27/04/2024 : 3:38 AM
ই-ম্যাগাজিনসাহিত্য

|| বাজলো তোমার আলোর বেণু || e-জিরো পয়েন্ট – আশ্বিন ১৪২৭

গল্প


অন্য পুজো

✒কবিরুল
” শঙ্খ শঙ্খ মঙ্গল গানে
           জননী এসেছে দ্বারে “
     সত্যিই তো আর কদিন পরেই সকলের ঘর আলো করে মা উমা আসবেন। সকলের ব্যস্ততা একেবারে তুঙ্গে। সবাই বাইরে কেনা কাটা করছে।
     মলি শুভধীপকে কবে থেকে মার্কেটিং করার জন্য বলছে।শুভদীপের এমনিতেই কাজের চাপ। সবে বদলি হয়ে নতুন জায়গাতে এসেছে। একেবারে দম ফেলার টাইম নেই।
      আজ দুদিন ধরে কথা দিয়েও শুভ শপিং এ বেরোতে পারছে না। ঘরে আসলেই ল্যাপটপ তার সঙ্গী।
     আজ রবিবার আজ টাইম দিলেও মুষলধারে বৃষ্টির জন্য যেতে পারল না।
    সকাল থেকেই তাই  মুডটা আজ অফ মলির। একপ্রস্থও তুমুল ঝগড়া হয়ে গেছে।
      দুদিন আগেই বিদ্যাসাগরের জন্মদিন পালিত হল স্কুলে। সব দিদিমণিরা তাদের হাসব্যাণ্ডকে সাথে করে এসেছিল। ব্যাতিক্রম শুধু মলি। ওর বর আসতে পারেনি। অভিমানের পারদ তাই একটু বেশী।
     এমনিতেই প্রতিবছর মলির স্কুলে বেশ ধুমধাম করে বিদ্যাসাগরের জন্মদিন পালন করা হয়। অনেক লোকের সমাগম হয়। অনেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
     এবারের অনুষ্ঠানের পুরো রেসপনসিবিলিটি মলি উপর বর্তায়। তাই পরিশ্রমটাও দ্বিগুণ। অনেক খাটতে হয়েছে।
     দিদিমণিদের মধ্যেও অনেক প্রতিযোগিতা হয়েছিল। আর সেখানে মলি একটাও প্রাইজ আনতে পারেনি। একটা চাপা দুঃখ তাই সব সময় ঘিরে ধরেছে।
    মলির স্কুলটা ঈশ্বরচন্দ্রের জন্ম ভিটার অনেকটাই কাছে। তাই আবেগের মাত্রাটা সব স্কুলের থেকে একটু বেশী। নেতা মণ্ত্রীদের ও চাপ থাকে।
      *******
    দুপুরে মেয়ের ফোনটা পেয়ে একটা ফ্রেশ অক্সিজেন পেল। তিতিরের স্কুলে বিদ্যাসাগরের জন্মদিনের দিন প্রবন্ধ লেখার প্রতিযোগিতা হয়। প্রবন্ধের সাবজেক্ট ছিল ” নারী স্বাধীনতা ,  নারী শিক্ষা ও শিক্ষার বিস্তার “। তিতির ফার্স্ট প্রাইজ জিতেছে।
      সব শুনে মলির চোখে ঘোর বিস্ময়। ওইটুকু মেয়ে এত শক্ত একটা টপিকে প্রথম প্রাইজ জিতেছে তাতেই মলির আনন্দ আর ধরে না। নিজে পুরষ্কার না পেলেও তিতিরতো পেয়েছে।
তবে একটু খচখচানি থেকে গেল।নারী স্বাধীনতা বিষয়টা তিতির কিভাবে রপ্ত করে লিখল সেটাই জানতে চাইল মলি।
  মলি ফোনে যা শুনল তা স্পীকার অন করে শুভকেও শোনাল।
********
মলি গ্রামের মেয়ে। একটু ভীত। যদিও চাকরি করে। তবু সেইভাবে স্বাধীন না। সব ব্যাপারে শুভর উপর নির্ভর করতে হয়। যে কোন কাজে শুভদীপ মতামত দেয়। একা একা রাস্তা ঘাটে বেরোতেও শুভ তেমন ভরসা পায় না।
ছোটবেলাতেই বাবা মার নিদারুণ শাসনে মানুষ হয়েছিল। ভেবেছিল বিয়ের পর একটু স্বাধীনভাবে গুছিয়ে সংসার করবে। ফ্রেশ অক্সিজেন নেবে। করতে পারেনি।
 শুভদীপ করতে দিল না। একটা খাঁচার মধ্যে করে বন্দী করল। নিজের স্বাধীন স্বত্তাটুকূ একটু একটু করে লোপ পেল।
এতে শুভর কোন দোষ ছিল না। ও জানে বেশী স্বাধীনতা পেলে মানুষ মাথাতে ওঠে। যেটা ওর একমাত্র বোনের ক্ষেত্রে হয়েছিল।
বারো ক্লাস পাশ করার পর কলকাতাতে পড়তে গিয়ে বাজে সঙ্গ ধরল। অসীম স্বাধীনতার সাধ পেতে ধরল মদ। তারপর ড্রাগস্। নিত্যদিন নেশা করে ঘরে ফিরত। তাপর জীবনের কোন মোরে গিয়ে হারিয়ে গেল। একেবারে গোল্লায় গেল।
  ছোট্ট তিতির মা বাবা পিউমণির সব ঘটনা গুলো শুনেছে। সেইগুলিই নিজের প্রবন্ধে রিফ্লেক্ট করেছে।
  আজ তিতিরের সাফল্যে শুভদীপ বেশ উল্লসিত। চোখের কোণে নোনা পানির ধারা।
 আকাশের কালো মেঘের বোরখা অনেক আগেই সরে গেছে। শুধু মলির মন থেকে অভিমানের চাদর এখনও সরেনি। শরতের সোনাঝরা দুষ্টূমি ভরা রোদ্দুরের দস্যিপনা অল্প অল্প করে মলির নাইটিতে পাক খাচ্ছে। শুভ একমনে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে।
মলি আলতোভাবে শুভকে বুকে টেনে নিল। মলির চোখের কোণ বেয়ে নামছে শরতের নিষ্পাপ শিশির। ওর অবাধ্য চুলগুলো শুভর কপালে ভালবাসার উপপাদ্য আঁকছে।
আজ মলিকে সাংঘাতিক সুন্দর দেখাচ্ছে। একদম টেরিফিক। মলি জানে শুভদীপের জন্যই আজ তিতির প্রাইজ পেয়েছে। ও চাইনা শপিং করতে। একা বেরোতে। এইভাবে শুভর ভালবাসার কাছে  পরাধীন থাকতে চাই।
*******
বিকেলের ফুলপিসিমার ফোন সব অঙ্ক বদলে দিল। পিসিমা পূজোতে ওদের তিনজনকে আস্তে বলেছে। পিসিমার গ্রামের পূজোর এবার পঞ্চাশ বছর। বিশাল ব্যাপার।
সেই কোন ছোটবেলাতে একবার সেখানে এসেছিল। তারপর শুভর সাথে আর একবার। তারপর আর আসেনি।আজ বহু বছর পরে সেই গ্রামটা একবার দেখতে ইচ্ছে করছে।
 গ্রাম দেখার থেকেও পিসিমার পাড়ার পূজোর এবারের থীম ” বিধবা বিবাহ ও নারী স্বাধীনতা “। কারণ পিসিমার গ্রামেও বিদ্যাসাগরের আবেগ মাখা। অবিভিক্ত মেদিনীপুরের একটা আদিবাসী গ্রাম। যে গ্রামে বিদ্যাসাগর বহুবার এসেছেন। মানুষের সেবা করেছেন।
  *******
পঞ্চমীতে গ্রামে পা রেখেই বুঝতে পারল পুজো কাকে বলে। এবারের পুজো সাঁওতালী মেয়েরা করছে। সাথে বেশ কিছু হিন্দু আর মুসুলমান বৌরা যোগদান করেছে।
 পুজোর রাশ মহিলা সমিতির হাতে। একেবারে নারী শক্তির জাগরণ যাকে বলে। পুরুষ প্রবেশ নিষেধ।
ছোটবেলার খেলার সাথীরা সব একে একে হাজির। মলির আজ আনন্দের শেষ নেই। টুসু , ঝুমরি , লাচন , ডংলু , নাফিসা , তমরু , ঝিলম , বাসির কে না নেই। ওদের মুখের পরিভাষা বদলে গেছে। মলিকে পেয়ে ওরাও আনন্দে আত্মহারা।
  সারা পুজো আর মণ্ডপে বিদ্যাসাগরের ছোঁয়া। সেই সাথে নারী স্বাধীনতার জয়গান। মুসুলমান বৌরাও বেশ খুশীতে ডগমগ করছে। একটা দারুণ পরিবেশ।
  পূজোর আবার জাত কিসের! মা উমার কাছে সব শুদ্ধ।
  রবীন্দ্রনাথ ঠিক বলেছেন  ” Unity in diversity “.আজ সারা মণ্ডপে রবিঠাকুর আর বিদ্যাসাগর মিশে গেছেন।
” বাজলো তোমার
   মাতলো রে ভুবণ “
ভোর হতেই মাইকের জোরালো গানে ঘুম ভেঙ্গে গেল।
গ্রামের পরিবেশ সত্যিই মায়াবী।
সবুজের মখমলে শিশিরের চন্দন। কাশের মাতলামি। ঢাকের মাতাল করা সুর।
  কচিকাঁচারা  ছুটছে। তাদের হাতে বাজি। ফুলঝুরি।
 সবাই কে দেখতে পেল। মলির একমাত্র বন্ধু বকুলকে দেখতে পেলনা। ও কি মারা গেছে? অনেক অল্প বয়সে ত বিধবা হয়েছে।বকুলকে দেখতে না পেয়ে মনটা খারাপ।
**********
ষষ্ঠীর  দিন পিসিমা পাড়ার পুজো বিধবা বকুলকে দিয়ে উদ্বোধন করাল। সবার চোখে আনন্দের অশ্রু। বিধবা তো কি হয়েছে ? মা দশভূজার সেও সন্তান।
 বকুল ফিতে কাটছে আর জামালের বৌ আফসানা বকুলকে ধরে আছে। সম্প্রীতির এক অপূর্ব মেল বন্ধন।
আজ অষ্টমী। শুভর এখনও পাত্তা নেই। মনে হচ্ছে এবারেও ডোবাবে।
অঞ্জলি শুরু হতে আর কিছু সময় বাকি।
শুভ ঢুকল। ওর পাশে ওর বোন শুভশ্রী।
  বৌদিকে দেখতে পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মলির বুকে।
শ্রী অনেক চেঞ্জ। মলির গরদের শাড়ি ভেসে যাচ্ছে চোখের জলে।
আজ সবাই মিলে অঞ্জলি দিল।
 *******
সন্ধি পুজোর ১০৮টি প্রদীপ জ্বলে উঠল। বাইরে প্রবল জোরে তখন বাজছে
” দুর্গে  দুর্গে ♥

Related posts

|| শিক্ষাঞ্জলি || e-জিরো পয়েন্ট – ভাদ্র ১৪২৭

E Zero Point

সংশপ্তকের শারদীয়া পত্রিকা প্রকাশ

E Zero Point

দৈনিক কবিতাঃ অব্যক্ত – শম্পা গাঙ্গুলী ঘোষ

E Zero Point

মতামত দিন