁর কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি তিনি হলে মেমারী, পূর্ব বর্ধমান নিবাসী রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার-প্রাপ্ত শিক্ষক শ্রী চন্দ্রনাথ বৈরাগ্য মহাশয়। উন্নতধরণের হ্যাচারী ও অণুবীক্ষণ যন্ত্রাংশ ইত্যাদি নতুন নতুন আবিষ্কার করে তিনি জাতীয় শিক্ষকের মর্যাদা লাভ করেছেন। তাঁর এত কৃতিত্ব থাকা সত্ত্বেও তাঁর যে সহানুভূতিপূর্ণ মনের পরিচয় আমি পেয়েছি তা এককথায় অতুলনীয়, অনবদ্য। আমি প্রথমে খুব গ্রাম্য এলাকার একটি বালিকা বিদ্যালয়ে জীবনবিজ্ঞানের শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করি এবং অনুন্নত মেধার শিক্ষার্থীদের আকর্ষণীয় ও আনন্দে শিক্ষাদান করার জন্য আমি গান, কবিতা, ছড়া, নাটক, নমুনা, ছবি, গল্প এমনকি নৃত্যের মাধ্যমে পাঠদানের একটি পন্থা অবলম্বন করি এবং আমার ঐ গহমী শিখর বাসিনী বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নিয়েই একটি অডিও ক্যাসেট করি, পরে অবশ্য সেটি ভিডিওতে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। আমি ঐ অডিও ক্যাসেট ও টেপরেকর্ডার নিয়ে সেই ১৯৯৫ সালে যখন কোন অডিও-ভিসুয়ালের জোয়ার আসেনি তখন থেকেই নিজের স্কুল ও আরও বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে শেষের দু-একটি পিরিয়ডে প্রধানশিক্ষকের অনুমতিক্রমে আমার অভিনব পদ্ধতিতে পাঠদান করতাম। বাঁটিকা উচ্চ বিদ্যালয় যেখানে আমি পড়াশোনা করেছি সেখানেও একদিন ঐরূপ ক্যাসেট নিয়ে গল্পে, গানে, ছড়ায়, কবিতায় পাঠদান করলাম। চন্দ্রনাথ স্যার তখনও উক্ত স্কুলেই ছিলেন ও রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার পেয়েও গেছেন। আমার ঐরূপ পাঠদান ও জনশিক্ষা প্রচার মানে বিভিন্ন জনবহুল জায়গায় বিজ্ঞান সচেতনতা, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সচেতনতা, বিভিন্ন রোগ সম্বন্ধে জনগণকে সচেতন করার ক্রিয়াকলাপ শুনে তিনি মুগ্ধ হয়ে বললেন আমার সমস্ত কর্মপদ্ধতি, বই, সিডি, ক্যাসেট ও বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করার প্রমাণপত্র আমার প্রধান শিক্ষিকার কাছে জমা দিতে এবং তিনি যেন সেগুলি ডি.আই.এর কাছে পাঠান। আমার স্কুলের বড়দি মাননীয়া শিপ্রা ব্যানার্জী মহাশয়া সানন্দে সেগুলি মাননীয় ডি.আই সাহেবের নিকট জমা দিয়েছিলেন এবং আমি ২০০৩ সালে রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার অর্জন করি। চন্দ্রনাথ স্যারকে জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম, তাঁর দেখানো পথে আমি কর্মের স্বীকৃতি পেয়ে ধন্য হলাম।
আর একজন শিক্ষকের কথা বলবো যিনি সমস্ত শিক্ষককুলের কাছে এক দৃষ্টান্তস্বরূপ। আমি ২০০২ সালে আমার প্রধান শিক্ষিকার পদে বাঁটিকা বালিকা বিদ্যালয়, বৈঁচীতে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করি। যোগদান করার দিন আমি প্রধান শিক্ষিকার নির্দিষ্ট ঘরের চেয়ারে বসে আছি, হঠাৎ একজন অতি বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমার ঘরের সামনে এসে উপস্থিত হলেন। আমি প্রথমে সুকুমার স্যারকে চিনতে পারিনি কারণ অনেক দিন ওনার সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই। ভাল করে দেখার পর চিনতে পেরে বললাম, “স্যার আপনি? আসুন স্যার”, বলে প্রণাম করলাম। উনি আমার হাতে একবাক্স সন্দেশ আর আশাপূর্ণা দেবীর একটি গল্প সংকলন দিয়ে বললেন, “আমি খবর পেয়ে ছুটে এলাম তোর কাছে। এই প্রধান শিক্ষিকার চেয়ারে বসে দেখতে কেমন লাগে তোকে রমলা তাই দেখার জন্যেই এলাম।” শুনে তো আমি আনন্দে, বিস্ময়ে একেবারে বাকরুদ্ধ। এই বৃদ্ধ বয়েসে বাসে চেপে স্যার হাতনি থেকে আমার বিদ্যালয়ে এসেছেন আমাকে দেখতে। স্যার আমায় শিখিয়ে দিয়ে গেলেন কেমন করে ছাত্রছাত্রীদের ভালবাসতে হয়, তাঁদের উন্নতিতে কেমন করে আশীর্বাদ করতে হয়। জানিনা একটুও শিখতে পেরেছি কিনা, তবে যতদিন বাঁচবো চেষ্টা করে যাবো। আর এক শিক্ষকের কথা বলে শেষ করবো। আমি প্রধান শিক্ষিকা হবার পর পি-এইচডি করতে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। কারণ আমার নতুন স্কুল্টা ছিল প্রাতঃকালীন, তাই মনের গভীর ইচ্ছাপূরণ করতে অনেক দিন পর একটু সুযোগ পেলাম ও গবেষণায় রত হলাম। এমএসসি শেষ করার বাইশ বছর পর গবেষণা করতে গিয়ে প্রথমে বেশ অসুবিধা হয়েছিল, কিন্তু আমার পথপ্রদর্শক স্যার ডঃ রাধানাথ মুখার্জী মহাশয় আমাকে অনেক পুরনো ও নতুন তথ্য খুব আন্তরিকতার সাথে শিখিয়ে আমায় গবেষণার পথে এগিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও প্রণতি।
আমার শিক্ষক ভাগ্য খুবই সুপ্রসন্ন। আমি অনেক গুণি শিক্ষকের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছি আমার জীবনে। আমার বাবা-মা, আমার সমস্ত শিক্ষক -শিক্ষিকা, আর যাঁর জন্মদিন উপলক্ষ্য করে শিক্ষকদিবস সেই মহামানব ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণকে জানাই অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা ও প্রণাম। ♦